Type to search

শিশুকে যেভাবে আচরণ শেখাবো

শিক্ষা

শিশুকে যেভাবে আচরণ শেখাবো

বিলাল হোসেন মাহিনী

আমাদের সমাজে শিশুশিক্ষা নিয়ে নানা মত আছে এবং থাকবে এটাই স্বভাবিক। কেউ চায় শিশু একেবারেই শাসনমুক্ত রাখতে এবং পূর্ণ স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠুক, আবার কেউ কেউ চায় শিশুকে শাসনের মাধ্যমে ‘মানুষ’ বানাতে। প্রকৃতপক্ষে একজন শিশুকে ¯েœহ-মমতা ও ভালোবাসা দেয়ার পাশাপাশি তাকে মৃদু শাসনে রাখাও জরুরি। এখানে শাসন অর্থ আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার শেখানো। গায়ে হাত তোলা বা বকাঝকা করা উদ্দেশ্য নয়। কেননা, বাচ্চা শিশুটিতো আর বড়দের মতো জানে না বা বোঝে না যে, তাকে কোনটা করতে হবে, কোনটা করতে মানা। সে তো মনের সুখে বাসার ট্যাব ছেড়ে দিয়ে জল নিয়ে খেলবে। দা-কাচি, কোদাল-খুন্তি দিয়ে বারান্দা বা উঠোন খুঁচবে। কাদামাটির খেলা খেলবে। নিজের বাসার বা কোথাও বেড়াতে গেলে অন্যের বাসার নানা জিনিসপত্র হাতাবে, ভাঙবে। কারণ শিশু তো শিশুই। সে তো অবলীলায় দেয়ালে আঁকিবুঁকি করবে, অন্য বাচ্চার সব খেলনা দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করবে। সোফায় লাফাবে, আত্মীয়ের বাসার সৌখিন জিনিসপত্র টানাটানি করবে, অন্যের বাচ্চার গায়ে হাত তুলবে, মারামারি করবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তো ছোটবেলা থেকেই তাকে শেখাতে হবে যাতে তার কোনো আচরণে অপরের কষ্ট না হয়। তাকে ‘সরি’ বলতে শেখাতে হবে। বাচ্চার দোষটাকে দোষ বলেই জানাতে হবে। নিজের বাচ্চা বলে দোষ ঢাকতে যাওয়া যাবে না। তাতে শিশুটি দিন দিন অসভ্য বনে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, নিজ সন্তান অন্য কারো সাথে মারামারি করলে দুই জনকেই শান্ত করতে হবে। খাবার পরিবেশনে ভালো ও বড় ফল বা খাবারটা অন্যের শিশুকে দিতে অভ্যস্ত হতে হবে। এতে সন্তান দানশীল ও অপরের অধিকার সচেতন হবে। সন্তানকে শিষ্টতা ও মার্জিত চলাফেরা শেখাতে হবে। তবে মাঝে মধ্যে সন্তানকে অভাব দেখাতে হবে। সর্বদাই যা চায় তাই দিয়ে দেয়া যাবে না। এতে শিশুটি অভাব কি, তা জানতে পারবে না। শিশুর সামনে বেশি টাকা-পয়সার লেনদেন ও বারবার টাকা না গোনাই ভালো। অন্যের খাবারে যেনো না তাকায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

তবে শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশে শিশুকে শিশুবান্ধব শিক্ষা, শিশুবোধক বই, শিশুতোষ শিক্ষা উপকরণ দিতে হবে। শিশুর মনের উৎকর্ষ সাধনই শিশু বিকাশের মূলকথা। শিশুর মৌলিক তিনটি বৈশিষ্ট্য হলো- প্রয়োজন, আগ্রহ ও সামর্থ্য। শিশুর কী দরকার, কীসে আগ্রহ ও তার সামর্থ্য যাচাই করে শিশুকে সেভাবে গড়ে তোলা দরকার। গতানুগতিক শিক্ষায় এগুলো অবহেলিত। বয়স্কদের প্রয়োজনের বিচারেই শিশুর শিক্ষা পরিকল্পিত ও পরিচালিত হয় বলে শিশুর স্বতন্ত্র বিকাশ হয় না । কিন্তু আধুনিক শিক্ষায় শিশুর ইচ্ছা ও আগ্রহই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জাপান, নেদারল্যান্ডসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে শিশুকে নিজের মতো করে বাড়তে দেয়া হয়। এমনকি শিশুকে গাড়িতে উঠতে বা খাবার খেতে সাহায্যও করা হয় না। শিশু নিজের কাপড় ও জুতো নিজেই পরিষ্কার করতে শেখে। নিজের বিছানাপত্র নিজে গুছায়।
শিশুদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মানোভাব যাতে গড়ে না উঠে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রোল এক হতেই হবে বা জিপিএ ৫ অথবা গোল্ডেন পেতেই হবে, সায়েন্স পড়তেই হবে এমন অদ্ভুত ধ্যান-ধারণা ত্যাগ করতে হবে। শিশুকে সৎ, সততা ও স্পষ্টভাষী করে গড়ে তুলতে হবে, ভয়-ভীতি মুক্ত রাখতে হবে। জুজুর ভয়, শিয়ালের ভয়, কেঁচো বা জোকের ভয় বা ভুঁতের ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে। শিশুর বইয়ের বোঝা ও মানসিক চাপ কমাতে হবে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না। শিশু স্বাস্থ্যকে অত্যধিক গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক সময় শিশু বাজারে যেয়ে যা চায় আমরা তাই কিনে দিই। এটা পরিত্যাগ করতে হবে। মাঝে মধ্যে শিশুকে নিয়ে বাজার থেকে কিছু না কিনেই ফিরতে হবে। এতে বাজারে গেলেই যে কিছু (খাবার-খেলনা) কিনতেই  হবে, এই ধারণা পাল্টে যাবে।
শিশুকে ভিডিও, গেমস ও মোবাইল-টিভি স্ক্রীণ থেকে যতোটা সম্ভব দূরত্বে রাখতে হবে। এর বিপরীতে উঠনে, ছাদে বা খেলার মাঠে নিয়ে যেতে হবে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা এবং রাতের খাবার গ্রহণের পর সকাল সকাল ঘুমোতে দিতে হবে। প্রত্যুষে শারীরিক ব্যায়াম ও বিকেলে খেলাধুলায় অভ্যস্ত করতে হবে। শিশুকে বার বার ‘তুমি পারবে না, বা ‘তোমার দ্বারা হবে না’ এসব নেগেটিভ শব্দ শোনানো যাবে না।

‘রেইজিং আওয়ার চিল্ড্রেন, রেইজিং আওয়ারসেলভস’ নামে একটি বই বিশ্বখ্যাত বই আছে। যেটি আঠারোটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বেস্ট সেলার এ বইয়ের লেখক নাওমি আলডর্ট। তিনি সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে শিশু-সন্তান বড়ো করা নিয়ে বিভিন্ন রকম সহায়তা ও নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। সেটিও পড়ে দেখতে পারেন। এছাড়াও ‘প্যারেন্টিং’ নামে গার্ডিয়ান প্রকাশনীর বইসহ শিশু শিক্ষার বইসমূহ পড়া যেতে পারে। শিশুকে কথায় কথায় চড় মারা, গায়ে হাত তোলা ও বকাঝকা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বার বার তাকে শান্ত মেজাজে বোঝাতে হবে। শিশুর সাথে সুন্দর ও মিষ্টি কথা বলতে হবে। তবে, শিশুকে শিখাতে হবে- রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি নয়, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মারামারি নয়, কাপড়ে প্র¯্রাব করা নয়, প্রতিবেশীর বাগানের ফুল ছেঁড়া নয়, কুকুর-বিড়ালকে ব্যথা দেওয়া নয়।
এগুলো শাস্তি হিসেবে নয়, বরং জীবনের সীমারেখা হিসেবে শেখাতে হবে। কোনটি ভদ্র আর কোনটি অভদ্র আচরণ তা শেখাতে হবে। ছোটকে ¯েœহ ও বড়োকে সম্মান করার জ্ঞান দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে শিশুকে শাস্তি দিলে তারা আরও বেশি অসদাচরণ করে। শাস্তি পেলে শিশুরা আরও উগ্র আর আত্মরক্ষামূলক আচরণ করে। শাস্তি সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। তাদের ওপর পিতামাতার প্রভাব কমিয়ে দেয়। যেসব সন্তানরা বাবা-মায়ের কাছে সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং নিশ্চিত বোধ কওে, তারা ঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারে, তাদের বুদ্ধিমত্তার মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। মোটকথা, একজন দায়িত্বশীল, বন্ধুপ্রতীম আর সুখি সন্তান তৈরি করতে শাস্তি কোন সাহায্য করে না। বরং বুমেরং হয়।
হিন্দু ধর্মে শিশুর দশবিধ সংস্কারের কথা আছে। এছাড়াও গর্ভ-সংস্কার, শৈশব -সংস্কার, কৈশোর-সংস্কার, যৌবন-সংস্কার নামে আরও চারটি সংস্কার শিক্ষা দেয়া হয়। স্বরসতী জ্ঞান ও বিদ্যার দেবী। শিশুকাল থেকেই সনাতনী পিতামাতা শিশুকে বিদ্যা শিক্ষায় মনোযোগী হয়ে থাকে।  ইসলাম ধর্মে সন্তানকে সম্বোধনে চমৎকার ভাষা ব্যবহার করে সুরা লুকমানে হযরত লুকমান (আ.) তার পুত্রকে ‘হে প্রিয় বৎস’ বলে ডেকেছেন। সন্তানদের প্রতি কোমল ও স্নেহময়ী হতে শিখিয়েছেন মহানবী (সা.)। তিনি পিতামাতাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘কোনও পিতা তার পুত্রকে উত্তম শিষ্টাচার অপেক্ষা অধিক শ্রেয় আর কোনো কিছু দান করতে পারে না’ (তিরমিজি)।