Type to search

বাঘারপাড়ায় টিআর কাবিখা ও কাবিটার কোনো প্রকল্পেই কাজ না করে বিল তুলে নিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা

বাঘারপাড়া

বাঘারপাড়ায় টিআর কাবিখা ও কাবিটার কোনো প্রকল্পেই কাজ না করে বিল তুলে নিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা

ডেস্ক :

যশোরের বাঘারপাড়ায় সংস্কার কর্মসূচির আওতায় কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা), কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোনো কাজ না করেই বা আংশিক কাজ করে পুরো টাকাই আত্মসাত করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। অনুসন্ধানে উপজেলার ৯টি ইউনিয়নেই এমন চিত্র উঠে এসেছে। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকার অপচয় হয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
উপজেলা পিআইও অফিস সূত্রে জানা গেছে, সংস্কার কর্মসূচির অধীন গ্রামীণ পর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়নে ২০২৩-২৪ অর্থ-বছরে প্রথম পর্যায়ের গত ১৪ জুলাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বাঘারপাড়া উপজেলায় কাবিটা প্রকল্পে ৬৫ লাখ, ৩৩ হাজার, ৪৯৭ টাকা, কাবিখা প্রকল্পে ৩১.৫২১১ মেট্রিক টন চাল ও ৩১.৫২১১ মেট্রিক টন গম যার আনুমানিক মূল্য ২৭লাখ ২৬হাজার ৭’শ ৮৯টাকা এবং টিআর হিসাবে ৪৯ লাখ ২৩ হাজার ৬৯৮ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সরকার প্রতি মেট্্িরকটন চালের বাজার মূল্য নির্ধারণ করে ৫১হাজার ৮’শ ৯৪ দশমিক ৫৯ পয়সা এবং গমের মূল্য নির্ধারণ করে ৪৭হাজার ৩’শ ২টাকা ১৪পয়সা। গত ১৫ নভেম্বর ছিল এসব প্রকল্পের অর্থ উত্তোলনের শেষ সময়।
এসব বরাদ্দে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রকল্প গ্রহন ও বাস্তবায়ন করা হয়। কাজের তদারকি করেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে কাবিটা, কাবিখা ও টিআরের এ রকম ৪৫ টি প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করে বা একেবারেই কাজ না করে অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে।
উপজেলার ১নং জহুরপুর ইউনিয়নে কাবিটায় ৫ লাখ ১৫ হাজার ৩৬২ টাকা, কাবিখায় ২.৪৬৫ মেট্রিক টন চাল ও ২.৪৬৫ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং টিআর হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৩’শ ৮১ টাকা। এ ইউনিয়নে কাবিটা প্রকল্পে হলিহট্র গ্রামের আবু তাহেরের বাড়ি থেকে হামিদের বাড়ি পর্যন্ত কাচা রাস্তার সংস্কার বাবদ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু স্থানীয় লোকজন জানান, কয়েকমাস আগে ইঞ্জিন চালিত ভটবটি গাড়িতে সামান্য কিছু মাটি দিয়ে রাস্তা সমান করা হয়েছে। পরিবহন খরচসহ এর মূল্য ১০ হাজার টাকার বেশি নয়।
এ প্রকল্পের সভাপতি ২ নম্বর ওয়ার্র্র্ডের ইউপি সদস্য নূরুল ইসলাম জানান, ৩৪ ট্রলি মাটি দিয়েছি ৫০হাজার টাকার মত ব্যায় হয়েছে।
সরেজমিনে এ ইউনিয়ন অন্যসব প্রকল্পেরও একই অবস্থা। সামান্য মাটি দিয়েই প্রকল্পের সব টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
২নম্বর বন্দবিলা ইউনিয়নে কাবিটা ও কাবিখা প্রকল্পে ৭ লাখ ৩৯০ টাকা এবং ৩.৩৪৫ মেট্রিক টন চাল ও ৩.৩৪৫ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখানে টিআর হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫ লাখ ২৭ হাজার ৮’শ ২০ টাকা।
অনুসন্ধানে দেকা গেছে টিআর প্রকল্পে খাজুরা পুলিশ ক্যাম্পের গোলঘর নির্মাণ ছাড়া অন্য কোন প্রকল্পের কাজ হয়নি। কাবিটা প্রকল্পে তেলিধ্যানপুড়া গ্রামের আরিফের ভাটা হতে নুর ইসলামের বাড়ি পর্যন্ত কাচা রাস্তার সংস্কার বাবদ ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। পথচারি ইউনুছ ফারাজি জানান, এ রাস্তায় কোন মাটির কাজই হয়নি। এ প্রকল্পের সভাপতি সংরক্ষিত ইউপি সদস্য শাহানাজ বলেন , ’আমি বেশ আগে সই করে দিছি, চেয়ারম্যান ভাই সব জানে’ আমি কিছুই জানিনা।
৩নম্বর রায়পুর ইউনিয়নে কাবিটায় ৬লাখ ৪১হাজার ৮’শ ৫০ টাকা, কাবিখা প্রকল্পে ৩.৭০ মেট্রিক টন চাল ও ৩.৭০ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখানে টিআর হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৭’শ ০৪ টাকা। এ ইউনিয়নে কাবিটা প্রকল্পে আজমেহেরপুর উত্তর পাড়া জামে মসজিদ হতে শ্মশান পর্যন্ত কাচা রাস্তা মেরামতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ টাকা। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী নামমাত্র এক্সকেভেটর দিয়ে কাজ দেখিয়ে প্রকল্পের সব টাকা তুলে নিয়েছেন। পরিষদে বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এর আগেও কাজ না করে বিল তোলার অভিযোগ রয়েছে।
এ প্রকল্পের সভাপতি সংরক্ষিত ইউপি সদস্য রাবেয়া বেগম জানান, ভাল কাজ হয়েছে। আমি বাঘারপাড়ায় পিআইও অফিসে যেয়ে সই করে দিয়ে এসেছি।
৪ নম্বর নারিকেলবাড়ীয়া ইউনিয়নে কাবিটায় ৬ লাখ, ৪৬ হাজার ৫৫৪ টাকা, কাবিখা প্রকল্পে ৩.৯০ মেট্রিক টন চাল ও ৩.৯০ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখানে টিআর বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪ লাখ ৮৭ হাজার ২’শ ৪৯ টাকা। এ ইউনিয়নে একটি প্রকল্পেও কাজ হয়নি। অথচ সব বিল তুলে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ইউনিযনের কাবিটা প্রকল্পে বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের আয়ূব আলীর বাড়ি হতে শ্রীরামপুর গ্রামের আনোয়ার সিকদারের বাড়ি পর্যন্ত কাচা রাস্তা সংস্কারে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। শ্রীরামপুর গ্রামের শরিফুল ইসলাম জানান, এ রাস্তায় তিনি কোন মাটির কাজ হতে দেখেননি।
এ প্রকল্পের সভাপতি ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাসুদ কায়সার জানান, প্রকল্পের সভাপতি কিনা জানতে চাইলে বলেন পরিষদে আসেন কথা হবে।
৫ নম্বর ধলগ্রাম ইউনিয়নে কাবিটায় ৪ লাখ ৯২হাজার ৩৭০ টাকা, কাবিখা প্রকল্পে ২.৩৫৫ মেট্রিক টন চাল ও ২.৩৫৫ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখানে টিআর হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৯ টাকা ।
এখানে কাবিটা প্রকল্পে আগড়া গ্রামের সাইদুর রহমানের বাড়ির পাশের পাকা রাস্তা হতে জসিমের বাড়ি পর্যন্ত কাচা রাস্তা সংস্কার বাবদ ২ লাখ ৯২ হাজার ৩’শ ৭০ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। রাস্তার পাশের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম জানান, এ রাস্তায় কোন মাটির কাজ হয়নি।
এ প্রকল্পের সভাপতি ১নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, কাজ চলমান আছে। চেয়ারম্যান যে রকম বলেছে সেরকম কাজ করছি।
৭নম্বর দরাজহাট ইউনিয়নে কাবিটায় ৪ লাখ, ৮৩ হাজার ৪’শ ৭৮ টাকা, কাবিখা প্রকল্পে, ২.৩১৮ মেট্রিক টন চাল ও ২.৩১৮ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখানে টিআর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৩’শ ৫৩ টাকা।
এখানে টিআর প্রকল্পে কালিকাপুর গ্রামের মাখন বিশ্বাসের বাড়ি হতে বিল জলেশ্বর পর্যন্ত কাচা রাস্তা উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩’শ ৫৩ টাকা । এ রাস্তার পাশে মাখন বিশ্বাসের বাড়ি। তিনি জানান, এরাস্তায় আমাদের ব্যক্তিগত চলাচলে আমরা টাকা খরচ করে মাটি দিয়েছি। চেয়ারম্যান কোন মাটি দেয়নি এ রাস্তায়।
এ প্রকল্পের সভাপতি ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য পরেশ বিশ্বাস জানান, আমি প্রকল্পের নাম মাত্র সভাপতি। সব চেয়ারম্যান জানে।
কাবিটা প্রকল্পে পুকুরিয়া বিলে যাওয়ার একই রাস্তাকে দুটি ভাগ করে দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে বাবুল মোল্যার জমির পাশ হতে সায়েম আলীর বাড়ি পর্যন্ত। এখানে রাস্তা সংস্কারে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ টাকা।
এ প্রকল্পের সভাপতি ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য খন্দকার ফকরুল ইসলাম জানান, কাজে এখনো হাত দেওয়া হয়নি। চারিপাশে ধানপান রয়েছে। চেয়ারম্যান সই করতে বলেছে, সই করে দিয়েছি।
কাবিটা প্রকল্পে শাহাদত এর জমির সামনে হতে আজিজার বিশ্বাসের জমি পর্যন্ত কাচা রাস্তা সংস্কার বাবাদ ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪’শ ৭৮ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান এসব রাস্তায় কোন কাজ হয়নি। কাজ না করে এসব প্রকল্পের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
৮নং বাসুয়াড়ি ইউনিয়নে কাবিটা ৫ লাখ ৩৬ হাজার ২৬৯ টাকা, কাবিখা প্রকল্পে ২.৫৬৫ মেট্রিক টন চাল ও ২.৫৬৫ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখানে টিআর হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪ লাখ ৪ হাজার ১’শ ৭৩ টাকা। এ ইউনিয়নে কোন প্রকল্পে রাস্তা সংস্কারের চিহ্ন মাত্র দেখা যায়নি। এমন তথ্য অনুসন্ধানে পাওয়া যায় ।
কাবিটা প্রকল্পে রাধানগর গ্রামের হাবিল মোল্যার বাড়ি হতে দাখিল মাদরাসা পর্যন্ত ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এরাস্তায় কোন কাজ হয়নি বলে জানান মাদরাসার একাধিক শিক্ষার্থী।
প্রকল্পের সভাপতি ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জিল্লুর রহমান জানান, কাজ করা হয়নি। কাল অফিসে এসে দেখা করবানে।
৯নম্বর জামদিয়া ইউনিয়নে কাবিটা ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৫’শ ১৩ টাকা, কাবিখা প্রকল্পে ২.৮৬৭ মেট্রিক টন চাল ও ২.৮৬৭ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখানে টিআর হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৫১ হাজার ৭৯৮ টাকা।
কাবিটা প্রকল্পে জয়রামপুর গ্রামের তারা দত্তর বাড়ি হতে নির্মল দাসের বাড়ি পর্যন্ত মাটি দিয়ে কাচা রাস্তা সংস্কার বাবদ ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ। পথচারি আবু ইউছুপ বলেন, এ রাস্তায় কোনো মাটি ফেলা হয়নি ।
প্রকল্পের সভাপতি (৭, ৮ ও ৯ ওয়ার্ডের) মহিলা ইউপি সদস্য আনোয়ারা বেগম জানান, সই করে দিয়েছি, চেয়ারম্যান বিল তুলে নিয়েছেন। কাজ করা হয়নি।
একই প্রকল্পে জামদিয়া গ্রামের লুৎফর বিশ্বাসের বাড়ি হতে ইকবাল মোল্যার বাড়ি পর্যন্ত কাচা রাস্তায় মাটির সংস্কার বাবদ ২ লাখ ৯৯ হাজার ৫১৩ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এ রাস্তার একাধিক পথচারি জানিয়েছে, এ রাস্তায় কোন মাটির কাজ হয়নি।
প্রকল্পের সভাপতি ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ছরোয়ার হুসাইন জানান, চারিপাশে পানি থাকার কারণে কাজ করা হয়নি। বিলের কাগজে সই করে দিয়েছি। এক সপ্তাহের মধ্যে কাজ করে দিবানে।
এছাড়াও উপজেলা পরিষদের রিজার্ভ হিসাবে কাবিটায় ১৩ লাখ ৬ হাজার ৬’শ ৯৯ টাকা, কাবিখা প্রকল্পে ৬.৫২১১ মেট্রিক টন চাল ও ৬.৫২১১ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং টিআরে ৯ লাখ ৮৪ হাজার ৭’শ ৩৯ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেও টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পে কোন কাজ হয়নি।
জানতে চাইলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ইশতিয়াক আহমেদ বলেছেন, টিআর এর বিল আগেই ছাড়া হয়। তারপরে কাজ করা হয়। অফিসে আসেন, তারপর কথা বলছি বলেই মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন দেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার হোসনে আরা তান্নি জানান, জানা মতে এসব প্রকল্পের কাজা শেষ হয়েছে। তাই প্রকল্পের বিল ছেড়ে দিয়েছি।
জুনে এক মেট্রিক টন চালের দাম ছিল ৩৮ হাজার টাকা। সে হিসাবে কাবিখার এসব প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ ১ কোটি ২১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।