Type to search

নারীর অস্তিত্ব ও অধিকার : প্রসঙ্গ নারী দিবস

জাতীয়

নারীর অস্তিত্ব ও অধিকার : প্রসঙ্গ নারী দিবস

বিলাল হোসেন মাহিনী :

৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। নারী অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক দিন এটি। আমাদের সমাজে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নারী এক বিশেষ সৃষ্টি। দৃষ্টিভঙ্গি দর্শন ও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নারীকে উপস্থাপন করা হয় ভিন্ন ভিন্ন মূর্তিতে। কখনো মমতাময়ী মা, কখনো প্রিয়তমা স্ত্রী, স্নেহের বোন বা আদরের সোনামনি মেয়ে হিসেবে। অন্যদিকে এই স্বর্গতুল্য মায়ের জাতি নারীকে কোনো কোনো সময় ও অবস্থায় অলক্ষী প্রেতাত্মা পেত্নী এমনকি নিষিদ্ধ নষ্টনীড়ের সেবিকা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। অভিজাত হোটেল ম্যানেজমেন্টের নামে এক শ্রেণির কুরুচিপূর্ণ পুরুষের ভোগসামগ্রীতে পরিণত করা হয় নারীকে। এছাড়াও এক শ্রেণির ধনীক ব্যবসায়ী নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে নারীর সম্মান মর্যাদা ভুলণ্ঠিত করছে। তাদের দৃষ্টিতে নারীকে স্বল পোশাকে নগ্ন বা অর্ধ নগ্ন করে নাটক সিনেমা বিজ্ঞাপন-এ মডেল হিসেবে উপস্থাপনে দ্রুত সম্পদশালী হওয়া যায় এবং এটাকে তারা নারী স্বাধীনতা বা প্রগতি বলে চালিয়ে মূলতঃ নারীর সাথে প্রহসন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নারীকে স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতার দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। প্রকারন্তরে সেই পুরুষতান্ত্রিত সমাজ-ই গড়ে তুলছি।

সমাজে এক শ্রেণির নারী এবং তাদের সমর্থক প্রগতি ও নারীর সমান অধিকারের নামে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন, আবার তারাই নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। আকাশ সংস্কৃতি বা ভিনদেশী সংস্কৃতির অনুশীলন, বেহায়াপনা, সৌন্দর্যেও নাে দেহ প্রদর্শনের মাধ্যমে নারীরা (কেউ কেউ) নিজেদেরকে এক শ্রেণির পুুরুষের কছে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করছে। শালীনতা বিবর্জিত পোশাক ও সাজসজ্জার কারণে কখনো কখনো নারীর সম্ভ্রম ও সম্মান লুটে নিচ্ছে বখাটেরা। হতে হচ্ছে লাঞ্চিত অপমানিতা ও ধর্ষিতা।
পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকালেই আপনি দেখতে পাবেন একজন নারী ‘মা’ হিসেবে শুধু বাবার চেয়ে অধিকারে বড়ই নন, মর্যাদা ও সম্মানেও শ্রেষ্ঠ। বিশ্বনবী স.কে একবার একজন সাহাবি জিজ্ঞেস করেছিলেন, জীবিত বাবা-মা’র মধ্যে সেবা পাবার অধিক হকদার কে? মহানবী স. তিনবার বলেন, তোমার ‘মা’। এরপর চতুর্থবারে বলেন তোমার পিতা। শুধু তাই নয়, এই নারীর (মায়ের) পায়ের নিচেই সন্তানের জান্নাত। তাছাড়া আমাদের দেশের মুসলিম পারিবারিক আইনে একজন নারী তার পিতা-মাতা, স্বামী, সন্তানসহ আরও অনেকের কাছ থেকে সম্পত্তির অংশ পেয়ে থাকেন। তাই ৮মার্চ নারী দিবস আসলে কিছু নামধারী নারীবাদী যে, নারীর সমাধিকারের কথা বলেন, তাদের বুঝা দরকার, নারীকে কাগজে-কলমে সমাধিকার দিয়ে পরক্ষণে সেই মমতাময়ী মায়ের জাতি নারীকে পণ্য বানাতে বিবেকে বাধে না? নারী দিবসে নারী অধিকারের নামে মাঠে ময়দানে কাগুজে ব্যাঘ্রের মতো হুংকার না দিয়ে বরং আসুন পারিবারিক সামজিক ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর প্রকৃত অধিকার মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় সচেষ্ট হই।

পৃথিবীর সব কিছুই নর-নারী উভয়ের কষ্টার্জিত ফসল বৈকি! জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় লেখেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ কবিতাটি তিনি শেষ করেছিলেন এভাবে, ‘সেদিন সুদূর নয়, যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়!’ কিন্তু সে ‘সুদূর নয়’ যে আসলে কত দূর, তা আজও আমাদের অজানা। আজও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, পূর্ণ-স্বীকৃতিহীন নারীর শ্রম, পারিবারিক সহিংসতা, অর্থ-সম্পত্তির ওপর নারীর নিয়ন্ত্রণহীনতার বিষয়গুলো নারীর ক্ষমতায়িত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ক্রমাগত ব্যাহত করে চলেছে।

পরিশেষে বলতে চাই, শুধু দিবস উদযাপনে যেনো নারীর অস্তিত্ব ও অধিকার সীমাবদ্ধ না থাকে। নারী দিবসে নারীর জন্য বিশেষ অধিকার বা বিশেষ ট্রিট নয়; চাই নারীরা মানুষ হিসেবে নিজের, পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য কাজ করুক। তাই নারীদের জন্য প্রতিটি দিনই ঠিক তেমন হোক, যেমনটি একজন পুরুষের জন্য। কারণ, দিনের শেষে নারী-পুরুষ সবাই মানুষ। আর মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার সব মানুষেরই আছে। এক দিনের জন্য নারীকে স্পেশাল না করে সারা বছর মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করাটাই রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে সবার চাওয়া হওয়া উচিত। সেই প্রত্যাশা করছি।

লেখক : বিলাল মাহিনী, নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।