Type to search

চলতি বোরো মৌসুমে ফসল হয়নি ৪ হাজার হেক্টরে

অভয়নগর

চলতি বোরো মৌসুমে ফসল হয়নি ৪ হাজার হেক্টরে

চৈতন্য কুমার পাল : অভয়নগর উপজেলার কালিশাকুল গ্রামের কৃষক অজয় রায়। বিলকপালিয়ায় তার জমি আছে ৬ একর ৩০ শতক। গত চার বছর তিনি বিলের ওপরের অংশে সেচযন্ত্র দিয়ে সেচ দিয়ে প্রায় অর্ধেক জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। তিনি এবার মাত্র ১ একর ৫ শতকে বোরো চাষ করেছেন। সাড়ে তিন মাস সেচযন্ত্র দিয়ে সেচ দেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও এবার তিনি বাকি ৫ একর ২৫ শতক জমিতে বোরো চাষ করতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘বিলির বেশিরবাগ জমিতি এহোনও বুকসমান জল, কোনো কোনো জমিতি কোমরজল আবার কোনো কোনো জায়ায় ঠেঁই নেই। ওইসব জমিতি সমবায় ভিত্তিতে সাড়ে তিন মাস সেচ দিয়েও জল কুমাতি পারিনি।’

মনিরামপুর উপজেলার হরিদাসকাটি গ্রামের কৃষক অসীম কুমার ধরের বিলডুমুরে জমি আছে পৌনে আট একর। গত বোরো মৌসুমে সেচযন্ত্র দিয়ে সেচে ২ একর ৪ শতক জমিতে তিনি বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। ভবদহ অঞ্চলের বিলের ওইসব জমি এবার পানির তলে। তাই তিনি এবার একটি ধানের চারাও লাগাতে পারেননি। অসীম কুমার ধর বলেন, ‘এহনও বিলের জমিতি, মাজা (কোমর) জল জাগায় জাগায় বুক পর্যন্ত জল। জলাবদ্ধতার জন্য এবার কোনো জমিতি ইরি (বোরো) লাগাতি পারিনি।’

অজয় রায় ও অসীম কুমার ধরের মতো ভবদহ এলাকার হাজার হাজার কৃষক জলাবদ্ধতার জন্য এবার বোরো আবাদ করতে পারেননি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবমতে গত বছরের আগস্টের হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিতে আংশিক এবং সম্পূর্ণ মিলিয়ে ভবদহ এলাকার ছয়টি উপজেলার ৪৯৫টি গ্রামের ৭৫ হাজার হেক্টর জমি প্লাবিত হয়েছে। ওইসব জমির একটা বড় অংশে

এবার বোরো আবাদ হয়নি।

জানা গেছে, যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর ও সদর উপজেলার আংশিক এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। ২০১৩ সালের পর থেকে এলাকার কোনো বিলে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট-জোয়ারাধার) চালু না থাকায় পলি পড়ে এই অঞ্চলের ৫৪টি বিলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীর বুকে পলি পড়ে নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে নদী দিয়ে এই এলাকার পানি সরছে না। আর এ কারণে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পানিতে তলিয়ে যায় প্রায় ৪৮৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা।

গত বুধবার ভবদহ অঞ্চলের কিছু এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিলগুলোয় শুধুই অথই পানি। বিলকেদারিয়া, বিলবোকড়, বিলডুমুর, বিলঝিকরা, বিলকপালিয়া এবং বিলখুকশিয়ার অধিকাংশ এলাকায় কোনো ধানক্ষেত নেই। বিলগুলো কেবল শাপলা আর আগাছায় ভরে আছে। কোথাও কোথাও আবার স্বচ্ছ পানি। তবে বিলঝিকরা, বিলকেদারিয়া ও বিলখুকশিয়ার ওপরের অংশে কিছু ধানক্ষেত দেখা গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জলাবদ্ধতা নিষ্কাশনের জন্য ভবদহ সøুইস গেটের (২১ ভেন্ট) ওপর বিএডিসির সহায়তায় ১৩টি বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র বসিয়ে পানি সেচ দিচ্ছে। কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় অধিকাংশ সময় সেচযন্ত্রগুলো বন্ধ থাকতে দেখা গেছে।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা তিনটির ভবদহ অঞ্চলে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়। জলাবদ্ধতার কারণে ওই অংশে এবার ৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হচ্ছে না। এর মধ্যে মনিরামপুর উপজেলায় ১ হাজার ৬০০ হেক্টর, অভয়নগর উপজেলায় ১ হাজার ২৫০ হেক্টর ও কেশবপুর উপজেলায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হচ্ছে না। তবে সংগ্রাম কমিটির নেতারা কৃষি দপ্তরের এই হিসাবের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না। তাদের দাবি, এবার ভবদহের নদী দিয়ে এক ফোঁটা পানি সরেনি। তাই কৃষি অফিসের হিসাবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়নি।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সুন্দলী এলাকার সদস্য সচিব কানু বিশ্বাস বলেন, ‘সুন্দলী ইউনিয়নে সব মিলিয়ে ১৪টি ছোট-বড় বিল এবং মাঠ আছে। এর মধ্যে মাত্র ছোট দুটি বিলের ওপর অংশে সেচ দিয়ে এবার বোরোর আবাদ হয়েছে।’

জানতে চাইলে অভয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম ছামদানী বলেন, ‘জলাবদ্ধতার কারণে ভবদহ অংশে এবার ১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা সম্ভব হয়নি।

মনিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হীরক কুমার সরকার বলেন, ‘ভবদহ অঞ্চলের সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে উপজেলার ভবদহ অংশে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে এবার বোরো চাষ হয়নি।’

কেশবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মহাদেব চন্দ্র সানা বলেন, ‘জলাবদ্ধতার কারণে এবার উপজেলার ভবদহ অংশে এক হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হচ্ছে না।’

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালী বলেন, ‘ভবদহ অঞ্চলের প্রায় সব বিলে এখনো অনেক পানি রয়েছে। বেশিরভাগ বিলে এবার বোরো ধানের চাষ হয়নি।’ কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের হিসাব সম্পর্কে অবহিত করলে তিনি বলেন, ‘কৃষি কর্মকর্তারা অফিসে বসে হিসাব কষেন। তারা মাঠে আসেন না। বাস্তব জলাবদ্ধতার চিত্র সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। জলাবদ্ধ ৫৪টি বিলের অধিকাংশ জমিতে ধান নেই।’

জানতে চাইলে সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রস্তাবিত বিলকপালিয়ায় টিআরএম চালু করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৬ সালের জলাবদ্ধতা থেকে এবারের জলাবদ্ধতায় পতিত জমির পরিমাণ বেশি। তাই বিশাল এলাকায় বোরো আবাদ হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘টিআরএমকে পাশ কাটিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সেচে ভবদহ জলাবদ্ধতার সমাধান করতে চায়। এটা খামোখা মানুষের কষ্টার্জিত পয়সার অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।’