Type to search

ইসরায়েলের অদৃশ্য ঢাল আয়রন ডোম কিভাবে কাজ করে

প্রযুক্তি

ইসরায়েলের অদৃশ্য ঢাল আয়রন ডোম কিভাবে কাজ করে

আয়তনে বিশ হাজার বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি একটা দেশ ইসরাইল,ভৌগলিকভাবে এর তিন দিকে শত্রু দেশ এবং অন্যদিকে সমুদ্র। জন্মের পর থেকেই প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর এবং মুক্তিকামী ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলির মোকাবেলা করে উত্তরোত্তর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। সামরিক প্রযুক্তির দিক থেকে তারা এতটাই এগিয়ে গেছে যে, আরব রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত হামলাও ঠেকিয়ে দিতে পারে। আজ আলোচনা করবো তাদের সর্বাধুনিক ডিফেন্স সিস্টেম “কিপ্পাত বারজেল” তথা আয়রন ডোম নিয়ে। সম্প্রতি হামাস-ইসরাইল সংঘর্ষের ঘটনায় আয়রন ডোম অন্যতম প্রধান আলোচনার বিষয়বস্তুু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যিকার অর্থেই এটা একটা অদৃশ্য লৌহ গম্বুজের মত ইসরাইলকে হামাস, হিজবুল্লাহ সহ অন্যান্য শত্রুর রেঞ্জড এ্যাটাক থেকে রক্ষা করছে।

২০০৬ সালে লেবাননের (হিজবুল্লাহ-ইসরাইল) যুদ্ধের সময়, হিজবুল্লাহ ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ৪ হাজার রকেট নিক্ষেপ করে যার কারণে ৪৪ জন ইসরাইলি নিহত হয় এবং ২৫,০০০ এর মত ইসরাইলিকে ওই এলাকা থেকে সরে যেতে হয়। এছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের প্রতিনিয়ত  রকেট ও মর্টার হামলা ইসরাইলি জনজীবনকে আতঙ্কিত করে তোলে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসরাইল “আয়রন ডোম” প্রজেক্টের কথা ঘোষণা করে। “রাফায়েল এডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম ” এবং “আইডিএফ” এর সম্মিলিত প্রজেক্ট “আয়রন ডোম”।

এটি একটি স্বয়ংক্রিয় ‘গ্রাউন্ড টু এয়ার’ ডিফেন্স সিস্টেম, যা ইসরাইলের দিকে ধেয়ে আসা যেকোনো ধরণের ব্যালাস্টিক মিসাইল, আর্টিলারি বা মর্টার শেল কে আকাশে থাকা অবস্হায় ধ্বংস করে দিতে পারে। যে কোনো আবহাওয়ায় এটি কাজ করে। ২০১১ সাল থেকে আয়রন ডোম ডিফেন্স সিস্টেম কার্যকর করা হয়।

রাফায়েলের দাবী অনুযায়ী, তখন থেকে এ পর্যন্ত ২,০০০ এর বেশি বিভিন্ন ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র (প্রধানত হামাস,হিজবুল্লার মিসাইল) ইন্টারসেপ্ট করে ৯০% এর বেশি সফলতা লাভ করেছে। যদিও আন্তর্জাতিক সামরিক বিশ্লেষকদের দাবি ৮০%। তবু,বলতে হয় এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল ডিফেন্স সিস্টেম।

আয়রন ডোম এর প্রধান তিনটি অংশ, সেন্সর, কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ইন্টারসেপ্টর

আয়রন ডোম এর প্রধান তিনটি অংশ হচ্ছে, সেন্সর, কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ইন্টারসেপ্টর (মূলত একটি মিসাইল যা ধেয়ে আসা মিসাইকে ধ্বংস করে)।

রাডার : এই সেন্সর সিস্টেম ধেয়ে আসা মিসাইল শনাক্ত করে।

কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম : মিসাইলটির গতিবিধি যাচাই করে এবং সেই অনুযায়ী, আয়রন ডোমের তৃতীয় অংশ চালু করে। মূলত এই অংশের কারণেই আয়রন ডোম ইউনিক। এর ডাটা প্রসেসিং বেশ দ্রুত এবং নিখুঁত হয়ে থাকে এবং এটি নিজ থেকেই বিচার করতে পারে ইনকামিং মিসাইল ক্রিটিক্যাল কোনো জায়গায় পড়বে কিনা। গুরুত্বপূর্ণ জায়গা না হলে সাধারণত এটি এক্টিভেট হয় না। এতে খরচ অনেকাংশে কম হয়।

ইন্টারসেপ্টর : ইন্টারসেপ্টর মানেই একটি মিসাইল যা ধেয়ে আসা মিসাইলটিকে আঘাত করে বা এর আশেপাশে বিষ্ফোরিত হয়ে ওই মিসাইলটি ধ্বংস করে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলে হামাসের রকেট হামলা। ছবি- এএফপি

আইরন ডোম কি ইসরাইলকে হামাস, হিজবুল্লাহর সব আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে? উত্তর খুঁজতে, হামাসের সাম্প্রতিক রকেট হামলার দিকে তাকাতে হবে। আয়রন ডোমের অন্যতম দূর্বলতা হচ্ছে এটি এক সাথে বেশি মিসাইল ইন্টারসেপ্ট করতে পারেনা (সংখ্যা অপ্রকাশিত)। ১০ মে থেকে এখন পর্যন্ত হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ প্রায় দুই হাজার মিসাইল নিক্ষেপ করেছে। যার মাঝে অনেক গুলো গাজার আকাশেই ধ্বংস হয়ে গেছে, যেগুলো তেল আবিবের আকাশে পৌঁছে তার বেশির ভাগ আয়রন ডোম ইন্টারসেপ্ট করেছে,কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এখন পর্যন্ত ৬ জন ইসরাইলি নিহত এবং ৭০ এর বেশি আহত হয়েছে। হামাস এই আশা নিয়ে রকেট ছোঁড়েনি যে সব গুলো টার্গেটে পৌঁছাবে,সুতরাং তাদের হামলা তাদের হিসেবে ব্যর্থ হয়নি। তার চেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আয়রন ডোম ব্যবহারের খরচ। ইতিমধ্যেই অনেক ইসরাইলি সামরিক বিশ্লেষক আয়রন ডোমের বিরোধিতা করেছেন কারণ এটি ব্যয়বহুল। হামাসের ছোঁড়া মিসাইল গুলোর বেশিরভাগই এ-১২০, যেগুলোর লাঞ্চার (৮ টিউব বিশিষ্ট) বড়জোড়  ৮০০ ডলার। অন্যদিকে আইরন ডোমের একেকটা লাঞ্চারে (২০ টি ইন্টারসেপ্টর মিসাইল) ইসরাইলের খরচ হয়  ৫০ হাজার ডলার। বলা বাহুল্য একটা শত্রুর মিসাইল ইন্টারসেপ্ট করতে একাধিক ইন্টারসেপ্টর লাগতে পারে। এই গতিতে হামাস এবং হিজবুল্লার আক্রমন চলতে থাকলে ইসরাইলি অর্থনীতি চাপে পড়ে যাবে,সেক্ষেত্রে তাদের হয়তো নতুন কোনো ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে হবে। তবে ইসরাইল শুধু মাত্র আয়রন ডোমই ব্যবহার করেনা। আগেই বলেছি, এটা শর্ট রেঞ্জড। তাই লং ও মিডিয়াম রেঞ্জ ডিফেন্সের জন্য আইরন ডোমের পাশাপাশি ‘ডেভিডস স্লিং এন্ড এরো’ নামে অন্য একটি ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করা থাকে।

এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের কথা আলোচনা করলে রাশান এস-৪০০ এর কথা না এসে পারেনা। স্বভাবতই সবাই দুটোর মাঝে তুলনা করতে চাইবে। রাশানদের দাবি এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উন্নত ডিফেন্স সিস্টেম,যদিও এর বাস্তব ব্যবহার এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। তবে ফিল্ড টেস্টিং এ এটা বেশ সফল। আয়রন ডোম এবং এস-৪০০ প্রাথমিক পার্থক্য হলো দুটো তৈরী হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কারণে। আয়রন ডোম হচ্ছে শর্ট রেন্জ ডিফেন্স সিস্টেম(৭০ কি.মি) যেটা ইসরাইল মূলত আরব মিলিশিয়াদের মিসাইল এটাক ঠেকাতে তৈরী করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রজেক্টে ইনভেস্ট করায়,সম্প্রতি তাদের কাছে দুটি ব্যাটারি বিক্রি করেছে ইসরায়েল। অন্যদিকে এস -৪০০ একটি বৃহত্তর প্রজেক্ট। রেঞ্জ হিসেবে এর বিভিন্ন ভার্সন আছে (সর্বোচ্চ ৪০০ কি.মি থেকে সর্বনিম্ন ৪০ কি.মি)। রাশিয়া এটা তৈরী করেছে মূলত ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যেই তুরস্ক,চীন,সৌদি আরব,ভারত ও বেলারুশ এস-৪০০ প্রতিরক্ষা সিস্টেম ক্রয় করেছে।

লেখক- এহসানুল মাহবুব জুবায়ের

শিক্ষার্থী, পিস এন্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: ক্যম্পাস জার্নাল