Type to search

জমিদারি প্রথা- একটি দুঃখজনক ভুল

সাহিত্য

জমিদারি প্রথা- একটি দুঃখজনক ভুল

১৬ই মে, ২০২১ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা বিলোপের ৭০ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৫১ সালের এই দিনে প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে কৃষক পুনরায় তার অধিকার ফিরে পায়। জমিদারি প্রথা এই অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি দুঃখজনক ভুল ছিলো। জমিদারি প্রথার ফলে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে বিপর্যয় এসেছিলো-

জমিদারি প্রথার প্রবর্তন

সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর বাংলার মসনদে মূলত ইংরেজদের মদদপুষ্ট শাসকরা বসে। তাদের অপরিণামদর্শী শাসনের ফলে বাংলায় সরাসরি ইংরেজ প্রতিনিধিরা আসতে শুরু করে গভর্নর জেনারেল রুপে। এরূপ দ্বৈত শাসনে বাংলার অর্থনীতি দ্রুতগতিতে ভেঙ্গে পড়তে থাকে। সারা দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৭৭০ সালে সারা দেশ জুড়ে ভয়াবহ মন্বন্তর শুরু হয় যা “ছিয়াত্তরের মন্বন্তর” (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) নামে পরিচিত।

এর পর এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পাঁচশালা বন্দোবস্থের প্রবর্তন করে ওয়ারেন হেস্টিং। হেস্টিংএর প্রবর্তনকৃত এই বন্দোবস্ত ব্যাপক ভাবে ব্যর্থ হয়। খাজনা দিতে না পেরে রায়তরা জমি ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। এরপর নিয়ে আসা হয় একশালা বন্দোবস্ত। এ সময় মূলত জমির দখল পেতো হিন্দু ব্রিটিশপ্রিয় পরিবারগুলো, অপরদিকে শোষিত হতে শুরু করে সাধারণ মুসলমান কৃষকরা। পরবর্তীতে এরই রেশ ধরে কলকাতা ভিত্তিক শোষকশ্রেণী তৈরি হয়।

পাঁচশালা ও একশালা বন্দোবস্ত ব্যর্থ হওয়ার পর গভর্নর জেনারেল হিসেবে এদেশে আসেন লর্ড কর্নওয়ালিশ, তিনি ইংল্যান্ডের জমিদার পরিবার থেকে এসেছিলেন। তিনি অনুভব করেন রাজস্ব আদায় ঠিক রেখে ব্রিটিশ অনুগত সম্প্রদায় তৈরির জন্য জমিদার প্রথা এদেশে আনতে হবে। ১৭৯০ সালে তিনি দশসালা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন যা ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিবর্তিত হয়।

জমির মালিকানা চলে যায় ইংরেজদের অনুগত, বশংদ গোষ্ঠীর হাতে, যারা “জমিদার” বলে সম্বোধিত হতো। এভাবে ইংরেজরা তাদের এদেশীয় দোসর তৈরি করে যারা উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে খুব বড় ভূমিকা রেখেছে।

 

জমিদারি প্রথার রাজস্ব ব্যবস্থা

জমিদারি গুলো অর্থের বিনিময়ে ইজারা দেয়া হতো। সময় মত কোম্পানিকে খাজনা প্রদানের মাধ্যমে বংশানুক্রমে জমিদাররা সেগুলো ভোগ করতে পারতো। কৃষকদের তাদের উৎপাদনের ৪৫% খাজনা হিসেবে জমিদারকে জমা দিতে হতো। আর জমিদারের আদায়কৃত সম্পূর্ণ খাজনার ৯০% রাজস্ব হিসেবে কোম্পানির কোষাগারে যেতো। যদি নির্দিষ্ট দিনের সূর্যাস্তের আগে কোন জমিদার তার খাজনা জমা দিতে ব্যর্থ হতো তার জমিদারি নিলাম করে অন্য কারো হাতে দিয়ে দেয়া হতো। ওই সময় এই আইনের কারণে জমিদারি গুলো প্রচুর হাতবদল হতো।

জমিদারি প্রথার ফলে বাংলার দুর্ভোগ

জমিদারি প্রথার ফলে বাংলায় বুর্জোয়া শ্রেনী তৈরি হয়। এক শ্রেনী অন্য শ্রেনীর প্রভূতে রুপান্তরীত হয়। জমিদাররা অধিকাংশ সময় কৃষকের থেকে বেশি খাজনা আদায় করত, এ সময় কৃষকরা ,যারা এক সময় জমির মালিক ছিলেন তারা দুঃখজনক ভাবে ভূমিদাসে পরিণত হোন। বেশিরভাগ জমিদার তার জমিদারি ও খাজনা আদায় পত্রের দায়িত্ব নায়েব-গোমস্তার হাতে ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় বিলাসী জীবনযাপনে মেতে থাকত। ফলে জবাদিহিতা ও অভিভাবকত্বের অভাবে সাধারণ মানুষের জীবন দূর্বিষহ হয়ে যায়। নায়েব-গোমস্তারা ইচ্ছামত অত্যাচার চালাতো কৃষকের ওপর। দেশীয় শিল্পগুলো এ সময় ভেঙ্গে পড়ে, অর্থনীতির মেরুদণ্ড গুড়িয়ে যায়।

এ সময় দেশজুড়ে বিদ্রোহ-আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৫৯-৬১ সালে নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এ ছাড়া ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজি শরিয়তউল্লাহ, তার পুত্র দুদুমিয়া ও বাঁশের কেল্লার প্রতিষ্ঠাকারী মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীরের মত মুক্তিকামী ব্যক্তিরাও জমিদারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় লাঠি ধরেছেন। ওই সময় সাধারণ মানুষের জীবন কতটা ভয়ানক ছিল তার কিছুটা জানা যায় মীর মশাররফ হোসেনের বিয়োগান্তক নাটক জমিদার দর্পণ ও দীনবন্ধু মিত্রের নাটক নীলদর্পণ থেকে। এমনকি এই নাটক দুটোও তৎকালীন জমিদারদের ব্যপক বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েছে।

 

প্রজাস্বত্ব আইন ও জমিদারি প্রথা বিলোপ

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের পতনের পর ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ পুর্ব পাকিস্থানের পার্লামেন্টে প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ নামে বিল পেশ করা হয়। অবশেষে ১৯৫১ সালের ১৬ই মে এই বিল পাশ হয়, যার মাধ্যমে সুদীর্ঘ দেড়শ বছরের কালো জমিদারি প্রথার অবসান ঘটে। এখানে উল্লেখ্য, কিছু কিছু গ্রামে তখনও জমিদারী প্রথা চালু ছিল যা ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার বিলোপ করে, যুক্তফ্রন্ট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল এটি।

প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলোপ করা হয়। সমস্ত জমি রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করে। এর ফলে জমির ওপর কৃষকের অধিকার নিশ্চিত হয়। প্রজাস্বত্ব আইন সাধারণ মানুষের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিজয়, যা অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিয়েছে।

লেখক-নুসরাত তাবাসসুম,

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়