Type to search

‘সেকুলারিজম’ অর্থ ও প্রয়োগ : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

সাহিত্য

‘সেকুলারিজম’ অর্থ ও প্রয়োগ : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

-বিলাল হোসেন মাহিনী

বাংলা একাডেমির ইংলিশ-বাংলা অভিধানের ২০১২ সালের সংস্করণে সেক্যুলার অর্থ করা হয়েছে- পার্থিব, ইহজাগতিকতা, জাগতিক, ইত্যাদি। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকা, উইকিপিডিয়া, অক্সফোর্ড ইংরেজী-উর্দু ডিকশনারী সবখানে এর অর্থ করা হয়েছে- ‘ধর্মহীনতা’। তবে কোনো কোনো অভিধানে ‘সেক্যুলারিজম’ অর্থ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। আমাদের দেশে ‘সেক্যুলারিজম’ বলতে সাধারণত এই শেষ অর্থ ধরা হয়ে থাকে। এবং সেভাবে প্রয়োগ হয়ে থাকে রাষ্ট্র ও সমাজে।  সেক্যুলারিজম আদর্শের মূলকথা হলো, যে কোনো ধর্ম পালনে রাষ্ট্র কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না করে বরং ধর্মহীন থাকবে। কিন্তু আধুনিক সময়ে ভারত, নেপাল ও আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের প্রয়োগিক নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে এভাবে যে, ‘রাষ্ট্র সকল ধর্মকে সমান গুরুত্ব দেবে’ অথবা ধর্ম বিশ্বাস বা পালনে বাধা দিবে না, উপরন্তু; দেশের সব ধর্মকে সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান করবে। ‘সেক্যুলারিজমের অর্থ যদি প্রচলিত ধর্মনিরপেক্ষতা করা হয়, তবে তা ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়ে বরং সামঞ্জস্য হবে।

‘সেকুলারিজম” শব্দটি ১৮৫১ সালে ব্রিটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব ইলিয়ক (১৮১৭-১৯০৪) প্রথম ব্যবহার করেন। জর্জ জ্যাকব ধর্মের কোনো রকম সমালোচনা ছাড়া, সমাজে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য তার এই ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা প্রকাশ করেন। মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে মুস্তফা কামাল পাশা আতাতুর্ক ১৯ শতকের শুরুতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই মতবাদ অনুযায়ী, সরকার কোনরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না এবং কোন ধর্মকে কোন প্রকার অতিরিক্ত সুবিধাও প্রদান করবে না। কাউকে ধর্ম পালনে নিষেধ বা বাধ্য করাও হবে না । তবে,সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে “ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার”।

এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকায় সেক্যুলারিজম তথা নাস্তিকতাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে: ১. তাত্ত্বিক নাস্তিকতা ২. ব্যবহারিক নাস্তিকতা । ‘বিশ্বকোষ’ সেক্যুলারিজমকে দ্বিতীয় প্রকার নাস্তিকতার অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখন কেউ যদি সেক্যুলারিজম অর্থ ‘ধর্মহীনতা’ বা ‘নাস্তিকতা’-কে গ্রহণ করে সে আর মুসলিম থাকতে পারে না। কেননা, মুসলিম কখনো ধর্মহীন বা নাস্তিক হতে পারে না। তবে সেকুলারিজম মানে যদি ‘সকল ধর্ম’র প্রতি সমান ‘শ্রদ্ধা’ বা সমান ‘অধিকার’ বুঝানো হয় তবে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু, আজকাল কেউ কেউ সেকুলারিজম বলতে ধর্মহীনতা বা নাস্তিকতাকে বুঝে থাকেন। আবার নিজেকে ‘মুসলিম’ বা ‘হিন্দু’ বা ধর্মবিশ্বাসী বলেও দাবি করেন। যেটা ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক।

আবার সংবিধান অনুসারে আমরা (বাংলাদেশি) সবাই সেক্যুলার অর্থাৎ ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। কারণ স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচিত হয়েছে তাতে রাষ্ট্রের মৌলিক চার নীতির মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে স্থান দেওয়া হয়েছে। এরপর সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে এ নীতিটি বাদ দিয়ে তদস্থলে আনা হয়েছিল ‘মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’। কিন্তু তিন দশক পর আবারো বর্তমান সরকার ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছে। সুতরাং সংবিধান বলে আমরা সবাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ তবে এই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র অর্থ ‘ধর্মহীনতা’ নয়। সে কারণেই বোধ হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শত শত মডেল মসজিদ প্রতিষ্ঠা করছেন। আবার অন্যান্য ধর্মেরও পৃষ্ঠপোষকতা করছে রাষ্ট্র। যদিও স্বাধীনতারে ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সমাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

বঙ্গবন্ধু ও কবি নজরুল দু’জনই ছিলেন সেকুলার (ধর্মনিরপেক্ষ); আবার ধর্মের আরাধনা ও সেবাও করেছেন। একজন প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ অপরজন হিন্দু-মুসলিম উভয় সাহিত্য-সংস্কৃতিতে দিয়েছেন অফুরণ রসদ। তাঁদের কাছে সেকুলারিজম তথা ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ কখনোই ‘ধর্মহীনতা’ ছিল না। আর আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে যে সেকুলারিজম আছে, তার অর্থও ‘ধর্মহীনতা’ নয় বরং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। তা না হলে নজরুল কেনো লিখবেন, ‘এক আল্লাহ জিন্দাবাদ’ ‘উমর ফারুক’ ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে…সহ অসংখ্য ধর্মীয় গান-কবিতা-প্রবন্ধ? একটি ধর্মনিরপেক্ষ দলের প্রধান ও সরকার প্রধান হয়েও কেনো শতাধিক মডেল মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে যাবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? এখান থেকে প্রমাণ হয়, সেক্যুলারিজম বলতে ‘ধর্মহীনতা’ নয় বরং আমাদের দেশে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কেই বোঝানো হয়।

বঙ্গবন্ধু বহুবার নবীজির (সা.) ইসলামের উদাহরণ দিয়েছেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে বেতার ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য লেবাসসর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ‘ইনসাফের ইসলামে’। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। যদি কেউ বলে (সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা এনে) ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি (শেখ মুজিব) বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে’।

সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অর্থ ‘ধর্মহীনতা’ করে কোনো কোনো প্রগতিশীল বাঙালি (বাংলাদেশি) অনর্থক বিতর্কের ধোঁয়া তোলার চেষ্টা করেন মাঝে মাঝে। আবার এক শ্রেণির মৌলবি এটিকে কুফরি মতবাদ বলে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট উস্কে দেয়। অন্যদিকে মধ্যপন্থী সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ এটিকে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় পরিভাষার মতোই দেখছেন।

অনেকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেকুলারিজমের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। তারা দাবি করেন, এটি ধর্মবিরোধী পরিভাষা। মূলত বিদ্যমান সব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে ন্যায়বিচার ও সমতা বিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সব ধর্মের সহাবস্থান ও সমঅধিকারের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতা কুফরি মতবাদ নয় বরং ইসলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করেন ইসলামি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও স্কলারগণ।

ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট’র প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ধর্মতত্ত্ববিদ ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘ধর্ম নিরপেক্ষতার দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত সব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও বৈষম্যহীন নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত ধর্মকে সব রাষ্ট্রীয় কর্মকা- থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ন্যায়বিচার, প্রশাসন, অর্থ ও রাষ্ট্রসংশ্লিষ্ট ধর্মীয় বিধানগুলো বাতিল, অচল বা প্রয়োগ অযোগ্য বলে বিশ্বাস করা (অর্থাৎ ধর্মহীন নাস্তিক্যবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা। প্রথম বিষয়টি ইসলাম নির্দেশিত ও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য ও দ্বিতীয় বিষয়টি ইসলামি বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তথা কুফরি।’ (গ্রন্থ : ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ)।

কুরআন ও হাদীসের অনুসৃত নীতি অনুযায়ী, একটি ইসলামি রাষ্ট্রে অন্য ধর্মের মানুষেরা মায়ের কোলে সন্তান যেমন ঘুমায় ঠিক এরকম নিরাপত্তা ও আস্থার মধ্যে তাদেরকে অর্থাৎ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের রাখতে হবে। সেক্যুলারিজম আদর্শের মূল কথা হলো, সকল ধর্ম পালনে রাষ্ট্র কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না করে বরং ধর্মহীন থাকবে। কিন্তু আধুনিক সময়ে ভারতে বা নেপালে এমনকি আমাদের বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের এই আদর্শকে অনুসরণ না করে বরং নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে এভাবে যে, রাষ্ট্র সকল ধর্মকে সমান গুরুত্ব দেবে। এই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামের সাথে সংঘর্ষিক নয়।

তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলারিজম কিন্তু ধর্মহীনতাই ছিলো, যে কারণে তিনি আজান ও নামাজ নিষিদ্ধ করেছিলেন। পরে, এরদোয়ান এসে আমাদের দেশের মতো এর নতুন ব্যাখ্যা দাঁড়  করান যে, সেক্যুলারিজম হলো সব ধর্মের সমান অধিকার। ইসলাম নিজেই সবধর্মের অধিকার রক্ষার কথা বলে অর্থাৎ এখন যে বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, সেটা ইসলামেরও বক্তব্য। মদিনায় গড়ে ওঠা নবীজি (সা.)-এর রাষ্ট্রে সব ধর্মের সমান অধিকার বিরাজমান ছিল। মদিনা সনদের মাধ্যমে নবীজি (সা.) বিশ্বের বুকে ধর্মীয় নিরপেক্ষতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন। এ সনদে মদিনায় বসবাসরত সব ধর্মীয় জাতি-গোষ্ঠীকে একই (আরব)জাতিভুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

মদিনায় বসবাসরত সব ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পালনে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। বিশুদ্ধ সিরাত গ্রন্থ সিরাতে ইবনে হিশামের ২য় খ-ের ১৭৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত মদিনা সনদের ২৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘বনু আওফের ইহুদিরা মুমিনদের সঙ্গে একই উম্মত(জাতি)রূপে গণ্য হবে। ইহুদিদের তথা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য তাদের ধর্ম, মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম।’ এ নীতিমূলত পবিত্র কুরআনের সূরা কাফিরুনের শেষ আয়াত থেকে নেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়া দিন।’ অর্থ- তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম, আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম।’

রাষ্ট্রঘোষিত ‘ধর্মরিপেক্ষ’ মতবাদ কখনোই ইসলামবিরোধী নয়। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘ইউরোপীয়রা ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে যা বুঝায় তা আমি মানি না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। তাই আসুন, আমি সেকুলার এমন ভাব নিয়ে নিজেকে ‘ধর্মহীন’ না করে ফেলি। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি নিজেকে ‘সেকুলার’ বলতে ‘ধর্মহীন’ বা ‘নিধর্মী’ ভাবতে চান, তবে তিনি যেনো লুকোচুরি না করে স্পষ্ট-ই তা যাহির করেন। ধন্যবাদ।

বিলাল হোসেন মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র,
সাহিত্য সম্পাদক : বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক সোসাইটি, কেন্দ্রীয় কমিটি,
প্রকাশনা সম্পাদক : বাংলাদেশ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, অভয়নগর, যশোর।