এরশাদ শিকদারের রাজ সাক্ষী নূরে আলম মুক্তি পাচ্ছে
অপরাজেয় বাংলা ডেক্স- এরশাদ শিকদারের অসংখ্য খুনের সাক্ষী তার দেহরক্ষী নুর আলম (নূরে আলম) কারাগার থেকে শিঘ্র মুক্তি পাচ্ছেন।
এরশাদ শিকদারের ১২টি হত্যা মামলার রাজসাক্ষী নুর আলম ২০ বছর ধরে কারাগারে অন্তরীণ। এখন আদালত তাকে মুক্তি দিতে যাচ্ছে। গতকাল সোমবার ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ শেখ হাফিজুর রহমান অন্য কোনো মামলা না থাকলে নুর আলমকে কারাগার থেকে মুক্তির আদেশ দিয়েছেন। নুর আলম চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ থানার আজিমপুর গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কারাগারে অন্তরীণ।
এরশাদ শিকারের ১২টি হত্যা মামলায় তার হত্যার সহযোগী আসামি ছিলেন নুর আলম। পরে তিনি মামলাগুলোয় রাজসাক্ষী হন এবং আদালতে এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। তার সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে খুলনার জলিল টাওয়ার মালিকের ম্যানেজার খালিদ হত্যা মামলায় এরশাদ শিকদারের ফাঁসির আদেশ হয়। ওই মামলায় ২০০৪ সালের ১০ এপ্রিল মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এভাবে একে একে ১১টি মামলায় নুর আলম রাজসাক্ষী হিসেবে কারাগারে থেকেই এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। বাকি ছিল রাজধানীর লালবাগ থানার আজিজ অপহরণপূর্বক হত্যা মামলার সাক্ষ্য। পুরান মামলা হিসেবে গত বছর ৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট মামলাটি চার মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দেন। ওই মামলায় গত ৩ জুলাই মুক্তির আদেশ আদালতে আসে। সেই প্রেক্ষিতে গত ২১ জুলাই নুর আলমকে খুলনা কারাগার থেকে হাজির করে রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
আর গতকাল সোমবার মামলাটির ধার্য তারিখে ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস থেকে আইনজীবী মুনতাছির মাহমুদ রহমান কারামুক্তির আবেদন করেন। বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান আবেদন মঞ্জুর করে কারামুক্তির আদেশ দেন। শুনানিকালে নুর আলমকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। পরে তাকে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে নেওয়া হয়। সেখানে ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার সিনিয়র সহকারী জজ মো. আলমগীর হোসাইন তার সঙ্গে কথা বলেন।
আলমগীর হোসাইন জানান, নুর আলম রাজসাক্ষী হয়ে ২০ বছর ধরে জেলে আছেন জানার পর তাদের অফিসের মাধ্যমে জামিন করিয়েছেন। খুলনার একটি মামলায় তার প্রডাকশন ওয়ারেন্ট দেওয়া আছে বলে জানতে পেরেছেন। সেখানকার আইনজীবীর সঙ্গেও কথা হয়েছে। ওই প্রডাকশন ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার হলেই তিনি কারামুক্ত হবেন বলে আশা এ আইনজীবীর।
এদিকে লিগ্যাল এইড অফিসে নুর আলম আমাদের সময়কে বলেন, তিনি ১২টি হত্যা মামলার রাজসাক্ষী। ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কারাগারে আছেন। কারাগারে থাকাবস্থায় তার ১৮ বছর বয়সী ছেলে রাফী মারা গেছে। স্ত্রী অভাব-অনটনে অন্যের স্ত্রী হয়ে গেছে। বাড়িঘর জমিজমা এখন কিছুই নেই। মুক্তি পেলে কোথায় যাবেন জানেন না। প্রথম জীবনে জাহাজে চাকরি করতেন। সেই চাকরি ছেড়ে এরশাদ শিকদারের দেহরক্ষী হিসেবে যোগ দেন বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার পিতার নাম বন্দে আলী। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি তার জন্মস্থান নলছিটি থেকে খুলনায় চলে আসেন। আসার পর কিছুদিন রেলস্টেশনের কুলির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করত- এমন দলে যোগ দেন। পরে তিনি তাদের নিয়ে নিজেই একটি দল গঠন করেন এবং এলাকায় রাঙ্গা চোরা নামে পরিচিতি পান। ১৯৭৬-৭৭ সালে এরশাদ শিকদার রামদা বাহিনী নামে একটি দল গঠন করেন। যারা খুলনা রেলস্টেশন ও ৪ নম্বর ঘাট এলাকায় চুরি-ডাকাতি ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়। এই রামদা বাহিনী নিয়েই এরশাদ ১৯৮২ সালে ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দখল করেন এবং এর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৮২ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর তিনি জাতীয় পার্টিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করার পর এরশাদ শিকদার বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর এরশাদ শিকদার আবারও দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু সমালোচনার মুখে কিছুদিন পরই আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৯৯ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার সময়ও এরশাদ শিকদার ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন। রাজনীতিতে প্রবেশ করার পর এরশাদ আরও ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত খুলনার রেলওয়ের সম্পত্তি এবং জোরপূর্বক ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকা-ে লিপ্ত হন। ৬০টিরও বেশি হত্যাকা-ে জড়িত ছিলেন এরশাদ শিকদার। বডিগার্ড নুর আলম ২৪টি হত্যাকা-ের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন। নুর আলমের জবানবন্দি অনুযায়ী এরশাদ শিকদারের ৭০টিরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। স্বর্ণকমল নামে খ্যাত বাড়ি থেকে মাত্র একটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে ৪৩টি মামলা রুজু হয়। নিম্নআদালতের বিচারে সাতটি হত্যা মামলায় তার ফাঁসির দ-াদেশ হয় এবং চারটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়।