Type to search

গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিভাজন কাম্য নয়

জাতীয়

গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিভাজন কাম্য নয়

বিলাল হোসেন মাহিনী
সংবাদমাধ্যম সমাজ ও রাষ্ট্রের দর্পণ। তাছাড়া গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়ে থাকে। একবিংশ শতাব্দিতে এসে গণমাধ্যমের ঐক্য ও একে অপরের প্রতি সহনুভূতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের মতো গণমাধ্যম কর্মীরা শতধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। যার ফলে আমাদের মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনৈক্য ও অস্থিরতা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। আজকের নিবন্ধে আমাদের সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া জগতের আদর্শিক বিরোধ ও সংকীর্ণতা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার প্রয়াস পাবো।
 আমাদের বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরনো। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন বলতে আমরা বাংলা গান, নৃত্য, গল্প-উপন্যাস-কবিতা, নাটক-সিনেমা ইত্যাদি বুঝে থাকি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো- এগুলো (নাটক-গান-গল্প) আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ মাত্র। সাহিত্য ও সাংাবাদিকতাও আমাদের সংস্কৃতির অংশ। শুধু তাই নয়, বাঙালি সংস্কৃতিতে নানা বৈচিত্র পরিলক্ষিত হয়। এখানে মুসলিম কালচার যেমনি দেখা যায় তেমনি অন্যান্য ধর্ম বিশেষত হিন্দু সংস্কৃতির দেখাও মেলে ঢের! মূলত: বাংলাদেশি মানুষের তথা বাঙালির যা কিছু নিত্যদিন তাদের জীবনাচরণে দৃশ্যমান হয় তাই বাঙালি সংস্কৃতি। আর সংস্কৃতির দৃশ্যমান রূপটিই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দেখা মেলে।
এখন প্রশ্ন হলো- এই সাংস্কৃতিক পরিবেশনা (অডিও-ভিডিও-মঞ্চ) কতটুকু রুচিসম্মত তা নির্ধারণ করবে কে? সাংস্কৃতিক কর্মী নাকি দর্শক? যদি দর্শককে নাটক-সিনেমা বা শর্টফ্লিম-এর মান নির্ধারক বলে ধরা হয় তবে দেখা যাবে খুব অল্প সংখ্যক সিনেমা- যেগুলো জাতীয় বা আর্ন্তজাতিক পুরষ্কার লাভ করে তার বোধহয় বেশিরভাগই দর্শক ভিউতে পুরষ্কার লাভের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কেননা, বাঙালি দর্শক যারা মিউজিক ভিডিও, নাটক-মুভি দেখেন, তারা বেশিরভাগই অর্ধ-শিক্ষিত বা অশিক্ষিত! তবে তাদের দৃষ্টিতে হিরো আলমের মতো রোমান্টিক ও কমেডিয়ান নির্মাতার নির্মানগুলোই বেশি লাইক-ভিউ-শেয়ার পাবে, এটাই স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে যদি শিক্ষিত, মার্জিত, সাহিত্যানুরাগী, শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানসম্পন্ন এবং সাংবাদিকতা, টিভি-মিডিয়া, ড্রামা-ফ্লিম সমন্ধে সাম্যক ধারণা রাখেন এমন ব্যক্তিবর্গকে রুচির নির্ধারক হিসেবে বেছে নেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে; লক্ষ-কোটি ভিউ পাওয়া ঐসব কমেডি, শর্টফ্লিম বা মিউজিক ভিডিওগুলো বাঙালির ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ক্লাসিক কালচারাল ভিউতে বস্তাপচা ভাগাড়ে নির্মান বলে গণ্য হবে।
তবে এটা সত্য ও বাস্তব যে, আমাদের সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক বৈভবের যা কিছু উচ্চসিত এবং সর্বব্যাপী সৃজনশীলতায় নিয়ত বিকশিত তার সবই দেশের গরিব মানুষের নির্মাণ-বিনির্মাণ। আর এর প্রাণভোমরা দেশের গরিব নিম্নবর্গের জনরুচি। যেমন ধরুন, ‘বেদের মেয়ে জোস্না’ সিনেমা। এই সিনেমা আজও পর্যন্ত বাংলার সর্বোচ্চ ব্যবসা সফল ছবি। কিন্তু কেন? সিনেমা ও সংস্কৃতিপ্রেমীরা মনে করেন, এর প্রধান কারণ- সিনেমাটি বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের জীবনাচরণকে ছুঁতে পেরেছে। আর গ্রামীণ সাধারণ মানুষ সিনেমাটিকে বার বার দেখেছে, হৃদয়ে ধারণ করেছে। ঠিক তেমনিভাবে এদেশের সভ্যতায় মসজিদ-মন্দির সবখানে এই সাধারণ মানুষের অবদান সবচে’ বেশি। নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ কিংবা দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের নির্মাণশৈলী ডাকসাইটে প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা কোনো স্থপতির নয়, একেবারেই প্রামীণ মেহনতি শ্রমিক-মজদুরের। দুনিয়া কাঁপানো জামদানি কিংবা পাহাড়ের বেইন তাঁতের নকশা ও বুননের কারিগর কারা? নাটোরের কাঁচাগোল্লা কিংবা মুক্তাগাছার মন্ডা, টেপাপুতুল, শখের হাঁড়ি, শোলাশিল্প, কাঁসাশিল্প, মুখোশ, নকশি কাঁথা, দারুশিল্প, রিকশাচিত্র, খেলনা, সরাচিত্র, আলপনা কিংবা তীর-ধনুকের কারিগররা সমাজের কোনো ধনী বিত্তবান প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ছিলেন না। সমাজ কী রাষ্ট্র এসব নির্মাণের জন্য ঘটা করে কোনো আয়োজনও জারি রাখেনি কখনো। সর্বকালে গরিব নিম্নবর্গই বিকশিত করেছে জনরুচি ও জনসংস্কৃতির ময়দান।
এখন রুচির কথা উঠছে। আগে এসব ছিল না। এতো তর্ক-বাহাস হতো না। মানুষ ছিল সাদাসিদে। এটা ঠিক গ্রামীণ সভ্যতাগুলো নিঃসন্দেহে সৃষ্টিশীল গবেষক, চিত্রনির্মাতা, নাট্যকার, শিল্পী, কলাকুশলিরা তুলে ধরেন ভার্চুয়াল পর্দায়। সেখানে শ্রদ্ধেয় মামুনুর রশীদ স্যারের অসামান্য অবদান রয়েছে বটে। তারেক মাসুদ, চাষী নজরুল থেকে শুরু করে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলসহ অসংখ্য গুণী ও সৃজনশীল মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম আর রক্ত-ঘামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের বাংলা ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু তাই বলে, রুচির প্রশ্ন তুলে ছোট-বড় কোনো নির্মাতাকে হেয় করা বা ত্চ্ছু-তাচ্ছিল্য করা কতোটা উঁচু হৃদের পরিচয় তা সভ্যতার নির্মাতারাই ঢের ভালো বলতে পারবেন।
রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম, জালাল কিংবা রমেশ শীল ধনী ছিলেন না, কিন্তু কোনো দিন তারা নিজেদের ‘গরিবত্বকে’ সৃজনশীলতা বিকাশের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেননি। কিন্তু ‘আলোচিত’ হিরো আলম এটাই বারবার করছেন। নিজেকে গরিব, অর্থ-বিত্ত-চেহারা নেই বলে প্রচলিত ক্ষমতাকাঠামো তার ‘সৃষ্টিশীলতাকে’ গুরুত্ব দেয় না বলে বারবার নানাভাবে তুলে ধরেছেন। এমনকি এও বলছেন, তিনি যা আয় করেন তা দিয়ে ‘এরচেয়ে রুচিশীল’ কিছু তৈরি কঠিন।’ রুচিশীলতার কোনো মাত্রা, মাপ, পরিধি বা গন্ডি আছে কী? আমরা অযথাই এখানে ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীনের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব নিয়ে টানাটানি করছি। কিন্তু বারবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য নিজের বানানো ‘কনটেন্টকে’ তিনি একজন ‘গরিব মানুষের’ সৃষ্টিশীলতা হিসেবে দাঁড় করানোর কথা বলছেন। যা দেশের মেহনতি গরিব নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক সৃজনশীলতা ও বিকশিত জনরুচির প্রতি অসম্মান এবং মিথ্যাচার। যাত্রাপালা, জারি, গীতিকা কিংবা গাজী-কালুর উপাখ্যান সবই এই গরিব মানুষের সৃষ্টি। এগুলো গরিব মানুষের সৃষ্টি বলে সমাজ এগুলেকে ছুড়ে ফেলেনি কখনো। বরং এগুলো বাঙালি সংস্কৃতিকে উচ্চতার শিখরে নিয়ে গেছে।

আবার বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে গণমাধ্যম অন্যন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। আজকাল সেখানেও দ্বন্দ্ব। বিভক্তি ও দলাদলি। আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন বহু আগেই শতধা বিভক্ত করেছি। এখন সংবাদ মাধ্যমও বিভক্ত। সংবাদপত্র ও মিডিয়া বিশেষত: টিভি মিডিয়া তথা আধুনিক অনলাইন প্লাটফর্ম হলো সমাজের দর্পন স্বরূপ। সেখানেও বিভক্তি। এই রেষারেষির কবলে পড়ে ‘আমার দেশ’ ‘চ্যানেল ওয়ান’সহ বহু মিডিয়া আজ বন্ধ। অন্যদিকে ‘আইসিটি এ্যক্ট’ তথা ‘অনলাইন সিকিউরিটি এ্যক্ট’ স্বাধীন সাংবাদিকতাকে সংকুচিত করছে বলে মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। সম্প্রতি জাতীয় দৈনিক ‘প্রথম আলো’ নিয়ে শুরু হয়েছে হৈচৈ। প্রথম আলো আমাদের ভাষা আন্দোলন, ৬০ ও ৭০ দশকের আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য ভূমিকা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসহ যা কিছু বাংলাদেশের পক্ষে, তার প্রতি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ সব সাফল্যকে অনেকে বেশি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরে নিয়মিত। তারপরও মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার বিজয়ীসহ এক শ্রেণির মানুষ তাদের ব্যক্তি স্বার্থে উক্ত পত্রিকার (প্রথম আলো) লাইসেন্স বাতিলের দাবি করেছেন। যা অত্যন্ত হিংসাত্মক ও বিদ্বেষ প্রসূত বলে মনে করছেন মিডিয়া সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল। আমাদের সভ্যতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংবাদ মাধ্যম স্বাধীন ও সুচারুরূপে বিকশিত হোক। অন্তত সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সংবাদমাধ্যম দলীয় বৃত্তের বাইরে বাঙালির হয়ে উঠুক। এই প্রত্যাশায় শেষ করছি।