Type to search

উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র কমরেড আবদুল হক-এর ২৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী অভয়নগর থানায় পালিত 

অভয়নগর

উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র কমরেড আবদুল হক-এর ২৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী অভয়নগর থানায় পালিত 

আজ ২২ ডিসেম্বর’২২ সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ আমলা দালালপুঁজি বিরোধী সংগ্রামের অগ্রসেনানী, সকল রূপের সংশোধনবাদ-সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা কমরেড আবদুল হক-এর ২৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট অভয়নগর থানা কমিটির উদ্যোগে নওয়াপাড়া নৌ-যান কার্যালয়ে বিকাল সাড়ে ৪ টায় সংগঠনের থানা সভাপতি মনিরুল ইসলাম বাবুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের যশোর জেলা ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আশুতোষ বিশ্বাস। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের অভয়নগর থানা সহ-সভাপতি ও কৃষক সংগ্রাম সমিতি থানা সভাপতি আবু বক্কার সরদার,  সহ-সম্পাদক এম আর টিটু, নাজমুল হুসাইন, প্রচার সম্পাদক নাজিম উদ্দিন শেখ, যুব বিষয়ক সম্পাদক আল মামুন শেখ, দপ্তর সম্পাদক নিয়ামুল হক রিকো,  বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি অভয়নগর থানা কমিটির সহ-সভাপতি জহির সরদার,  সাধারণ সম্পাদক সেলিম জমাদ্দার, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সিদ্দিক, মনিরামপুর থানা কমিটির সভাপতি পরিতোষ দেবনাথ, জাতীয় ছাত্রদল খুলনা জেলা যুগ্ম-আহ্বায়ক দিলিপ বিশ্বাস, যশোর জেলা যুগ্ম-আহ্বায়ক নাইস হাসান কাশেম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভাটি পরিচালনা করেন সংগঠনের থানা সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম। নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা এমন একটা সময় মহান কমরেড আবদুল হক-এর ২৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছি যখন সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্হায় এক গভীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক সংকটের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। চলমান বিশ্ব মন্দা, আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, তীব্রতর শোষণ-লুন্ঠন, সন্ত্রাস, দুর্ভিক্ষ ও বেকারত্বের জন্য দায়ী পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্হা। এ বিশ্ব ব্যবস্হার অংশ ও অধীন হওয়ায় দেশের  শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ  আজ দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় আজ প্রয়োজন মহান কমরেড আবদুল হক-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আত্মস্বার্থ ত্যাগ করে শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের  জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংবিধান ও সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
কমরেড আবদুল হক-এর জীবনচিত্র
কমরেড আবদুল হক ১৯২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর যশোর জেলার সদর থানার খড়কিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম: শাহ মুহম্মদ আবুল খায়ের, মায়ের নাম: আমেনা খাতুন। আবদুল হক ছিলেন সাম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। অথচ সেই সাম্ভ্রান্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই তিনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন। জনগণের মুক্তির জন্য শ্রেণীচ্যুত হতে তার বাঁধেনি। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। ভাল ফল করেছিলেন প্রবেশিকা পরীক্ষায়। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ (মৌলানা আজাদ কলেজ), প্রেডিডেন্সি কলেজ সর্বত্রই  তিনি তার মেধার স্বাক্ষর রাখেন। বি.এ অনার্স পাশের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এম.এ ক্লাসে। অত্যন্ত সচেতনভাবেই তিনি  সেদিন লেখাপড়া ত্যাগ করেছিলেন সাধারণ মানুষের প্রতি তার দায়বদ্ধতা থেকে। সামন্তবাদী পীর পরিবার থেকে আগত হলেও তিনি যখন কলকাতায় পড়াশুনা করতেন সেই ছাত্রাবস্থায় তিনি ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং শ্রমিক এবং
 শ্রমিকশ্রেণীর মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বৈপ্লবিক কর্মকান্ড শুরু করেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে বি.এ অনার্স পড়ার সময় তিনি ১৯৪১ সালে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির প্রার্থী সভ্যপদ লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি পার্টির রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিচালিত ছাত্র সংগঠন অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট ফেডারেশনের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির দায়িত্ব পালন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ ভর্তি হলে তিনি পার্টির ডাকে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪১ সালে যশোর জেলার বনগাঁয়ে তৃতীয় কৃষক সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এই সম্মেলনে “লাঙ্গল যার জমি তার” এবং ঐতিহাসিক তে-ভাগা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যশোর জেলার কৃষকের তে-ভাগা আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দানকারীর ভূমিকা পালন করেন। পাকিন্তান আমলে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পুর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বৃটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশের সময়কালে তিনি অনেক আন্দোলন প্রত্যক্ষভাবে গড়ে তোলেন ও অংশ নেন- যেমন: ১৯৩৯ সালে হলওয়ের মনুমেন্ট ভাঙ্গার আন্দোলন, ১৯৪২ সালে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ আন্দোলন, হাটের তোলা আদায় বন্ধ আন্দোলন, ১৯৫০ সালে রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ড আন্দোলন, বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনসহ ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলন ও গণঅভ্যূত্থান, ১৯৭১ এ যুদ্ধ ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বিপ্লবী আন্দোলন ইত্যাদি। এই সাম্রগ্রিক সময়কালে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনে অগ্রণী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। কমিউিনিষ্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সংশোধনবাদের সকল প্রকাশের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের লাল পতাকা সমুন্নত রেখেছেন। ১৯৫৩ সালে কমরেড স্তালিনের মৃত্যুর পর সংশোধনবাদী ক্রুশ্চেভ চক্র সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পার্টি ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এবং ১৯৫৬ সালের ২০তম কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে পুঁজিবাদী রাশিয়ায় পরিণত করে। ক্রুশ্চেভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে তিনি প্রথম থেকেই আদর্শগত সংগ্রাম চালান। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রুশ্চেভ চক্র বিরোধী সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিষ্ট পার্টি (এম.এল) গঠনে তিনি নেতৃত্ব দানকারীর ভূমিকা পালন করেন। ক্রুশ্চেভ চক্রের নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালে রাশিয়ায় যে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ১৯৯০ এর দশকে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে তার নগ্ন পুঁজিবাদের পরিণতি লাভ করেছে। সংশোধনবাদী ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভ চক্রের বিরুদ্ধে এই আদর্শগত সংগ্রামের সঠিকতা আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট। ‘সমাজতন্ত্র ব্যর্থ’ সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলদের এই প্রচার অভিযানের ঝড় যখন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কালজয়ী ভাবাদর্শ উৎপাটিত করতে প্রবাহিত তখন কমরেড আবদুল হক একজন দৃঢ় মাকর্সবাদী-লেনিনবাদীর মত অটল অবিচল ছিলেন। তিনি ছিলেন বিপ্লবী আশাবাদ ও তৎপরতায় উজ্জল। এদেশের কমিউনিষ্ট আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর প্রকৃত বিপ্লবী পার্টি গঠনে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। ষাটের দশকে এদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার তথা কৃষি ব্যবস্থার চরিত্র নির্ধারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক সংগ্রাম করেন। মতিন-আলাউদ্দিন উপস্থাপিত কৃষিতে ধনতন্ত্র বক্তব্য খন্ডন করে তিনি ১৯৬৯ সালে রচনা করেন পূর্ব বাংলা আধাউপনিবেশিক আধাসামন্তবাদিী পুস্তক। পরবর্তীতে জাসদের আখলাকুর রহমানের জবাবে লেখেন- কৃষি ব্যবস্থা আধাসামান্ততান্ত্রিক পুস্তক। চীনা পার্টি কর্তৃক উপস্থাপিত তিন বিশ্বতত্ত্ব যা প্রতিবিপ্লবী, শ্রেণী সমন্বয়বাদী ও বেঠিক প্রমাণিত হয়েছে- এই তিন বিশ্বতত্ত্বের বিরুদ্ধে কমরেড আবদুল হক পরিচালনা করেন দৃঢ় মতাদর্শগত সংগ্রাম। তিনি বরাবরই শান্তিপূর্ণ পার্লামেন্টারি পথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংশোধনবাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে উর্ধ্বে তুলে ধরেন বল প্রয়োগে ক্ষমতা দখলের মার্কসাবাদী-লেনিনবাদী নীতি। তিনি ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯১ সালের অষ্টম কংগ্রেস পর্যন্ত প্রায় সমগ্র সময়কালে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। অসুস্থ্যতাকালীন এক পর্যায় পর্যন্ত তিনি এই পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পলিট ব্যুরোর সভ্য ছিলেন। এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণীর বলশেভিক ধরনের পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। দীর্ঘ ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের সামনে তিনি আজ শুধু একজন ব্যক্তি নন, এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ধারায় সংশোধনবাদ বিরোধী এক মহান প্রতীক হিসেবে এবং এদেশের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ধারার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি সামনে এসেছেন। কমরেড আবদুল হক ছিলেন সুবক্তা। তাঁর উদ্দীপক বক্তৃতা প্রতিটি জনসভাকে উদ্দীপ্ত করত। ১৯৭০সালের ২০ জানুয়ারী আসাদ দিবসে ভাসানী ন্যাপ আয়োজিত ঢাকার পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক লোকের জনসভায় তাঁর অসাধারণ বক্তৃতা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। সম্ভবত এটাই ছিল তাঁর জীবনে প্রকাশ্যে শেষ জনসভা। লেখক হিসেবে কমরেড আবদুল হক ক্ষুরধার লেখনির অধিকারী ছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দশ। এগুলো হচ্ছে। ১. ইতিহাসের রায় সমাজতন্ত্র, ২. ক্ষুধা হইতে মুক্তির পথ, ৩. যত রক্ত তত ডলার, ৪. পূর্ব বাংলা আধাউপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী, ৫. কৃষি ব্যবস্থা আধাসামন্ততান্ত্রিক, ৬. মার্কসীয় দর্শন, ৭. সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ-১, ৮.সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ-২, ৯. বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনীতি ও ১০. মাওসেতুং এর মূল্যায়ন। এই দশটি গ্রন্থের সমন্বয়ে কমরেড আবদুল হক গ্রন্থাবলী ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও শতাধিক প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছেন। সুদীর্ঘ ষাট বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে পঁচিশ বছরই তাকে আত্মগোপনে কাটাতে হয়। ২২ ডিসেম্বর ১৯৯৫ শুক্রবার রাত ১০টা ৫ মিনিটে বার্ধক্যজনিত অসুস্থ্যতায় কমরেড আবদুল হক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।