Type to search

উচ্চশিক্ষায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক সাফল্য

শিক্ষা

উচ্চশিক্ষায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক সাফল্য

বিলাল হোসেন মাহিনী
কুরআনের প্রথম শব্দ ‘ইকরা’, যার অর্থ ‘পড়’। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে ইলম (জ্ঞান) অর্জন করা ফরজ ইবাদত। সেই ফরজ ইবাদত পালনে পিছিয়ে নেই মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গণসহ বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদল্যালয়ে মাদরাস শিক্ষার্থীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো।
চলতি বছরের গণমাধ্যম রিপোর্টে উঠে এসেছে, মাদরাসা শিক্ষার্থী আমিনা বুশরা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটে ১ম, ‘সি’ ইউনিটে ৬৮তম এবং ‘ই’ ইউনিটে ২য় স্থান অর্জন করেছেন। এর আগে বুশরা চলতি বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় তৃতীয়, ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৯৪তম এবং ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৪০তম স্থান অর্জন করেন। সেইসঙ্গে গুচ্ছভুক্ত ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মানবিকের ‘বি’ ইউনিটে ৮০তম স্থান অর্জন করেন। অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘নবদূত’ ২৫ জুন (২০২৩) একটি শিরোনাম করেছে, ‘একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সেরা দশে মাদরাসার ৫ শিক্ষার্থী’। সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ও গুচ্ছভুক্ত ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সাফল্যের পর এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সেরা ২০-এ জায়গা করে নিয়েছেন তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার ৫ শিক্ষার্থী।
সংবাদটি নিঃসন্দেহে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অসামান্য সাফল্য বটে। কিন্তু এতসব সাফল্য ম্লান হয়ে যায় নানা কারণে। এর মধ্যে রয়েছে, ক. বেশিরভাগ মাদরাসা শিক্ষার্থী হত-দরিদ্র পরিবারের সন্তান। খ. সরকারি সুযোগ-সুবিধার অভাব ও বৈষম্য। গ. বহু বিভক্ত মাদরাসা শিক্ষা। ঘ. ধর্মীয় শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র কারিকুলামের অনুপস্থিতি। এবং ঙ. অপপ্রচার, ইত্যাদি। অথচ, সব অপপ্রচারের মুখে চুনকলি দিয়ে ২০১৮ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন আয়োজিত আলিয়া মাদরাসা শিক্ষকদের মহাসমাবেশ উদ্বোধন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়। আমি বিশ্বাস করি, যারা কোরআনকে ধারণ করে তারা কখনও জঙ্গি হতে পারে না।’ বর্তমান সরকারের আমলে কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি, দারুল আরকাম ইবতেদায়ি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও আলিয়া মাদরাসাগুলোর ভবন নির্মাণের জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরকারের এসকল উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য কিন্তু দুঃখজনক হলো, গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিকে মাদরাসা শিক্ষা অবহেলার শিকার হওয়ায় এ ধারায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই কমছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জাতীয়করণ। দেশে ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে, কিন্তু একটি স্বতন্ত্র বা সংযুক্ত ইবতেদায়ি মাদরাসাও সরকারি করা হয়নি। তিন শতাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হলেও একটি দাখিল মাদরাসাও সরকারি করা হয়নি। ৩০০ কলেজ সরকারি করা হলেও একটি আলিম বা ফাজিল অথবা কামিল মাদরাসাও সরকারি করা হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষা সংবিধান কর্তৃক সার্বজনীয় ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা হওয়া স্বত্তেও মাদরাসার ইবতেদায়ি (প্রাথমিক) স্তরের শিক্ষার্থীরা ‘বৃত্তি’ থেকে বঞ্চিত। অথচ মাদরাসার শিক্ষার্থীরা মেধা ও প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে প্রতিবছর। তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সেরা হচ্ছে, সেরা হচ্ছে মেডিকেল, বুয়েটসহ দেশে ও দেশের বাইরের নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এমনকি বিসিএসসহ সরকারি-বেসরকারি চাকুরিতে বর্তমানে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রবেশ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে।

মনে রাখতে হবে, উপমহাদেশে উচ্চশিক্ষার শুরুটা কিন্তু মাদরাসা শিক্ষার মধ্য দিয়েই। ভারতবর্ষে মাদরাসা শিক্ষার সূচনা হয় ৭১১ সালে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পরপরই। ১৮০০ সালের ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার আগেই ১৭৮০ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের (১৭৩২-১৮১৮ সালে) অনুমোদনক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা আলিয়া মাদরাসা। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি শিক্ষার নতুন ধারা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৫৪ সালের পরবর্তীকালে। আর উপমহাদেশের প্রথম কওমি মাদরাসা দারুল উলুম দেওবন্দ পতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৬ সালে। এখানেই শেষ নয়, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু এবং অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও কলকাতা আলিয়া মাদরাসার আরবি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এছাড়াও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীও মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তাজউদ্দীন আহমদও তাঁর বাবার সরাসরি তত্ত্বাবধানে পবিত্র কোরআনে হাফেজ হয়েছিলেন। এছাড়াও মাওলানা আকরম খাঁ, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশদের মতো ইতিহাস অলংকৃত বাঘা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন মাদরাসার শিক্ষার্থী। কালের ধারাবাহিকতায় এ দেশে যেভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সাধারণ শিক্ষার প্রসার ঘটেছে সেই তুলনায় মাদরাসা শিক্ষায় প্রসার ঘটেনি।

আমাদের উচিৎ, মেধাবী সন্তানটিকে মাদরাসায় ভর্তি করা। আমরা আমাদের সবচেয়ে কম মেধাবী সন্তানটাকে মাদরাসায় দিই। এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসেতে হবে।
মাদরাসায় কমবেশি পাঁচটি ভাষা (বাংলা, আরবি, ইংরেজি, উর্দু, ফারসি) শেখানো হয়। গণিত, মৌলিক বিজ্ঞান, সাহিত্য, সামাজিক বিজ্ঞান ইত্যাদি তো আছেই। তাই তাদের প্রচুর শ্রম ও সময় দিতে হয় অধ্যয়নে। অথচ তাদের জন্য বরাদ্দ-করা আনুষঙ্গিক সুবিধাদি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক কম। সরকারকে সাধারণ শিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রসারে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও বেশি আধুনিকায়নের আওতায় এনে মেধাবীদের দেশের উন্নয়নের কাজে লাগাতে হবে। কওমি, নূরানী, হেফজ মাদরাসাসহ দেশের সব মাদারাসার তথ্য সম্বলিত একটি ওয়েবসাইট করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনলাইন নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে হবে। কেননা, দেশে এখন পর্যন্ত কতটি মাদরাসা আছে তা সরকারের জানা নেই মর্মে ১৪জুন (২০২৩) একটি প্রতিবেদন ছেপেছে দৈনিক জনকণ্ঠ। প্রকৃত ধর্মীয় জ্ঞানের মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রকৃত ধর্মচর্চা এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাসী তৎপরতার হ্রাস করা সম্ভব, অন্যদিকে বিদেশি ভাষা হিসেবে আরবি ভাষার দক্ষতা অর্জন করতে পারলে আমাদের রেমিট্যান্স প্রাপ্তির স্বর্গভূমি মধ্যপ্রাচ্যে মানবসম্পদ রফতানির মাধ্যমে অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা, যা অবদান রাখবে এ দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে। আমাদের অবহেলার নীতি চলমান থাকলে এবং সাধারণ শিক্ষার সাথে মাদরাসার জাতীয়করণ ও অন্যান্য বৈষম্য দূর না হলে, মেধাবীদের একটি বড় অংশই হারিয়ে যাবে, যা মূলত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বৈ কিছুই নয়।