আজ পহেলা আষাঢ়

ঋতুচক্রের পরিক্রমায় আবার ফিরে এসেছে বর্ষা। আজ থেকে শুরু হলো প্রকৃতির নবযৌবনের উচ্ছ্বাস। নবধারা জলে স্নান করে শীতল হওয়ার আহ্বান এখন প্রকৃতিতে। রিমঝিম বৃষ্টি, কখনও বা মুষলধারে ভারী বর্ষণও হবে। মাঠ, নদী-নালা, পুকুরÑ সব টইটম্বুর হবে বর্ষায়। বাঙালি জীবনে বর্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ঋতু। আষাঢ়ের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে এই ঋতু চলবে শ্রাবণের শেষ দিন পর্যন্ত। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়- ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান, আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান…’
আষাঢ়-শ্রাবণ দুমাস বর্ষাকাল। এসময় জলীয়বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টি হয়। তাই চারপাশের পরিবেশ রূপ নেয়ে চিরসবুজের আভরণে। কদম, বেলি, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। পেখম মেলে ময়ূর। বৃষ্টির পানি গায়ে নিয়ে আনন্দে নেচে ওঠে তারা।
অন্যসব ঋতুর চেয়ে বর্ষাকে নিয়ে একটু বেশিই মাতামাতি হয় বাংলা সাহিত্যের কবিদের মঝে। বর্ষা তাদের চিন্তা আর ভাবনায় ঢেলে দিয়ে যায় নবসৃষ্টির অনন্য রসের ধারা। বর্ষায় প্রকৃতির এমন পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে কবিগুরু লিখেছেন ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী/উড়ে চলে দিগদিগন্তের পানে/নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণ বর্ষণসঙ্গীতে/রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম…।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘রিমঝিম রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে/কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে/কুহু পাপিয়া ময়ূর বোলে/মনের বনের মুকুল খোলে/নট-শ্যাম সুন্দর মেঘ পরশে…।’ বলা হয়ে থাকে, এমন কোনো কবি নেই যার বর্ষা নিয়ে সৃষ্টি নেই। এছাড়া দেশের বাউল আর লোককবিরাও এ ঋতু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী সাহিত্যভা-ার। বর্ষায় গ্রামবাংলার হাওর এলাকার চেহারাই বদলে যায়। গ্রীষ্মে যে হাওর পায়ে হেঁটে পাড়ি দেয়া যায়, সেখানে বর্ষায় থাকে অথৈ পানি। দেশের ভাটি অঞ্চলের বাবা-মায়েরা নৌকায় করে মেয়েকে নাইওর আনেন। বিয়ে-শাদীও হয় প্রচুর। নৌকায় করেই বিয়ে করতে যান বর। ফসল উৎপাদনেও বিশেষ ভূমিকা রাখে বর্ষা। তাইতো ওস্তাদ মোমতাজ আলী খান সুরে সুরে বলেন, ‘আইলো আষাঢ় লইয়া আশা/চাষির মনে বান্ধে বাসা…।’
বর্ষা সবার কাছে বেশ উপভোগ্য হলেও, এই ঋতুতেই ভাঙে অনেকের সুখের ঘর। বন্যায়, ভারী বর্ষণে, পাহাড়ি ঢলে গ্রামের পর গ্রাম ভেসে যায়। বন্যাকবলিত নিচু এলাকার মানুষ তাই আতঙ্কে পার করে বর্ষা। কখন বন্যায় তলিয়ে যায় ফসল। তারপরও বাঙালি জীবনে বর্ষা এক অনন্য ঋতু। বৃষ্টিতে ভেজা শৈশবের দুরন্ত স্মৃতিগুলো সব বাঙালির জীবনেই শ্রেষ্ঠ সময়। প্রিয় মানুষটির সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজার যে আনন্দ তা বর্ষা ছাড়া অন্য কোনো ঋতু দিতে পারে না। রিমঝিম বৃষ্টির আলতো ফোঁটাগুলো শরীরে তোলে উত্তাল উচ্ছ্বাসের ঢেউ। কদম-কেতকী আর মেঘমেদুর বর্ষার অমল রূপের মাধুরীতে ভরে উঠুক আমাদের চারপাশ।
দৈনিক কল্যাণ