Type to search

বাংলাদেশের দুই স্বপদ্রষ্টা : নজরুল ও বঙ্গবন্ধু

সাহিত্য

বাংলাদেশের দুই স্বপদ্রষ্টা : নজরুল ও বঙ্গবন্ধু

বিলাল হোসেন মাহিনী

আজকে যে বাংলাদেশে বসে লিখছি প্রিয় কবিকে নিয়ে তিনিই (কাজী নজরুল ইসলাম) সর্বপ্রথম ‘বাংলাদেশ’ নামক শব্দটি ব্যবহার করেছেলেন তাঁর কাব্যে। তিনি লেখেন-‘নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম, চির মনোরম চির মধুর।’ সেই থেকে বাংলাদেশটা আমাদের। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্ববাংলাকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করেন। কী অদ্ভুত মিল দুজনের মাঝে। কবি নজরুলর ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতায় সর্বপ্রথম ‘জয়বাংলা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। বঙ্গবন্ধু সেই ‘জয়বাংলা’কে জাতীয় জাগরণের তথা মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করেন। কাজী নজরুলের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এতোটাই গভীর ছিলো যে, স্বাধীনতার পর কবির জন্মদিনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়।

কবি নজরুল ও বঙ্গবন্ধু দুজনই কবি, একজন সাহিত্যের কবি অন্যজন রাজনীতির কবি। নজরুল চেয়েছেন বঞ্চনাহীন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে আর বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ছিল শোষণহীন বাংলাদেশ গড়া।  দুজনের স্বপ্ন ছিল এক ও অভিন্ন। দুজনই ছিলেন বিদ্রোহী। একজন সাহিত্যে, অন্যজন রাজনীতিতে।

বঙ্গবন্ধু কবি নজরুলের চেয়ে ২০ বছর ৯ মাস ২৩ দিনের ছোট। তিনি (বঙ্গবন্ধু) যখন জন্মগ্রহণ করেন নজরুল তখন সৈনিক কবি। সেখান থেকেই নিয়মিত লিখতেন পাঠাতেন ‘মোহাম্মদী’ ও ‘সত্তগাত’ পত্রিকায়। এ দুটি পত্রিকাই বঙ্গবন্ধুর পিতা তাঁদের বাড়িতে রাখতেন। কাজেই পারিবারিক পরিম-ল থেকেই বঙ্গবন্ধু নজরুলকে জেনেছেন-চিনেছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- ‘একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে। (আসল তারিখ ১২ আগস্ট ১৯৪১ খ্রি.) ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্সে শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ূন কবীর, ইব্রাহীম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না। ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ূন কবীর সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন।…’

এক অভিন্ন চিন্তা-চেতনা ও স্বপ্নের নায়ক ছিলেন নজরুল ও বঙ্গবন্ধু। জাতি-ধর্ম ভেদাভেদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন এই দুই মহান নেতা। বিদ্রোহী কবি উচ্চারণ করেন ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়ন-মণি হিন্দু তাহার প্রাণ। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাঙ্গালি-অবাঙ্গালি হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।’

১৯৭২ সালের ২৪ মে কবি নজরুলকে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা আনেন। এবং তাকে জাতীয় কবির মরযাদা প্রদান করেন। তিনি (বঙ্গবন্ধু) কবি নজরুলের গান ‘চল চল চল, ঊর্ধ গগনে বাজে মাদল’-কে বাংলাদেশের রণসংগীত হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বাঙালির সাহিত্যিক ও শিল্পীদের বিশেষ মূল্য দিতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে শ্রদ্ধেয় দুই মহাত্মা। জীবনের নানা সময় এ দুজনকে শরণ ও অনুসরণ করেছেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে শাসনভার গ্রহণ করার পর আবার বেতার ও টেলিভিশনে আগের ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজগুলো ফিরে আসে। কেবল পবিত্র কোরান পাঠের সঙ্গে যুক্ত হয় বেদ, বাইবেল, ত্রিপিটক পাঠ। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, ধর্মসমন্বয়।’ এভাবেই নজরুলের ধর্মসমন্বয়ভাবনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োগ করছিলেন। এরই মধ্যে ঘটে ১৯৭৫-এর সর্বনাশা ১৫ই আগস্ট! জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আত্মীয়-পরিজনসহ শাহদাত বরণ করেন। এ কারণে নজরুলের চিকিৎসায় পড়ে ঘাটতি আর অমনোযোগ। যেজন্য হাসপাতাল থেকে কবিভবনে আর ফেরা হয়নি নজরুলের। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট (১২ই ভাদ্র, ১৩৮৩) তিনি লোকান্তরিত হন।
কবি নজরুলের কথা দিয়ে ইতি টানছি লেখার। তিনি লেখেন, ‘বাংলা বাঙালির হোক। বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।’
লেখক : বিলাল হোসেন মাহিনী, নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর। সাহিত্য সম্পাদক : বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক সোসাইটি, কেন্দ্রীয় কমিটি।