নড়াইলের সামিয়া অ্যাথলেটিকসে দ্রুততম বালিকার খেতাব পেলেন

উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল থেকে:
নড়াইলের সামিয়া শীতকালীন জাতীয় স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা
অ্যাথলেটিকসে দ্রুততম বালিকার খেতাব পেলেন সামিয়া। ক্যানসারে স্বামীর মৃত্যুর পর নাসরিন নাহারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। স্বামী নাজির শেখের ভ্যান চালানোর পয়সাতেই যে চলত সংসার। জমি বলতে চার শতক ভিটেবাড়ি। উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল থেকে জানান, চার ছেলেমেয়ে। সবার ছোট সামিয়ার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। তাদের নিয়ে শুরু করেন জীবন সংগ্রাম। বাবা ও ভাইদের সহায়তায় ছেলেমেয়েদের বড় করতে থাকেন। তাতেও টাকার সংকুলান না হওয়ায় একটি ইটভাটার শ্রমিকদের তিনবেলা রান্নার কাজ নেন। অভাবের কারণে বড় দুই মেয়ের লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি, তাদের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট দুই ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করছে। সবার ছোট সামিয়া এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। ১০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে রোজ সকালে স্কুলে যায়। মায়ের আক্ষেপ, ‘একটা সাইকেলও কিনে দিতে পারিনি। প্রতিদিন অনেক কষ্টে সে স্কুলে যায়।’ ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০২১ সালে সে জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিল। আর এ বছর পেয়েছে দেশের দ্রুততম বালিকার (বালিকা বড় গ্রুপ) খেতাব। সামিয়ার আশা, ‘সামনে আরও ভালো করব। এসএসসি পাস করে আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাই।’
দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে সবচেয়ে বড় আসর শীতকালীন জাতীয় স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। সেখানে অ্যাথলেটিকসে টানা ১৭ বার দেশসেরা হয়েছে নড়াইলের লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। করোনা মহামারির কারণে দুই বছর এ প্রতিযোগিতা বন্ধ ছিল। ২ থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি যশোরের শামস্-উল হুদা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ৫১তম শীতকালীন জাতীয় স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১১টি পদক পেয়েছে। এর মধ্যে আটটি সোনা। প্রতিযোগিতায় বালিকা বড় গ্রুপে ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব পেয়েছে সামিয়া খানম। সময় নিয়েছে ১৩ দশমিক ১২ সেকেন্ড। বালিকা বড় গ্রুপে ১০০ মিটার দৌড় প্র্রতযোগিতা এবং দীর্ঘ লাফে প্রথম হয়ে সোনা জিতেছে সামিয়া। লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় ক্রীড়াক্ষেত্রে কীভাবে সফল হচ্ছে, তার হয়তো নমুনা পাওয়া গেল সামিয়ার গল্পে।
১৯ বছর ধরে দেশের মধ্যে একক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি সোনার পদক পেয়েছে লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। ১০০, ২০০, ৪০০ ও ১৫০০ মিটার দৌড়, রিলে দৌড়, দীর্ঘ ও উচ্চ লাফ এবং গোলক, বর্শা ও চাকতি নিক্ষেপসহ প্রায় সব বিভাগে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অর্জন উল্লেখ করার মতো। বিদ্যালয়ে ফুটবল, বাস্কেটবল, ক্রিকেটেও ছেলেমেয়েদের চর্চা শুরু হয়েছে কয়েক বছর ধরে। এগুলোতেও সাফল্য এসেছে জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে। এ পর্যন্ত বিদ্যালয়টি ৭৭৪টি পদক পেয়েছে। এর মধ্যে ৩১০টি সোনা, ২৭৬টি রুপা এবং ১৮৮টি ব্রোঞ্জ। স্কাউটসেও বিদ্যালয়টির সাফল্য রয়েছে। ২০১৫ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত ২৩তম বিশ্ব স্কাউট ক্যাম্পে বিদ্যালয়ের তিনজন এবং ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ২৪তম বিশ্ব স্কাউট ক্যাম্পে বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া চলতি বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৫তম বিশ্ব স্কাউট ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হবে। ওই ক্যাম্পে বিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। ২০১৯ সালে বিদ্যালয়ের আটজন, ২০২০ সালে পাঁচজন এবং ২০২১ সালে সাতজন শিক্ষার্থী স্কাউটে প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। বিদ্যালয়টির ১০০ প্রাক্তন শিক্ষার্থী বর্তমানে খেলোয়াড় হিসেবে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ আনসার এবং বিজেএমসিতে (বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন) চাকরি করছেন। যাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি।
লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কীভাবে ক্রীড়াক্ষেত্রে দেশসেরা, খোঁজ নিতেই উঠে এল দিলীপ চক্রবর্তীর নাম। তিনি বিদ্যালয়ের খন্ডকালীন ক্রীড়া শিক্ষক। তিনি এই বিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র। ২০০২ সালে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তিনি শুর করেন নিবিড় প্রশিক্ষণ। সে বছরই জাতীয় শীতকালীন অ্যাথলেটিকসে সোনা জেতে বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। ২০০৩ সালে স্বর্ণপদক আসে চারটি। পরের বছর তাঁকে খন্ডকালীন ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এইচএসসি পাস দিলীপ। তাই স্থায়ী চাকরি হওয়ার সুযোগ নেই। এরপর বিদ্যালয়ের সাফল্যের ঝুড়ি ক্রমান্বয়ে ভরতে থাকে।
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে সকাল সাতটার মধ্যে মাঠে চলে আসেন দিলীপ চক্রবর্তী। প্রশিক্ষণ চলে নয়টা পর্যন্ত। এরপর বাসায় এসে নাশতা করেন। সকাল ১০টার মধ্যে স্কুলে গিয়ে অ্যাসেম্বলিতে অংশ নেন। দুপুরে বাড়ি ফেরেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম শেষে বিকেল চারটা থেকে আবার মাঠে। এরপর রাত আটটা পর্যন্ত থাকেন স্কুলে।
দিলীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘উপজেলার বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে আমি খেলা পরিচালনা করি। এ সময় ভালো মেয়েগুলো বাছাই হয়ে যায়। তাদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। তাদের বেশির ভাগই হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাদের সব রকম সহযোগিতা করেন। তাদের কাছ থেকে কোনোরকম টাকা নেওয়া হয় না। সাফল্যের মূলমন্ত্র নিবিড় প্রশিক্ষণ। মেয়েরা নির্দেশনা মানে বেশি। তাই তারা বেশি এগিয়ে যায়। এভাবেই দিন দিন বাড়ছে সাফল্য। বর্তমানে আমার ছেলেমেয়ে মিলে ৪০ জনের একটি টিম রয়েছে। স্বপ্ন দেখি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব আসরে আমার ছেলেমেয়েরা উজ্জ্বল নক্ষত্র হবে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এস এম হায়াতুজ্জামান বলেন,‘ক্রীড়াক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের সাফল্যের মূলে রয়েছে বিদ্যা