শ্রদ্ধার ফুল নিয়ে অন্তিমযাত্রায় অভিনেতা মাসুম আজিজ

অভিনেতা, নির্দেশক ও নাট্যকার মাসুম আজিজের অন্তিম যাত্রায় শামিল হয়ে সংস্কৃতিজনরা স্মরণ করলেন তার বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি জীবন। কফিনে শ্রদ্ধার ফুলটি রেখে কেউ ভেঙে পড়লেন নীরব কান্নায়৷
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে মঙ্গলবার বেলা ১১ টার দিকে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মাসুম আজিজের প্রতি নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বটি শুরু হয়।
ছেলে উৎস জামান ও মাসুম আজিজের অনুজ সংস্কৃতি জনদের কাঁধে চড়ে মরদেহ আসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। পুরো পর্বটি পরিচালনা করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।
সোমবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে মাসুম আজিজ স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৬৯ বছর বয়সী এ অভিনেতা দীর্ঘদিন ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন৷ গত সপ্তাহে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করে তার পরিবার।
স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘর থেকে মঙ্গলবার সকালে মাসুম আজিজের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রামপুরার বনশ্রী আবাসিক এলাকার বাসায়৷ সেখানে মরদেহ গোসলের পর নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
মাসুম আজিজের স্ত্রী অভিনেত্রী সাবিহা জামান বলেন, ‘ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর মাসুম এতটুকু দমে যাননি৷ তিনি পুরোদমে শুটিং চালিয়ে গেছেন। বাসায় ফিরে হয় এডিটিং প্যানেলে, নয় খাতা কলম নিয়ে কোনো নাটক বা গান লিখতে বসে পড়তেন। সবসময় বলতেন, এ দেশের মানুষের জন্য, সংস্কৃতির জন্য, আমার কত কী দেওয়ার বাকি রয়ে গেছে!’
ছেলে উৎস জামান বলেন, ‘এ বছরের ৩ জানুয়ারি ক্যান্সার ধরা পড়ার পরে বাবা যেন এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অগ্রজ সংস্কৃতিজন আসাদুজ্জামান নূর, গোলাম কুদ্দুছ, মামুনুর রশীদ সবাই বাবার সেই যুদ্ধের সহযোদ্ধা ছিলেন। বাবার শেষ সময়ের পুরোটা জুড়ে তারা ছিলেন পাশে৷ আজ বাবার সেই যুদ্ধটা শেষ হয়ে গেল।’
মাসুম আজিজের বড় ভাই সাবেক কমিউনিস্ট নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি শামসুজ্জামান হীরা বলেন, ‘মাসুমের ভালো নাম নাজমুন জামান। ঢাকায় এসে সে নাম বদলে রাখে মাসুম আজিজ। মাসুম সারা জীবন বৈজ্ঞানিক ও সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখত৷ আজ চারিদিকে যখন দেশবিরোধী নানা প্রচারের কথা শুনি, তখন মাসুমের অসম সাহসিকতার কথা স্মরণ করি। তরুণ প্রজন্ম মাসুমের সেই চেতনাকে ধারণ করতে পারে।‘
এদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। তাদের সঙ্গে আসেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা।
শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, যত বাধা বিপত্তি আসুক না কেন, মাসুম আজিজ কখনও তার আদর্শিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হননি। চিন্তা, চেতনা ও মননে তিনি সবসময় অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করেছেন। কর্মজীবনে তার এ অবস্থান আমাদের জন্য অনন্ত প্রেরণার উৎস।
সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘আমাদের দেশে শুধু নাটক করে বেঁচে থাকার প্রত্যয় আমরা পারি নি। আমরা অনেক আপোষ করেছি। জীবনের গতির সাথে মিলিয়ে চলবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মাসুমকে কখনো আপোষ করতে দেখি নি। মাসুম আজিজের সঙ্গে দু-একটা কাজও করেছি একসাথে। মাসুম আজিজের চলে যাওয়া মানে অঙ্গীকারবদ্ধ এক শিল্পীর চলে যাওয়া। তার ভাবনায় সব সময় দেশ এবং মানুষ ছিল।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও অভিনেতা মাসুম আজিজ দুজনেই ঢাকার নাটকের দল পদাতিকের সদস্য৷
দীর্ঘ সাংস্কৃতিক জীবনের সহচরকে হারিয়ে শোকার্ত গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘নানা প্রলোভনের হাতছানি সত্ত্বেও মাসুম আজিজ সুবিধাভোগী জীবনটি বেছে নেননি। তিনি অতি কষ্টের জীবনটাকেই বেছে নিয়েছিলেন। অভিনয় প্রতিভা ও যাপিত জীবনের তার যে দৃষ্টিভঙ্গি, সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক বিরলপ্রজ মানুষ৷ একজন মাসুম আজিজ বারবার আসে না৷’
অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘আপাদমস্তক নাটকে নিয়োজিত মানুষ ছিলেন মাসুম আজিজ। তিনি মঞ্চ নাটকে, টিভি নাটকে অথবা চলচ্চিত্রে যে চরিত্রেই অভিনয় করেন না কেন, ওই চরিত্রকে এতটাই বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতেন, আমরা বিস্মিত হতাম। তিনি যদি গানটা নিয়মিত করতেন, তবে আমরা একজন চমৎকার শিল্পী পেতাম।’
অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলেন, কর্মজীবন বা ব্যক্তিজীবন দুইক্ষেত্রে এক অসামান্য শিল্পীসত্তার অধিকারী ছিলেন মাসুম আজিজ৷
অভিনেতা, পরিচালক নাদের চৌধুরী বলেন, ‘জীবনের শেষ দিনগুলোতে মাসুম আজিজ ভাই থাকতেন তার বনশ্রীর বাসায়। আমি জানতাম, দুরারোগ্য ব্যাধি মাসুম আজিজ ভাইকে আমাদের কাছ থেকে চিরতরে কেড়ে নেবে৷ তবুও কষ্ট চেপে রেখে যেতাম, হাসি- আনন্দে, ঠাট্টায় ডুবে থাকতাম৷ আজ তার কত কথা, কত স্মৃতি.. সহজে বলে তো শেষ করা যাবে না।’
অভিনেতা, পরিচালক সালাউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘একটি সামাজিক- সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় একেক জন মাসুম আজিজ। সেই মাসুম আজিজ ভাই তার অভিনয় সত্তা ও ব্যক্তি আদর্শের ক্ষেত্রে এতটাই নিবেদিত ছিলেন, তার মতো মানুষ খুব বিরল৷ তাকে হারানো আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরী বলেন, ‘যখন ঢাকায় এসেছিলাম, তখন মাসুম ভাইকে বলেছিলাম, তার সাথে কাজ করতে চাই৷ পরে তিনি আমাকে আরণ্যকে যেতে বলেন। তার ওই এক কথায়, আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়।‘
অভিনেতা মাসুম আজিজকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ছাড়াও এদিন শ্রদ্ধা জানায় শিল্পকলা একাডেমি, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, ঢাকা পদাতিক, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, অভিনয় শিল্পী সংঘ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ, দনিয়া সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
মাসুম আজিজের ছেলে উৎস জামান জানান, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বাবার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে৷ সেখানে জানাজা শেষে তার স্বজনরা মরদেহ নিয়ে রওনা হন পাবনার ফরিদপুর উপজেলার খাগড়বাড়িয়া গ্রামে।
মঙ্গলবার বাদ এশা তার গ্রামের মসজিদে আরেক দফা জানাজা শেষে তার মরদেহ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
শিল্পকলায় বিশেষ অবদান রাখায় মাসুম আজিজ ২০২২ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক পান।
১৯৫৩ সালের ২২ অক্টোবর হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পাবনার ফরিদপুর উপজেলার খাগড়বাড়িয়া গ্রামে তার পৈতৃক নিবাস।
১৯৭২ থেকে নাট্যচর্চা শুরু করে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাট্যশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন মাসুম আজিজ। ১৯৮৫ সালে মাসুম আজিজ নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন বেতারে।
সংগীতই ছিল মাসুম আজিজের প্রথম পছন্দ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি সাংস্কৃতিক জীবন শুরু করেন সংগীত পরিচালক হিসেবে। ঘটনাচক্রে একসময় জড়িয়ে পড়েন নাট্যচর্চায়।
মঞ্চনাটক দিয়েই তার নাট্যচর্চার শুরু। তিনি নাট্যদল ঢাকা পদাতিকের সদস্য। আশির দশকে ঢাকার মঞ্চে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য প্রযোজনায় তিনি মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মন জয় করেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-ড. জামিল আহমেদের পরিচালনায় নিকোলাই গোগোলের বিখ্যাত নাটক গভর্নমেন্ট ইন্সপেক্টরের বাংলা রূপান্তর ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল’, ‘রাক্ষস খোক্কস’, ‘বিষাদ সিন্ধু’; এস এম সোলায়মানের রচনা ও পরিচালনায় ‘এই দেশে এই বেশে’, ‘আমিনা সুন্দরী’।
মাসুম আজিজ নির্মাতা ও নাট্যকার হিসেবেও দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নাটক রচনা ও পরিচালনা করেন।
২০০৬ সালে প্রয়াত কাজী মোরশেদের রচনা ও পরিচালনায় ‘ঘানি’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
মাসুম আজিজের স্ত্রী সাবিহা জামানও একজন অভিনয়শিল্পী।
ছেলে উৎস জামান বাবা-মায়ের মতো অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগ থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন। মেয়ে প্রজ্ঞা আজিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন।