Type to search

টাকা পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না

জাতীয়

টাকা পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না

টাকা পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না

দেশ থেকে টাকা পাচারের বিষয়টি এখন আর কেউ অস্বীকার করেন না। শুধু কারা বেশি টাকা পাচার করেন, এ নিয়ে বিতর্ক হয়। গত বছরের ১৮ নভেম্বর ঢাকায় ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজনীতিবিদেরা নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকরিজীবীরা। তাঁর এই বক্তব্যের প্রায় সাড়ে ছয় মাস পর জাতীয় সংসদের চলতি বাজেট অধিবেশনে টাকা পাচার বন্ধে জোরালো দাবি উঠেছে।

বিদেশে টাকা পাচার বন্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে গত রোববার জাতীয় সংসদে দাবি তুলেছিলেন সরকারি দলেরই এক সাংসদ। আর গতকাল সোমবার বিরোধী দলের সদস্যরা বলেছেন, দেশ থেকে টাকা পাচার ঠেকানোর কোনো পথ সরকার বের করছে না। পাচার করা টাকাও ফিরিয়ে আনতে পারছে না। কেউ টাকা পাচার করছেন আন্ডারইনভয়েসিং (দাম কম দেখিয়ে পণ্য রপ্তানি) এবং ওভারইনভয়েসিংয়ের (আমদানিতে দাম বেশি দেখিয়ে) নামে। আবার কেউ পাচার করছেন অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে।

জিএম কাদের

জিএম কাদের
ফাইল ছবি

তারা পুকুরচুরি করে বের হয়ে যাচ্ছে। আর যাঁরা এসব তুলে ধরছেন, তাঁরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

জি এম কাদের জাপার চেয়ারম্যান ও সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা

২০২০-২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দলের চারজন সদস্য এসব কথা বলেছেন। আর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল টাকা পাচারের বিষয়ে তথ্য চেয়েছেন বিরোধী দলের সাংসদদের কাছে। যদিও গত ১৮ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, গোপনে কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশিদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা ছিল, রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে।’

আর গতকাল সম্পূরক বাজেটের আলোচনায় জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্ব সঠিক, কিন্তু কর্তৃত্ব দুর্বল। তবে সব দোষ অর্থমন্ত্রীর ঘাড়ে দেওয়াও ঠিক নয়। যেমন ব্যাংক খাতে এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব নেই। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা ইত্যাদি খাতেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব নেই। অবাধে চলছে সব। এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। হুন্ডির মাধ্যমেও বিদেশে টাকা পাঠানো হচ্ছে।

কাজী ফিরোজ রশীদ

কাজী ফিরোজ রশীদ
ফাইল ছবি

দুদকের হেড অফিস আপাতত বাংলাদেশে রাখার দরকার নেই। এটি কানাডায় করা হোক। আরেকটি শাখা হোক মালয়েশিয়ায়।

কাজী ফিরোজ রশীদ জাপার সাংসদ

টাকা পাচার রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যক্রম নিয়েও একটি প্রস্তাব দিয়েছেন সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন, দুদকের হেড অফিস আপাতত বাংলাদেশে রাখার দরকার নেই। এটি কানাডায় করা হোক। আরেকটি শাখা হোক মালয়েশিয়ায়। এর বাইরে আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়, দুবাইতে দুদকের শাখা কার্যালয় করা গেলে টাকা পাচারের সঠিক চিত্রটি বোঝা যাবে।

দেশের অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুণ্ঠনকারী ও টাকা পাচারকারী হিসেবে অনেক দিন ধরে আলোচিত নাম প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার) নিয়েও কথা বলেন জাপার এই সাংসদ। তিনি বলেন, ‘পি কে হালদার এত টাকা নিল! অথচ বলা হচ্ছে, ৯ মিনিটের জন্য তাকে ধরতে পারেননি। তাহলে ৯ ঘণ্টা আগে কেন তাকে ধরলেন না?’

পাচার করা অর্থে কারা বিদেশে বাড়ি বানিয়েছেন, আদালত এ বিষয়ে একটি তালিকা চাইলেও দুদক তা জমা দিতে পারেনি বলেও জানান ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এত বেশি শাখা থাকা সত্ত্বেও যথাযথ তদারকির অভাব আছে। ঠিক সময়ে নিরীক্ষা হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। এত অর্থ পাচারও হতো না, এত বাজে ঋণও দেওয়া হতো না।

বিজ্ঞাপন
রওশন আরা মান্নান

রওশন আরা মান্নান

ব্যাংক খাত, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ারবাজার এখন নির্যাতিত এতিমদের মতো। দেখার কেউ নেই।

রওশন আরা মান্নান জাপার সাংসদ

জাপার আরেক সাংসদ রওশন আরা মান্নান বলেন, অনেক প্রকল্প পরিচালকই (পিডি) নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করেন। প্রকল্পের মাধ্যমে নিয়োগবাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্যও হয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

আলোচনায় বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, ‘স্কুলে অঙ্কে ভালো ছাত্র ছিলাম। শিক্ষকেরা আদর করতেন। কিন্তু বাজেটের অঙ্ক মেলাতে পারছি না। কোথা থেকে টাকা আনবে? প্রবৃদ্ধির জন্য লাফাচ্ছি। অথচ সুচের একটা ফোঁটা দিলে বেলুনের মতো চুপসে যাবে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পোশাক খাত ও প্রবাসী আয়ে ভয়ানক ধস নামবে।’

বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, আমজনতার আমানতের টাকা থাকে ব্যাংকে। এ থেকে এমনভাবে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন একশ্রেণির লোক, নেওয়ার সময়ই তাঁরা জানেন যে এ টাকা ফেরত দিতে হবে না। বছরে এক লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়ে যায় বিদেশে। এগুলো যায় ওভারইনভয়েসিং ও আন্ডারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে।

বছরে পাচার ৬৪ হাজার কোটি টাকা

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। ৮৫ টাকায় প্রতি ডলার হিসাবে তা ৬৪ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের মার্চে এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালের পর মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে চলে গেছে, যা ২০০৮ সালে ছিল ৫২৮ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০০৯ সালে ৪৯০ কোটি, ২০১০ সালে ৭০৯ কোটি, ২০১১ সালে ৮০০ কোটি, ২০১২ সালে ৭১২ কোটি ও ২০১৩ সালে ৮৮২ কোটি ডলার বিদেশে গেছে।

জিএফআইয়ের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে ২০১৫ সালে ৫৯০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।

গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠানো চিঠিতে বলেছে, পণ্য আমদানির আড়ালে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে, বিদেশে পণ্য রপ্তানির প্রচুর অর্থও দেশে ফেরত আসছে না। এ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭-এর আওতায় মামলা হলেও নিষ্পত্তি হচ্ছে না।

কালোটাকা সাদার পক্ষে-বিপক্ষে

অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার সুযোগের পক্ষ নিয়ে সাংসদ ফিরোজ রশীদ বলেন, অর্থমন্ত্রীর অবস্থান ঠিকই আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে এই যে অর্থ আসছে, যাঁরা এগুলো পাঠাচ্ছেন, তাঁরা ঠিকই জানেন যে কোনো হিসাব দিতে হবে না। সুতরাং, অর্থমন্ত্রী যেন ‘টক শো’ দেখে বিভ্রান্ত না হন। এই সুযোগ থাকুক।

দেশের আর্থিক খাতে বেহাল অবস্থা চলছে—এমন মন্তব্য করে বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, এ জন্য দায়ী দুর্নীতি। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা দিয়েছেন। অথচ অর্থমন্ত্রী বলছেন অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ সাদা করার সুযোগের কথা। এটা সাংঘর্ষিক। আবার অর্থমন্ত্রী বলেছেন কালোটাকা ও অপ্রদর্শিত আয় এক নয়। নীতিগতভাবে তা ঠিক আছে। তবে দুর্নীতি, মাদক, অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে বিত্ত গড়ে তুললে তাকে সুযোগ দেওয়া ন্যায়সংগত হবে না। অপ্রদর্শিত আয়ের সংজ্ঞা না দেওয়া হলে সমাজে ভুল বার্তা পৌঁছাবে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে এক পরিবারের হাতে ব্যাংক তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে সংসদে উল্লেখ করেছেন বিএনপির আরেক সাংসদ রুমিন ফারহানা। তিনি বলেন, জনগণের টাকা হরিলুট হচ্ছে। সংসদে ঋণখেলাপির তালিকা দেওয়া হলো। তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো?

রুমিন ফারহানা বলেন, ব্যাংক খাতের প্রকৃত মন্দ (খেলাপি) ঋণ কত, জানা নেই। সরকার যখন বলেছিল ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তখন বলেছিল এটা আড়াই লাখ কোটি টাকা। সরকার এখন বলছে মন্দ ঋণ ৮৮ হাজার কোটি টাকা।

রুমিন ফারহানা

রুমিন ফারহানা

ব্যাংক থেকে এমনভাবে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন একশ্রেণির লোক, নেওয়ার সময়ই তাঁরা জানেন যে এ টাকা ফেরত দিতে হবে না।

রুমিন ফারহানা বিএনপির সাংসদ

ব্যাংক, শেয়ারবাজার এতিমের মতো

বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, শেয়ারবাজার শুয়ে গেছে; একেবারেই শুয়ে গেছে।

এ বিষয়ে বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখনই শেয়ারবাজার শুয়ে পড়ে। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালেও তা দেখা গেছে।

রুমিন বলেন, আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, শেয়ারবাজার আসলে ‘ফটকা বাজার’। তিনি অনেক সময় স্পষ্ট কথা বলতেন। যেমন বলেছিলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় পার্টির আরেক সাংসদ রওশন আরা মান্নান বলেন, ব্যাংক খাত, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ারবাজার এখন নির্যাতিত এতিমদের মতো। দেখার কেউ নেই। লুটপাট ও দুর্নীতি হচ্ছে, কিন্তু শাস্তি হচ্ছে না কারও।

সূত্র: প্রথম আলো