Type to search

জাতীয়

ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করার পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা।
অনেক বছর আগে বৈশাখের কোনো এক শেষ বিকেলে যমুনা নদী দিয়ে বগুড়ার সারিয়াকান্দি থেকে সিরাজগঞ্জের চৌহালী আসার পথে আমাদের নৌকা তীব্র ঝড়ের কবলে পড়ে। বড় নৌকা, মাঝিমাল্লা চারজন আর আমরা জনা পাঁচেক প্যান্ট পরা ভদ্দরলোক। আমাদের ছটফটানি দেখে চরম ভদ্র মাঝি আবুল ভাই (১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, এখন প্রয়াত) দিলেন এক ধমক। তিনি বললেন, ‘লক করে বইসা থাকুন, আমরা সামাল দিব।’ হালে গিয়ে বসেন আবুল ভাই। সামাল দেওয়া কাকে বলে তখন দেখেছিলাম।

যমুনার এমন বেহাল ঢেউ আগে কখনো দেখিনি। চোখের সামনে দু–তিনটা ছোট নৌকা হারিয়ে গেল। পৌনে এক ঘণ্টার সেই ঝড় মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে চলেছে। ঝড়ের পর নদী শান্ত হলে আবুল ভাই হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘ভাগ্যিস কাল হালটা মেরামত করিছিলাম। তাই আজ বড় বাঁচা বেঁচি গেনু।’ শক্ত সোনালু কাঠের হাল। পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিলেন নৌকার গুণে। একে একে বলেছিলেন, নৌকার নকশাটাই আসল। নকশায় ভুল থাকলে উপায় নেই। হালটাও বড় নৌকার প্রাণ। সেই সঙ্গে দরকার ঝড়ের অভিজ্ঞতা। মেঘের ধারণা। বাতাসের আওয়াজ শুনে তাঁরা বুঝতে পারেন ঝড় আসবে কোন দিক থেকে। আবুল মাঝি সেদিন জানিয়ে দিয়েছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সারকথা। ওয়ান কমান্ড, সময়মতো শক্ত হাতে হাল ধরা, টেকসই কাঠামো, সঠিক উপকরণ, রক্ষণাবেক্ষণ আর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা

পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ দুর্যোগ আবহাওয়াজনিত। এসব দুর্যোগের আবার ৪৫ শতাংশ ঘটে এশিয়ায়। হিসাব কষলে দেখা যাবে, দুর্যোগে অর্থনৈতিক ক্ষতির ৪২ শতাংশ, হতাহতের ৮৩ শতাংশ এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনসংখ্যার ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলে।

জলবায়ুরর বৈশ্বিক ঝুঁকির সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশকে গত ২০ বছরে ১৮৫টি আবহাওয়াজনিত তীব্র দুর্যোগ সামাল দিতে হয়েছে। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে (কপ ২৫) প্রকাশিত জার্মান প্রতিষ্ঠান এনভায়রনমেন্টাল গ্রিন ওয়াচের হিসাবে, দুর্যোগে বিপদের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। আর শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের ঝুঁকির তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। তাই বাংলাদেশকে অনেকেই ঠাট্টা করে ‘দুর্যোগের সুপারমার্কেট’ বলেন।

বাংলাদেশের জন্মের সময়ও এ রকম সিরিয়াস ঠাট্টা করে বলা হয়েছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে। হতে পারে এটা অনুবাদকের ভুল অথবা ব্যুৎপত্তিগত মানে অন্য কিছু ছিল। তবে এ কথা মানতে হবে সেই ঠাট্টাটা মোটেও সম্মানজনক কিছু ছিল না। স্বাধীনতার পর আমাদের অর্থনীতিকে পশ্চিম আফ্রিকার দুর্বলতম অর্থনীতির দেশ আপার ভোল্টার (এখন বুরকিনা ফাসো) সঙ্গে তুলনা করা হতো। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা পেলেও দেশটি এগোতে পারছিল না। সবাই আমাদের দিকে আঙুল তুলে বলত বাংলাদেশও পারবে না। প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, স্বাস্থ্যশিক্ষা তথৈবচ, তার ওপর বছর বছর বন্যা, জলোচ্ছ্বাস লেগেই আছে, সব লেজেগোবরে অবস্থা। তবে এসব ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমরা এগিয়েছি। শুধু আপার ভোল্টার ওপরে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশ এখন আমাদের পেছনে। আমরা এগোচ্ছি।