Type to search

কুরবানির তাৎপর্য, মূখ্য উদ্দেশ্য ও শিক্ষা

ধর্ম

কুরবানির তাৎপর্য, মূখ্য উদ্দেশ্য ও শিক্ষা

বিলাল হোসেন মাহিনী

ঈদুল আযহার অন্যতম ওয়াজিব আমল হলো কুরবানি। আরবি ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসি বা উর্দূতে ‘কুরবানি’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ ‘নৈকট্য’। আর কুরবানির মূল আরবি হলো ‘উযহিয়্যাহ’ যার অর্থ ‘উৎসর্গ করা’। হযরত ইবরাহিম ও ইসমাইল আ. এর স্মৃতি বিজড়িত ইসলামের অন্যতম একটি ওয়াজিব ইবাদত হলো জিলহজ্ব মাসের নির্ধারিত দিনে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হালাল পশু যবেহ বা কুরবানি করা। পক্ষান্তরে কুরবানির উদ্দেশ্য যদি হয় গোশত খাওয়া, তবে এর ফল হবে বিপরীত। তখন এর দ্বারা আল¬াহর সন্তুষ্টির পরিবর্তে বান্দার কল্যাণ সাধন হবে মাত্র। কেননা আল্ল¬াহ তায়ালা সুরা হাজ্বের ৩৭ আয়াতে বলেছেন-‘নিশ্চয় আল¬াহর নিকট পৌছায় না কুরবানীর পশুর গোশত বা রক্ত, কেবল পৌছে তোমাদের অন্তরের পরিশুদ্ধতা তথা ‘তাকওয়া’।
কুরবানী শুরু হয়েছিল হযরত আদম আ. এর যুগে আর তা পরিপক্কতা লাভ করে হযরত ইবরাহিম আ. এর সময়ে। কুরবানি করা সুন্নাত ইবরাহিমী। তবে নবী পাক (সা.) সামর্থবানদের জন্য তা আবশ্যক করে দিয়েছেন। এ প্রসংগে মহান আল¬াহ তায়ালা বলেছেন-‘আপনি আপনার প্রভূর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কুরবানি করুন।’ এছাড়াও সুরা হাজ্বে বলা হয়েছে-“আমি (আল্ল¬াহ) প্রত্যেক জাতির জন্য কুরবনির নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে তারা চতুষ্পদ জন্তুর উপর আল¬াহ নাম স্মরণ করে। কুরবানী করা ওয়াজিব হলেও তা সকলের জন্য আবশ্যক নয়, শুধুমাত্র যারা সদকাতুল ফিতর ও যাকাত দিয়ে থাকে তাদের উপর ওয়াজিব।

কুরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য :
নিয়্যাত : কুরবানিতে নিয়্যাতটাই মূখ্য। আর সেই নিয়্যাত হতে হবে শুধুমাত্র মহান রবের সন্তুষ্টি প্রার্থনা। কুরবানির আসল উদ্দেশ্য সহীহ-শুদ্ধ আন্তরিকতা ও জন্তুর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ পালন করা। আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও মহব্বত বর্জিত ইবাদাত প্রাণহীন কঙ্কাল মাত্র।

কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্তসমূহঃ
১. মুসলিম হওয়া। অমুসলিমের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
২. স্বধীন হওয়া। পরাধীন বা দাস-দাসীর উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়।
৩. মুকীম হওয়া। মুসাফিরের উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়। যেমন আলী রা. বলেছেন-“মুসাফিরের জন্য ‘জুময়া’ ও কুরবানী জরুরী নয়”।
৪. নিসাব পরিমান সম্পদের মালিক হওয়া। অর্থৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রোপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ পরিমান সম্পদ যদি কারো নিকট থাকে তবে তা যাকাতর নিসাবে ন্যায় এক বছন পূর্ণ হওয়া শর্ত নয়। বরং এ পরিমান সম্পদ সাহিবে নিসাবের কাছে ১০ জিলহজ সুবহে সাদিকের পূর্বে থাকলেই তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে।

পশু কুরবানীর জরুরী মাসয়ালাঃ
১. কুরবানী করা ওয়াজিব।
২. যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়, সে যদি কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশু ক্রয় করে তাবে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়ে যায়।
৩. পশু কুরবানী প্রত্যেক বছরই ওয়াজিব, এমন নয় যে, এক বছর দিলে আর পরবর্তিতে দিতে হবে না।
৪. যার উপর কুরবানী ওয়াজিব তার নিজের নামেই কুরবানী দিতে হবে।
৫. জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিক কুরবানী করা যায়। রাতেও কুরবানী করা যাবে, তবে দিনে করা উত্তম ।
৬. কুরবানীর বৈধ পশু হলো- ১. উঠ, যার বয়স পাঁচ বছর পূর্ন হতে হবে।
২. গরু ও মহিষ, যার বয়স দুই বছন পূর্ণ হতে হবে।
৩. ভেড়া, দুম্বা ও ছাগল যার বয়স এক বছর পূর্ণ হতে হবে। তবে ছয় মাসের ছাগল যদি এক বছরের ন্যায় মোটা তাজা মনে হয় তবে তা দ্বারাও কুরবানী করা যাবে।

কুরবানীর জন্য অযোগ্য পশু-
১. উপরোক্ত ৬ শ্রেণির পশু ছাড়া অন্য যে কোন পশু কুরবানীর অযোগ্য। ২. উভয় বা এক চোখ অন্ধ পশু। ৩. লেংড়া বা খোড়া পশু
৪. অতিশয় দুর্বল পশু। ৫. দাতহীন পশু । ৬. জন্মগত কান নেই যে পশুর। ৭. যে পশু ময়লা আবর্জনা বা মলমুত্র ভক্ষণ করে। ৮. যে পশুর এক-তৃতীয়াংশ কান কাটা। ৯. যে পশুর এক-তৃতীয়াংশ লেজ কাটা।

কুরবানীর আরও কিছু মাসয়ালা :
১. কুরবানীর গোসত নিজে খাবে ও অন্যদের মাঝে বন্টন করতে হবে। তবে তা তিন ভাগ করে একভাগ নিজে, একভাগ আত্মীয়-স্বজন ও একভাগ অসহায়, গরীবদের দান করতে হবে। ২. কুরবানীর উদ্দেশ্যে মানত হলে তা নিজে খেতে পারবে। তবে শুধুমাত্র মানত হলে তা নিজে খাবে না, বরং সমস্ত গোসত সদকা করতে হবে। ৩. ইচ্চা করলে কুরবানীর সব গোসত বিলিয়ে দেয়া যাবে। ৪. বিক্রি করা বৈধ নয়। ৫. মুসলিম অমুসলিম সকলকে কুরবানীর গোসত দেয়া যাবে। ৬. কুরবানীর গোসত থেকে মুজুরী পরিশোধ বৈধ নয়। ৭. অংশীদারের ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা। ৮. অনুমান করে বন্টন নয়। ৯. ইচ্ছাকৃত কমবেশি করলে সকলের কুরবানী বাতিল হয়ে যাবে। ১০. চামড়া সদকা করতে হবে। ১১. জুতা বা ব্যাগ তৈরি করে নিজে ব্যবহার করা যাবে। ১২. বিনিময় বা বিক্রি করে উপকার লাভ করা যাবে না। ১৩. ফকির বা অভাবী, মিসকিন বা নি:স্ব, অমুসলিমের মন জয় করা উদ্দেশ্যে, সম্বলহীন পথিক, আল¬াহর রাস্তায় সংগ্রাম কারী, ইসলামী দাওয়াত বা প্রচারে, অনাথ, এতিমদের মাঝে কুরবানীর পশুর চামড়া বা তার মূল বন্টন করা যাবে। ১৪. নিজের মাল থেকে সন্তানের কুরবানী বা আকিকা ওয়াজিব নয় তবে দেয়া যাবে। ১৫. সুবহে সাদিকের পরই কুরবানী শুরু করা যাবে, আর শেষ সময় ১২ই জিলহজ সুর্যাস্ত পর্যন্ত।

কুরবানির শিক্ষা :
সামর্থবানদের জন্য কুরবানী করার গুরুত্ব বর্ণনা করে নবী (সা.) বলেছেন-‘সামর্থ থাকার পরও যদি কেউ কুরবানী না করে তবে সে যেন আমাদের ইদগাহে না আসে’। কুরবানীর প্রথম শিক্ষা হলো ‘তাকওয়া’ অর্জন করা। দ্বিতীয় শিক্ষা হলো, ত্যগের মানসিকতা অর্জন করা।
এছাড়াও কুরবানির অন্যতম শিক্ষা হলো- মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ হুকুম-আহকাম পালন করতে হবে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে; শুধুমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্যে। লোক দেখানোর ও সুনাম অর্জনের জন্য নয়। এ ব্যপারে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের শরীর ও চেহারার প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করেন না, বরং তোমাদের মনের ও কর্মের দিকে দৃষ্টিপাত করেন (সহীহ মুসলিম)। শুধু তাই নয়, পশু কুরবানির সাথে সাথে নিজের আমিত্ব ও বড়ত্বকেও কুরবানি করতে হবে। কুরবানির পশুর গোশত যেমন গরিব মিসকিন মুসলমান ভাইÑবোনদের মধ্যে বিতরণ করা হয় তেমনি বিপদ-আপাদেও তাদের পাশে থাকতে হবে। হযরত ইবরাহিম (আ.) যেমন আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য নিজের সন্তানকে কুরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন তেমনি ভাবে আমাদেরকেও আল্লাহর সকল হুকুম-আহকাম পালনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেছেন, ‘কুরবানীর প্রবাহিত রক্ত আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু’টি কুচকুঁচে কালো ছাগলের চেয়ে অধিক প্রিয়। (সুনান বায়হাকী) মহানবী (সা.) আরও বলেছেন ‘তোমরা কুরবানী কর, কেননা কুরবানীর পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে রয়েছে একটি করে নেকী।’ তাই আসুন, কুরবানি করার মধ্যদিয়ে মহান রবের সন্তুষ্টি ও অগণিত নেকি হাসিলের আমল জারি রাখি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরবানি উদ্দেশ্য ও শিক্ষা সামনে রেখে কুরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।