ইসলামে সময়ের সঠিক বন্টন

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের একাধিক জায়গায় দিন-রাতের কসম করেছেন। রাতদিনের কসম করে বলেছেন, ‘শপথ রাতের, যখন তা আচ্ছন্ন করে। শপথ দিনের, যখন তা উদ্ভাসিত করে।’ (সুরা আল লাইল : ১-২)। এখানে রাত ও দিনের কসমে বান্দাদের কল্যাণের চিন্তা ও গবেষণার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফজর ও ১০ রাতের কসম করে এরশাদ করেছেন, ‘শপথ ফজরের, শপথ ১০ রাতের।’ (সুরা ফজর : ১-২)। অন্য আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ‘শপথ সকাল ও পূর্বাহ্নের; শপথ রাতের, যখন তা গভীর হয়।’ (সুরা দোহা : ১-২)। সময়ের কসম করে এরশাদ করেছেন, ‘সময়ের শপথ, নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত।’ (সুরা আসর : ১-২)। এসব আয়াত দ্বারা সময়ের প্রতি অপরিসীম গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
নবী মুহাম্মাদ (সা.) প্রতিদিন সকালে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আজ দিনের প্রথম অংশকে আমার জন্য উপকারী বানিয়ে দিন, তার মধ্যাংশকে সাফল্যমন্ডিত করুন এবং শেষাংশকে শুভ করুন।’ অসংখ্য হাদিসে সময়ের মূল্য ও জীবনের গুরুত্ব প্রদানের তাগিদ রয়েছে। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয় আসার আগে গনিমত মনে করো; (১) বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, (২) অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, (৩) দাি দারিদ্রের আগে সচ্ছলতাকে, (৪) কর্মব্যস্ততার আগে অবকাশকে এবং (৫) মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (সুনানে বায়হাকি : ১০২৪৮)।
সময় অতি দামি : সময় সবকিছুর তুলনায় দামি। এমনকি সময় সোনার চেয়েও দামি। এ কারণেই জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এসে মানুষ আফসোস করে, যদি আরেকটুখানি সময় দেওয়া হতো তাকে! এরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্তুতি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণে উদাসীন না করে। যারা উদাসীন হবে, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি, মৃত্যু আসার আগে তোমরা তা হতে ব্যয় করবে। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার রব! আমাকে আরও কিছুকালের জন্য অবকাশ দিলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ (সুরা মুনাফিকুন : ৯-১০)।
বর্ণিত আছে, একবার রাসুল (সা.) কে প্রশ্ন করা হলো, ‘সৌভাগ্যবান কারা?’ তিনি বললেন, ‘যারা দীর্ঘায়ু লাভ করে তা নেকআমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করেছে।’ পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, ‘দুর্ভাগা কারা?’ তিনি বললেন, ‘যারা দীর্ঘায়ু পেয়ে তা বদআমলে কাটিয়েছে বা আমলহীন অতিবাহিত করেছে।’ (তিরমিযি : ২৩২৯)।
সময় ও জীবন আল্লাহর অমূল্য দান। সময়ের ইতিবাচক ব্যবহারই জীবনের সফলতা। সময়ের অপচয় ও অপব্যবহার জীবনের ব্যর্থতা। সময়ের যথাযথ ব্যবহার না করা বা অপব্যবহার করার জন্য জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহর দরবারে। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘শেষ বিচারের দিনে প্রতিটি মানুষ পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া এক কদমও নড়তে পারবে না। তা হলো, তার জীবনকাল কী লক্ষ্যে কাটিয়েছে? যৌবনকাল কী কাজে ব্যয় করেছে? কোন পথে আয় করেছে? কী কাজে ব্যয় করেছে? জ্ঞান অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করেছে কি-না?’ (তিরমিযি : ২৪১৬)।
সময়ের এত গুরুত্ব হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই এ ব্যাপারে উদাসীন। অথচ পবিত্র কুরআন বলছে, ‘প্রাচুর্য্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যতোক্ষণ না তোমরা সমাধিগুলো দেখতে পাও (তোমাদের মৃত্যু হয়)। এটি কখনও সঙ্গত নয়; অচিরেই তোমরা জানতে পারবে। আবারও বলি, এটি মোটেই সমীচীন নয়; তা তোমরা অনতিবিলম্বে জানতে পারবে। না, তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা মোহগ্রস্থ হতে না। তোমরা (সময়ের প্রতি উদাসীন ও কর্মে অবহেলাকারীরা) অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে (তাতে প্রবেশ করবে)। অবশ্যই তোমরা জাহান্নাম চাক্ষুস দেখে (তাতে প্রবেশ করে তার শাস্তি ভোগ করে) প্রত্যয় লাভ করবে। অতঃপর অবশ্যই সেদিন তোমাদের প্রদত্ত সব নেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা তাকাসুর : ১-৮)।
সময়ের অপব্যবহার : আমাদের সমাজে গিবত ও পরনিন্দায় সময় কাটানো, টিভি-মোবাইল দেখে সময় কাটানো, হারাম গান-বাজনায় মত্ত থেকে সময় কাটানো, গল্প-গুজবে সময় কাটানো হরহামেশা ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। অথচ মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা নারীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহতায়ালা তাদের জমিনে ধসিয়ে দেবেন এবং তাদের কিছু লোককে বানর ও শূকরে রূপান্তরিত করবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০২০)।
বর্তমানে আমরা সময়ের মূল্য দিই না, সময়ের মূল্য বুঝি না। কিন্তু ইসলামের সব কর্মপদ্ধতিতে সময়ের মূল্য অপরিসীম। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলে পৃথিবীর কোনো জীবজন্তুকেই রেহাই দিতেন না; কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারপর তাদের সময় পূর্ণ হলে তারা জানতে পারবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা ফাতির : ৪৫)। জীবন চলার বাঁকে বাঁকে সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ মানুষ ব্যাধি ও জরাগ্রস্থ হয়ে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই সময় থাকতে এখনই সময় সচেতন হতে হবে। আল্লাহর জিকির ও নেক আমলে সময় দিতে হবে।