Type to search

৯৮ শতাংশ মামলা টেকেনি

জাতীয়

৯৮ শতাংশ মামলা টেকেনি

অনলাইন ডেক্স ;

প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পাবলিক পরীক্ষায় অপরাধের ঘটনায় করা মামলার বেশির ভাগই প্রমাণ করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। গত ১৩ বছরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে করা ৪৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১টির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, শতকরা হিসাবে ২ দশমিক ২২ ভাগ। অর্থাৎ ৯৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ মামলার আসামিরা অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন।

ঢাকার সিএমএম আদালতের দৈনন্দিন কার্যতালিকাসহ বিচারসংক্রান্ত নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

এখন করণীয় হলো নতুন অপরাধটা বিদ্যমান দণ্ডবিধিতে একটা বা দুইটা উপধারার মাধ্যমে যোগ করে দেওয়া।
শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
২০০৯ থেকে ২০২১ সাল—এই ১৩ বছরে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় মোট ২০০টি মামলা হয়। এসএসসি, এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি, বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার (ব্যাংক, বিসিএস ইত্যাদি) প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পরীক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগে এসব মামলা হয়। এগুলোর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৫টি মামলার। মাত্র একটি মামলায় এক আসামির পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হয়েছে।

কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্তে দুর্বলতা, ‘ভুল আইনে’ মামলা ও অভিযোগপত্র দেওয়া, সাক্ষীকে হাজির না করায় আসামিরা অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন।

পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনটি ১৯৮০ সালের। প্রশ্নপত্র ফাঁস, বইপত্র কিংবা যান্ত্রিক উপায়ে পরীক্ষার্থীকে সহায়তা করা, অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়া, ভুয়া সার্টিফিকেট বানানো ও পরীক্ষায় বাধা দেওয়ার মতো অপরাধে এ আইনে মামলা করা হয়। তবে গত কয়েক বছরে ডিজিটাল মাধ্যম (ডিভাইস ও অ্যাপস) ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনেও মামলা হয়েছে। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা হচ্ছে। এ দুটি আইনে করা মামলাগুলো ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ঢাকার সিএমএম আদালতে বিচারাধীন।

পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে ২০০৯ সালে ঢাকায় দুটি মামলা হয়। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩৩। এই ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৬টি মামলা হয়েছে ২০১৪ সালে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৩টি মামলা হয় ২০১৮ সালে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে মামলা হয় ৩টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৩ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ জন শিক্ষার্থীসহ ১২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে পৃথক দুটি আইনে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এর মধ্যে পাবলিক পরীক্ষা আইনে করার মামলাটির বিচার শুরু হয়েছে। অপরটি সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।

৯৮% মামলায় কারো সাজা হয়নি
ঢাকার সিএমএম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া ৪৫টি মামলার মধ্যে ৪৪টিতেই কোনো আসামির সাজা হয়নি। অর্থাৎ ৯৮ শতাংশ মামলাই টেকেনি।

এসব মামলার মধ্যে ১৮টির আসামিরা অভিযোগ গঠনের আগেই অব্যাহতি পান। ১৫টিতে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ১১টিতে আদালত পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণের পর আসামিরা খালাস পান।

নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের করা মামলা রয়েছে পাঁচটি। পরীক্ষার্থীকে লিখিত কাগজ সরবরাহ এবং মৌখিক বা যান্ত্রিক উপায়ে সহায়তা করার অভিযোগে মামলার সংখ্যা ৩১। প্রকৃত পরীক্ষার্থী না হয়েও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অপরাধের মামলা রয়েছে ছয়টি। আর ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরির অভিযোগের মামলার সংখ্যা ৩।

২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্য নেওয়ার সময় ধরা পড়েন কে এম রেজওয়ানুল এহসান, ইফরাতুন কাউসার ও ফারহা ফারজানা। এ ঘটনায় করা মামলায় তিন আসামিকে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর খালাস দেন ঢাকার সিএমএম আদালত। রায়ে আদালত বলেন, মাত্র একজন সাক্ষীকে হাজির করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। জব্দ করা আলামতও আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।

এ বিষয়ে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পাবলিক পরীক্ষায় অপরাধের ঘটনায় করা মামলার বেশির ভাগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, এ তথ্য তাঁকে জানানো হয়নি। বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন।

২০১৮ সালের ১৩ মার্চ ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় ধরা পড়েন ‘ভুয়া পরীক্ষার্থী’ আবিদা। এ ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৩–ক ধারায় মামলা করা হয়। ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর আসামিকে অব্যাহতি দেন আদালত। রায়ে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে পাবলিক পরীক্ষাসংক্রান্ত অপরাধ হয়নি। এটি ছিল চাকরির পরীক্ষা। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের কোনো উপাদান নেই।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রমনা থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, আসামি অব্যাহতি পেয়েছেন কি না, সেটা তাঁরা জানা নেই। এ ছাড়া চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার অপরাধ যে পাবলিক পরীক্ষা আইনের অপরাধ নয়, সেটিও তিনি জানেন না।

অভিযোগ গঠনের আগেই আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন, এমন সাতটির মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঘটনা চাকরির পরীক্ষাসংক্রান্ত অপরাধের, কিন্তু মামলা হয় পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে। এ কারণে চারটি মামলার আসামিরা অব্যাহতি পান। আর যথাযথভাবে মামলার জব্দ তালিকা প্রস্তুত না করার কারণে আরও তিনটি মামলার আসামি অব্যাহতি পেয়েছেন।

ঢাকা মহানগরের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের সংজ্ঞায় পড়ে না, এমন অপরাধের মামলা ওই আইনে হয়ে থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে।

আইনটির ১-ঘ ধারায় বলা হয়েছে, ‘“পাবলিক পরীক্ষা” অর্থ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ড কর্তৃক অনুষ্ঠিত, পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত বা সংগঠিত হয় বা হতে পারে এরূপ কোনো পরীক্ষা।’ এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, চাকরির পরীক্ষা ‘পাবলিক পরীক্ষা’ নয়।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের যেসব ব্যর্থতায় আসামিদের সাজা হচ্ছে না, সেসব কারণ চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তাঁর মতে, আইনে ‘পাবলিক পরীক্ষা’র সংজ্ঞার মধ্যে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাসহ এ–সংক্রান্ত অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ওয়্যারলেস অপারেটর পদের নিয়োগ পরীক্ষার সময় গ্রেপ্তার হন মেহেদী শামীম। অভিযোগ, তিনি পরিচয় গোপন করে আতিকুর রহমান সেজে পরীক্ষায় অংশ নেন। এ ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৩–খ ধারায় মামলা হয়। ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর এ মামলার রায়ে আসামিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন আদালত। রায়ে বলা হয়, আসামির বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৩–খ ধারার অভিযোগ গঠনের উপাদান নেই। তবে আসামির বিরুদ্ধে প্রতারণার (দণ্ডবিধির ৪১৯ ধারা) সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। আসামিকে অভিযোগ পড়ে শোনানো হলে তিনি দোষ স্বীকার করায় ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন আদালত।

তদন্তের দুর্বলতার কারণে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের নিষ্পত্তি হওয়া বেশির ভাগ মামলারই অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র উপকমিশনার (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মোহাম্মদ ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এটা তাঁর জানা নেই।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, পুলিশ দণ্ডবিধি জানে এবং দণ্ডবিধির অপরাধগুলো ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী তদন্ত করা, সাক্ষী জোগাড় করা—সবই তারা জানে। তাঁর মতে, ‘এখন করণীয় হলো নতুন অপরাধটা বিদ্যমান দণ্ডবিধিতে একটা বা দুইটা উপধারার মাধ্যমে যোগ করে দেওয়া। যেমন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অপরাধটা দণ্ডবিধির ৪০৫ ধারায় (অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ) একটা উপধারা হিসেবে যোগ করে দিলেই হয়।

সূত্র : প্রথম আরো :