Type to search

সীমান্ত থেকে ধেয়ে আসছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ভারতের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে: ডা. লেলিন চৌধুরী 

জাতীয়

সীমান্ত থেকে ধেয়ে আসছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ভারতের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে: ডা. লেলিন চৌধুরী 

অপরাজেয়বাংলা ডেক্স : বিশেষ সাক্ষাৎকারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেছেন, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যথেষ্ট কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে করোনার সংক্রমণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা আছে।

সংক্রমিত এলাকাগুলোতে শুধু লকডাউন কঠোর দিলেই হবে না, সঙ্গে টেস্টও করতে হবে।

ঢাকা,নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে সংক্রমণ ক্রমহ্রাসের কারণ ভ্যাকসিনেশন, মাস্ক পরার প্রবণতা এবং জনগণের একটা অংশের সংক্রমিত হয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়া।

মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে কঠোর লকডাউন ছাড়াও করোনা সংক্রমণ কমানো সম্ভব।

আশার জায়গা হচ্ছে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তা এদেশের মানুষের আছে। তাই করোনার এই তীব্র আঘাতেও তারা বিচলিত বা ভেঙে পড়েনি। ফলে দেশবাসীর সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করে আমরা অবশ্যই সামনে এগিয়ে যাবো।

করোনা সংক্রমণের জটিল একটা পর্যায়ে আমরা এখন আছি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ বড় বড় শহরগুলোতে করোনা প্রবলভাবে ছিলো। সেসব জায়গা থেকে মফস্বলে ছড়িয়ে পড়তো। কিন্তু এখনকার ভারতীয় বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে এবং তা ক্রমাগতভাবে কেন্দ্রের দিকে ধেয়ে আসছে।

ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আগের ভাইরাসের চেয়ে বেশি সংক্রমণশীল। যারা সংক্রমিত হচ্ছেন তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের অক্সিজেনের দরকার হচ্ছে। আগে বড় শহরগুলোতে লকডাউন দিলে সংক্রমণ ধারা প্রতিরোধ সম্ভব হতো। কিন্তু এখন বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় এলাকায় লকডাউন দিতে হচ্ছে। ভ্যাকসিনেশন বন্ধ হওয়ায় মানুষের মধ্যে একধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে। আগে মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাস ছিলো, আমরা ভ্যাকসিন পাচ্ছি, সংক্রমণ খুব দ্রæত নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। সেই বিশ্বাসের জায়গায় একটা চিড় ধরেছে।

করোনা সংক্রমিত অঞ্চলগুলোতে কঠোর লকডাউন দেওয়া প্রয়োজন। তবে লকডাউন দিয়ে বসে থাকলে হবে না, যাদের মধ্যে করোনার উপসর্গ আছে এবং তাদের কাছাকাছি এসেছে তাদের সকলকেই টেস্টের আওতায় আনার জন্য টেস্ট অভিযান পরিচালনা করা দরকার।

মানুষকে করোনা টেস্টের আওতায় আনার জন্য সর্বত্র মাইকিং করা দরকার। কারণ আমরা দেখেছি শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত মানুষ করোনা টেস্ট করতে আগ্রহী হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনের উপসর্গ থাকলেও তারা টেস্ট করতে আগ্রহী হয় না। তাদের আগ্রহী করার জন্য টেস্টের মূল্য বাতিলসহ মাইকিং করা প্রয়োজন। এজন্যে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগানো প্রয়োজন। তারা লোকজনকে উৎসাহিত করে টেস্ট সেন্টারে নিয়ে আসবে।

করোনাক্রান্ত পরিবারের সঠিক কোয়ারেন্টাইনের স্বার্থে স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে বাজার-সদাই করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। যেসব পরিবারের অর্থনৈতিক সামর্থ্য দুর্বল, তাদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করাটাও অত্যন্ত জরুরি। বড় শহরগুলোতে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে যদি মানুষকে উৎসাহিত বা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে করোনাকে প্রতিরোধের দেয়াল গড়ে তুলতে পারবো।

এলাকাভিত্তিক লকডাউনগুলো শিথিলভাবে প্রয়োগ করা হলে উদ্দেশ্য বিঘিœত হবে। কোথাও কোথাও এলাকাভিত্তিক লকডাউন কঠোরভাবে হচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও হচ্ছে না। এখনো চোরাইপথে ভারত থেকে লোকজন যাতায়াত করছে। দেখা যাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অথবা যেখানে লকডাউন চলছে, সেখান থেকে লোকজন অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। এই কারণে লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার।

লকডাউন দেওয়ার ফলে চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা সংক্রমণের পরিমাণ কমে আসছে। তবে লকডাউন তুলে দেওয়ার পরেও স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্য কঠোর হতে হবে, জনসমাবেশ অথবা ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

আমাদের চারদিকে ভারত। সেখান থেকে লোকজন বৈধ, অবৈধ সহ নানান ভাবে যাতায়াত করে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। এজন্য সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যথেষ্ট কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার ছিলো। নতুন সংক্রমণের ৮০ শতাংশই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট, এটা আইইডিসিআর না বললেও আমরা অনুমান করতে পারি। এ ব্যাপারটিই আমাদের আতঙ্কিত করছে। কারণ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট অন্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক। ফলে এখন যে হারে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো করোনা সংক্রমণ হচ্ছে, কেন্দ্রের দিকে ধাবমান হচ্ছে, তা যদি এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে হঠাৎ করে সংক্রমণ বেড়ে গিয়ে ভারতের মতো আমাদের দেশেও একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যেতে পারে। এটাই আসলে আশঙ্কার মূল জায়গা।

এখনো করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বগতিতে আছে। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে এসে শক্তি হারিয়েছে কিনা তা বোঝার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়নগঞ্জের মতো বড় শহরগুলো করোনা সংক্রমণ কম মনে হওয়ার কারণ বড় শহরগুলোর একটি অংশের মানুষ ইতোমধ্যেই করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একইধরণের করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, শহরগুলোর মানুষের মধ্যে মাস্ক বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বড় শহরগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের মানুষ ইতোমধ্যেই টিকা নিয়েছেন। ফলে এই তিন-চার ধরনের প্রভাবকের কারণে ক্রমাগতভাবে করোনার সংক্রমণ কমে আসছে।

ভ্যাকসিন ক‚টনীতিতে প্রথম দিকে আমরা সফল ছিলাম। এই সাফল্যে আমরা এতোটাই বুঁদ হয়েছিলাম যে, পরবর্তী সময়ে টিকা নিয়ে ক‚টনেতিক তৎপরতায় গতি ছিলো না বা প্রয়াস কম ছিলো। যার ফলে আজকে আমাদের টিকা সংকটে পড়তে হয়েছে।

রাশিয়া আমাদের গত বছরই স্পুটনিক-ভি টিকা বাংলাদেশেকে দেওয়া এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমরা কালক্ষেপন করে উত্তর দিইনি বা সহযোগিতার সেতু তৈরি করিনি। ফেব্রæয়ারি মাসের তিন তারিখে চীন আমাদের ভ্যাকসিন দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলো, দিয়েছিলো কো-প্রডাক্টশনের প্রস্তাব। কিন্তু সেই প্রস্তাবও গ্রহণ করতে আমরা তিন মাস লাগিয়েছি। এখন পর্যন্ত আমরা চীন বা রাশিয়ার সঙ্গে কোনো চুক্তিতে উপনীত হতে পারিনি। আমাদের কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতায় চীনের সঙ্গে চুক্তির নন-ডিসক্লোজার অংশ চুক্তি হওয়ার আগেই প্রকাশ হয়, ফলে একটা হযবরল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। [১৯] অক্সফোর্ডের টিকা প্রাপ্তির জন্য সেরাম ইনস্টিটিউটের পরে টিকা যোগাড়ে ব্যাপারে আমরা আসলে সময়ক্ষেপন ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছি। একইসঙ্গে দ্যোদুলমনতা বা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছি, যা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। আমরা আশা করবো স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় এই অনভিপ্রেত জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে।

টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য যে দূরদর্শিতা দরকার, আমাদের কর্তৃপক্ষের অনেকের মধ্যে এর অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এমনটি হচ্ছে বলেই নন-ডিসক্লোজার চুক্তি প্রকাশ করার মতো বোকামি আমরা করতে ফেলতে পারি।

করোনাকালে এদেশের মানুষের কষ্ট ও ক্ষোভের জায়গাটি হচ্ছে, আমাদের যে সম্পদ ও সামর্থ্য আমাদের রয়েছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় তা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। পক্ষান্তরে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা ছিলো আঁতকে ওঠার মতো। দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিলো দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা। কিন্তু সেটা হয়নি। যে তদন্ত কমিটি হয়েছে, সে রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।

আমরা বারবার বলে আসছি স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা তদন্ত করার জন্য স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। একইসঙ্গে জনগণকে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হোক এই তদন্ত প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। এর মধ্যদিয়ে জবাবদিহিতা, সুশাসনের পথ সুগম হবে। একইসঙ্গে রাষ্ট্র দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা, টিকার অপর্যাপ্ততা অথবা লকডাউন শিথিলভাবে পালন করার পরও আমরা করোনার সংক্রমণ অনেকাংশেই ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। এটি আমাদের জন্য বড় সফলতা। টিকা নিয়ে যে তৎপরতা এখন আমরা লক্ষ্য করছি, আশা করি খুব শিগগিরই সংকট দূর হবে। টিকা প্রাপ্তিও নিশ্চিত হবে।সূত্র,আমাদের সময়.কম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *