Type to search

শিশু মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেহ’র গল্প

জাতীয়

শিশু মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেহ’র গল্প

 পিচ্চি ,কি নাম তোর?
– সালেহ, স্যার।
– শুধুই সালেহ?
– আবু সালেহ, স্যার।
– পিচ্চি, নিজের নামটাও তো এখনো ঠিক করে বলতে পারিস না, লিখাপড়া করিস?
– জী স্যার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি।
– গুড, মন দিয়ে পড়াশোনা করিস। কে বলেছে তোকে যুদ্ধে আসতে? মায়ের কাছে ফিরে যা।
কিন্তু আবু সালেহ অনড়। বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। রিক্রুটিং অফিসার এবার একটু বিরক্তি নিয়ে বললেন, আবু যুদ্ধ কোন কানামাছি খেলা না। এতে জান নিতে হয়, আবার জান দিতেও হয়। নিতান্তই যদি ফিরে না যেতে চাস, তাহলে এখানে রান্নাবান্নার কাজে হেল্প করিস।
– স্যার যুদ্ধ কানামাছি নাকি আর কী আমাকে বুঝাতে হবেনা। বয়স ১৩ হলেও নিজের চোখে দেখেছি যুদ্ধ কী? পাইক্কারা আমাদের গ্রামটা কিভাবে জ্বালিয়ে দিয়েছে, শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে হাসতে হাসতে গুলি করেছে তা স্বচক্ষে দেখার পর যুদ্ধ কি তা আমাকে শিখতে হবেনা। বাবুর্চিগিরি করতে আগরতলা আসিনি। ট্রেনিং নিতে এসেছি। বয়সের কারনে ট্রেনিং যখন করাবেন না, তখন এখানে বাবুর্চিগিরি না করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফিরে যাব, দা ছুড়ি যা পাই তা দিয়ে অন্তত একজন পাইক্কার জান নিয়ে নিজের জানটা দিয়ে দিব- এটাই আমার মুক্তিযুদ্ধ স্যার। বলেই অভিমানী আবু সালেহ কান্নায় ভেঙে পড়ে ফিরে যেতে গেলে রিক্রুটিং অফিসার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মনে মনে ভাবলেন কী বারুদরে বাবা! মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ওখানে বস,সবার পরে তোর নাম এন্ট্রি করব।
চোখে বিদ্রোহের আগুন, বুকে সাহস, যুদ্ধ করার একাগ্রতা দেখে কিশোর আবু সালেহকে রিক্রুট করে মেঘালয়ে পাঠিয়ে দিলেন ট্রেনিং নিতে।
ট্রেনিং নেয়ার পর কমান্ডার জিজ্ঞেস করলেন- আবু সম্মুখ সমরে যাবি? রিস্ক আছে কিন্তু।
– স্যার কোন রিস্ক নেই। দোয়া করিয়েন। আপনার দেয়া ট্রেনিং এর মান রেখে যাতে কিছু পাঞ্জাবি খতম করতে পারি।
কমান্ডার দলনেতাকে ডেকে তাঁর হাতে আবু সালেহকে তুলে দিয়ে বললেন, তোমার হাতে একটা বারুদের গোলা দিচ্ছি, খেয়াল রেখো ওর। এরকম বারুদ যতদিন দেশে থাকবে, যুদ্ধে কখনো হারব না আমরা। আল্লাহর নাম নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড় বলেই আবু সালেহর মাথায় আদর করে চোখের জল লুকোতে উল্টো দিকে ঘুরে অন্য কাজে চলে গেলেন। কমান্ডারদের চোখের জল কাউকে বুঝতে দিতে নেই।
রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়লো আবু সালেহর দল। চন্দ্রপুর নামক গ্রামে সম্মুখ সমরে। দু’পক্ষের প্রচন্ড গোলাগুলি হচ্ছে। আবু সালেহর দলনেতা বুঝতে পারলেন, পাকি বাহিনীর ভারী ও ব্যাপক অস্ত্রের সাথে আর বেশিক্ষণ টিকতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে কৌশল হবে পিছনে হঠা। কিন্তু পিছনে হঠার জন্য কাউকে না কাউকে কাভার দিতে হবে। আবু সালেহ বুক চেতিয়ে বলল, আপনারা পিছনে হটেন আমি কাভার করব। দলনেতা নাছোড়বান্দা, তোকে রেখে গেলে কমান্ডার স্যার আমাকে মেরে ফেলবে।
– কমান্ডার স্যারকে বলিয়েন, আমি পিছু হঠার জন্য না, পাকিস্তানি মারার জন্য ট্রেনিং নিয়েছি।আপনারা হঠেন, নইলে সবাইকে মরতে হবে। বলেই বয়সের তুলনায় অনেক ভারী অস্ত্র নিয়ে গলা অব্দি বাংকারে ডুবিয়ে একনাগাড়ে গুলি চালিয়ে যেতে লাগলেন। সহযোদ্ধারা নিরাপদে সরে গেলেন কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া।
চারিদিকে অন্ধকার। মুহুর্মুহু গুলি চলছে। পাকি বাহিনী ভাবল মুক্তিবাহিনী অস্ত্র ও সংখ্যায় অনেক। তারা হতাহত ও হল। পরে পাকিরা পিছনে সরে গেল নিজেদের নিরাপদ স্থানে।
গোলাগুলি শেষ হলে দলনেতা এলেন তাঁর বারুদযোদ্ধাকে উদ্ধার করতে। ভাবছিলেন হয়ত আবু সালেহ শহীদ হয়েছেন। মনে মনে ভাবছিলেন, কমান্ডার আমার হাতে তুলে দিলেও আমি রক্ষা করতে পারিনি দেশপ্রেমিক এই শিশু যোদ্ধাকে। কিন্তু বাংকারে এসে তো অবাক। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেহ বাংকারে চুপচাপ বসে আছেন। দলনেতা দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলে আবু সালেহ’র উৎসুক প্রশ্ন – কয়টা হানাদার খতম করেছি?
বীর আবু সালেহরা কখনো পালিয়ে যাননি,বরং ঢাল হয়ে রক্ষা করেছেন সহযোদ্ধাদের। খ্যাতি পাননি, তার জন্য লালায়িতও ছিলেন না। চেতনার মদিরাতে আজ যারা প্রচন্ড রকম চেতিত, তারা জানেওনা কোন চেতনায় বলিয়ান হয়ে আবু সালেহ রা দেশকে স্বাধীন করেছিলেন।
স্যালুট আবু সালেহ সহ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের।বীর ভুমির বীর সন্তান –  অপরাজেয় বাংলার পক্ষ থেকে সশ্রদ্ধ সালাম আপনাদের প্রতি ।
(সংগৃহীত)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *