Type to search

রাশিয়া–ইউক্রেন চলমান সংকট নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার ভি মান্টিটস্কির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ।

জাতীয়

রাশিয়া–ইউক্রেন চলমান সংকট নিয়ে ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার ভি মান্টিটস্কির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ।

অনলাইন ডেস্ক:আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি: ২০১৪ সালে অসাংবিধানিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কিয়েভে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসে। আট বছর ধরে তাদের হাতে নিষ্পেষিত ও গণহত্যার শিকার হয়েছে বহু মানুষ। তাদের নিপীড়ন থেকে লোকজনকে রক্ষা এই অভিযানের মূল লক্ষ্য। সেই সময় থেকে রুশ ভাষাভাষীসহ দেশটির বেসামরিক লোকজনের ওপর নির্যাতনের জন্য ওই পুতুল সরকার এবং সরকারের কর্মকর্তাদের বিচার, ইউক্রেনের বেসামরিকীকরণ এবং দেশটিকে নাৎসিমুক্ত করাটাও চলমান অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য।

আট বছর ধরে নিজেদের জনগণের ওপর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ বন্ধ, শান্তিপূর্ণ, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উপায়ে দোনবাসে সংঘাতের অবসান এবং মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের সঙ্গে একটি সরাসরি আলোচনা শুরুর জন্য কিয়েভের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এসেছি। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হচ্ছে, কিয়েভের কর্তৃপক্ষ মিনস্ক চুক্তিতে যে অঙ্গীকার করেছিল, পাশ্চাত্যের সমর্থনে সেখান থেকে তারা সরে গেছে। সেখানকার সরকার এখন নিজের কর্মকাণ্ডের দায় দেশটির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে।

এখানে একটি বিষয় জোর দিয়েই বলছি, রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী ইউক্রেনে পরিচালিত বিশেষ অভিযানের সময় শহরগুলোতে মিসাইল, জঙ্গি বিমান কিংবা কামানের গোলার মাধ্যমে কোনো হামলা চালায়নি। মূলত সামরিক স্থাপনা, বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, সামরিক বাহিনীর বিমান উড্ডয়নকেন্দ্র এবং বিমানবাহিনীর ওপর হামলা চালানো হয়েছে।

প্রথম আলো: রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিভিন্ন পক্ষের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কি সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে সংকটকে ঘনীভূত করতে পারে?

আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি: ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেনে বাস্তবে কী ঘটেছে এবং সামগ্রিকভাবে দেশটিতে ও সুনির্দিষ্টভাবে দোনেস্ক ও লুহানস্কে নিজেদের ভূমিকার নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন করেনি। এর পরিবর্তে তারা কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভেবে ভুলবশত নিষেধাজ্ঞার পথে গেছে।

মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক আইনের বিষয়ে কিংবা আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে পশ্চিমের দেশগুলোর একক কর্তৃত্বের অবসান হয়েছে। নিরাপত্তা ও সহযোগিতাবিষয়ক ইউরোপীয় সংস্থার (ওএসসিই) সনদের অষ্টম ধারায় বলা হয়েছে, ৫৭-দেশের ওই জোটে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ইইউ কিংবা ন্যাটোর বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। আবার জোটের কোনো অংশে ওই দুই সংস্থার প্রভাববলয়ের মধ্যে এমনটা ভাবতে পারে না। ইউরোপে যুদ্ধ ও শান্তি নিয়ে সংকট সমাধানের দায়িত্ব ইইউকে কেউ দেয়নি। শুধু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেরই এ নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনি বিশেষ অধিকার রয়েছে।

অথচ দেখুন, নিজেদের দেশ ধ্বংস এবং ইউরোপে অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী ইউক্রেনের উগ্র জাতীয়বাদী সরকারকে বাঁচানোর নীতি অনুসরণ করেছে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র। তারা ইউক্রেনকে সমরাস্ত্র দিয়েছে, নিজেদের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টাদের সেখানে পাঠিয়েছে এবং ব্যাপক পরিসরে সামরিক মহড়া পরিচালিত করেছে। বিশেষ উদ্দেশ্যে তারা ইউক্রেনের ভূখণ্ডকে সামরিকভাবে ব্যবহার করেছে।

রাশিয়া ও রাশিয়ার বন্ধুপ্রতিম দোনেস্ক পিপলস রিপাবলিক (ডিপিআর) এবং লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকের (এলপিআর) বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর এসব বৈরী পদক্ষেপ আমাদের ইতিবাচক অগ্রযাত্রা এবং তাদের সহায়তার ধারাকে রুখে দিতে পারবে না। পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের নীতি অনুসরণ করে আমরাও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।

প্রথম আলো: রাশিয়া কি নিজের অর্থনীতির স্বার্থে পশ্চিমের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে?

আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি: যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ সদস্যভুক্ত দেশের নাগরিক এবং সংস্থাগুলো ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীকে সমরাস্ত্র, জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিচ্ছে। ইউক্রেনের চলমান বিশেষ সামরিক অভিযানের পরিণতির জন্য তাদের দায় নিতে হবে।

ব্রাসেলসের কর্মকর্তারা রাশিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধনের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছেন। তাঁরা রাশিয়ার অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা রুখে দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দুর্বল জায়গাটিতে আঘাত হানার চেষ্টা করছেন।

তাঁদের এ প্রয়াস যে কাজে আসবে না, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত। আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর পদক্ষেপের কড়া জবাব দেব। নিষেধাজ্ঞা কিংবা নিষেধাজ্ঞার হুমকি সত্ত্বেও রাশিয়া নিজের জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর বোঝা উচিত, বিশ্ব অর্থনীতিতে তাদের একক কর্তৃত্ব অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।

প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র সরবরাহ করছে। এটা কি সংকটকে আরও জটিল করে তুলবে?

আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি: ইউক্রেনকে নুতন করে সমরাস্ত্র সরবরাহের প্রস্তুতির বিষয়ে ন্যাটোর কোনো কোনো দেশের বিবৃতিকে আমরা দেশটিতে সামরিক উত্তেজনা বাড়ানোর দায়িত্বজ্ঞানহীন নীতির ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখছি। প্রথমত, এসব পদক্ষেপ ওই দেশগুলোর শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বানের ঠিক বিপরীতমুখী পদক্ষেপ। দ্বিতীয়ত, কিয়েভের কর্তৃপক্ষের জন্য যে সমরাস্ত্র সরবরাহ করা হবে, তা রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধি এবং বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে, যা চূড়ান্তভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি তৈরি করবে। মস্কো বিশ্বাস করে, রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর সরাসরি সংঘাতের প্রেক্ষাপট তৈরি করবে, এমন পরিস্থিতি এবং ঘটনা এড়িয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথম আলো: নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে রাশিয়া ভেটো দিয়েছে। রাশিয়া কি সংকট নিরসনে জাতিসংঘের কোনো ভূমিকা চায় না?

আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি: আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সমুন্নত রাখার মূল দায়িত্ব পালনে নিরাপত্তা পরিষদ ব্যর্থ হচ্ছে—খসড়া প্রস্তাবের উত্থাপনকারীরা এমনটা বলার কারণে রাশিয়া এতে ভেটো দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে সংকট সমাধানের ন্যূনতম প্রয়াস ওই খসড়ায় প্রতিফলিত হয়নি। একই কারণে দুই দিন আগে অন্য একটি খসড়ার বিরুদ্ধে আমরা ভোট দিয়েছি।

যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বিশ্বে নতুন যুদ্ধের ধাক্কা এড়াতে জাতিসংঘ এবং নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিশ্বের শক্তিধর পক্ষগুলো সমঝোতার পক্ষে মত দিয়েছিল। আদর্শিকভাবে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিষয়ে রাজি হলেও কোনো কারণে সবাই একমত হতে ব্যর্থ হলে, কখনো একে অন্যের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি কিংবা স্থায়ী সদস্যদের স্বার্থকে অগ্রাহ্য করা হয়নি। সে জন্য নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যদের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটি কিন্তু সুযোগ নয়। ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে এটা করা হয়েছিল, যা বিশ্বের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য খুব বেশি জরুরি। রাশিয়ার অবস্থানকে অসম্মান এবং অবজ্ঞা করাটা জাতিসংঘের সনদের পরিপন্থী।

প্রথম আলো: আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ কি এখনো খোলা আছে?

আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি: আলোচনার দরজা আমরা বন্ধ করে দিইনি। আমরা আলোচনার টেবিলে বসে নিজেদের কথা বলতে এবং অন্যের কথা শুনতে এখনো তৈরি আছি। তবে এই আলোচনায় পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এটা এখনো আমরা দেখছি না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিজের দেশের নিরাপত্তা এবং আমাদের নিজেদের অঞ্চলের প্রতিরক্ষা সামর্থ্য বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনার চেষ্টাকে পাশ্চাত্যের জোট আগ্রাসী আচরণ হিসেবে দেখছে।

পরিশেষে বলতে চাই, যুদ্ধটা রাশিয়া শুরু করেনি। তবে রাশিয়া যুদ্ধ শেষ করার চেষ্টা করছে। ২০১৪ সালে এই যুদ্ধের শুরু। কিন্তু পাশ্চাত্যের দেশগুলো পুরো সময়জুড়ে এটা অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে আসছে।
সূএ:প্রথম আলো

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *