Type to search

রাজা প্রতাপাদিত্য স্বাধীন যশোর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন

অন্যান্য

রাজা প্রতাপাদিত্য স্বাধীন যশোর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন

ইতিহাসের পাতা থেকে

প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে একটু আলাদাভাবে না বললে যশোরের ইতিহাসের একটা গৌরবময় অংশই না বলা থেকে যাবে। কারণ মোঘল আমলে যশোরে ইনিই প্রধান ব্যক্তি। অনেকে বলে থাকেন প্রাচীন গৌড় রাজ্যের যশ হরণ করে ‘যশোহর’ হয়েছিল। তৎকালীন সময় যশোরের ইতিহাস তাই প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস। প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকাল মাত্র ২৫ বছরের হলেও আজ পর্যন্ত তার গৌরবগাঁথা যশোর খুলনা অঞ্চলে বিদ্যমান।

বিক্রমাদিত্য পুত্র প্রতাপাদিত্যের রাজধানী কোথায় ছিলো তা নিয়ে প্রচলিত ৫ টি মত রয়েছে।

১) সতীশচন্দ্র মিত্রের মতে, প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ধুমঘাটের উত্তরাংশ ছিল; কিন্তু বিক্রমাদিত্যের রাজধানী কোথায় ছিল, তা ঠিক নাই। বেভারিজসহ পাশ্চাত্য লেখকেরা এই মতাবলম্বী।

২) বিক্রমাদিত্যের রাজধানী ধুমঘাটের উত্তরাংশে ছিল এবং প্রতাপের রাজধানী আধুনিক ধুমঘাটের দক্ষিণভাগে অবস্থিত, কিন্তু সে স্থান তখনও ঘোর জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। সাধারণ শিক্ষিত সম্প্রদায় এই মতাবলম্বী।

৩) বিক্রামাদিত্যের রাজধানী উক্ত উত্তরাংশে বা ঈশ্বরীপুর অঞ্চলে ছিল; কিন্তু প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল গঙ্গার মোহনায় সাগরদ্বীপ। এই দ্বীপের অন্য নাম চ্যান্ডিকান দ্বীপ। নিখিলনাথ রায় মহোদয় এই মতের প্রবর্তক।

৪) বিক্রমাদিত্যের রাজধানী তেরকাটিতে বা ১৬৯ নং লটে ছিল; যা তখনও ঘোর অরণ্য মধ্যে অবস্থিত ছিল। প্রতাপের নতুন রাজধানী ঈশ্বরীপুরের কাছে ছিল। কেউ বা বলেন, পুরাতন রাজধানী ঈশ্বরীপুরে এবং নতুন রাজধানী তেরকাটিতে ছিল। তেরকাটির বাসিন্দারা অনেকেই একথা বিশ্বাস করেন।

৫) প্রাচীন রাজধানী মুকুন্দপুর অঞ্চলে এবং নতুন বা ধুমঘাট দুর্গ ঈশ্বরীপুরের সন্নিকটে অবস্থিতএই ৫টি মতের মধ্যে শেষোক্ত মতটি সতীশচন্দ্র মিত্র সঠিক বলে ধারণা করেন। ধুমঘাটে বা ঈশ্বরীপুর অঞ্চলে প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল। এখন যে স্থানকে মুকুন্দপুর বলে, সেখানেই প্রথম বিক্রমাদিত্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার নাম ছিল-যশোহর। পরে প্রতাপের ধুমঘাট রাজধানী সমৃদ্ধিশালিনী হলে, তারও নাম হয়-যশোহর। ক্রমে কীর্তিমন্ডিত এই উভয় রাজধানী পরস্পর মিশে গিয়েছিল এবং আট দশ মাইল নিয়ে সমস্ত স্থানটাই ‘যশোহর’-এই সাধারণ নামে পরিচিত হল। নতুবা যশোহর নামে কোন চিহ্নিত গ্রাম নাই।

১৫৮৭ সালে প্রতাপাদিত্য ঈশ্বরীপুরের কাছে তার নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলেন ও যশোরেশ্বরী দেবীর মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। সেখানেই তিনি ধুমঘাট দূর্গ ও রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। বসন্তরায়ের উদ্যোগে মহাসমরোহে নতুন রাজধানীতে প্রতাপাদিত্যকে অভিষেক প্রদান করা হয়। রাজ্যাভিষেকের সময় বার ভূঁইয়াদের অনেকে যশোরে এসেছিলেন এবং প্রতাপাদিত্যর কাছে বঙ্গের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য একত্রে কাজ করার প্রতিশ্রুতি করেছিলেন। প্রতাপাদিত্য দেখছিলেন যে সম্রাট আকবর আগ্রার রাজদরবার, রাজনীতি ও রাজপরিবারের আত্মকলহ এসব বিষয়ে ব্যাস্ত রয়েছেন এবং এর ফলে সমগ্র ভারতবর্ষে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠেছে। এই সুযোগে প্রতাপাদিত্যও সৈন্যগঠন ও সীমান্ত রক্ষার জন্য সৈন্যবাহিনীকে প্রস্ত্তত করতে শুরু করলেন। প্রধানত যেসকল কারনে, (সতীশচন্দ্র মিত্রের মতে) তিনি যুদ্ধ প্রস্ত্ততি নিয়েছিলেন, তা হলো-

১। আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রাধান্য স্থাপন করা।

২। পাঠানদের পক্ষ সমর্থন করা, যারা মোঘলদের নিকট পরাজিত হয়েছিলেন।

৩। বঙ্গদেশে হিন্দু শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা।

৪। শুধু মোঘলদের নয়, মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুদের পাশবিক নির্যাতন থেকে তার রাজ্যের মানুষকে রক্ষা করা।প্রতাপ ধীরে ধীরে তার নতুন রাজধানী গুছিয়ে নিতে লাগলেন এবং তৎকালীন বঙ্গের অন্যান্য ভূঁইয়াদের সাথে আলাপ করতে লাগলেন যে কিভাবে তারা একত্রিত হয়ে মোঘলদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারেন। ভূঁইয়াদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতাপের এই বিদ্রোহী চেতনার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করলেও অনেকেই দূরত্ব বজায় রাখলেন। এমনকি প্রতাপের একান্ত সহকর্মী হিসেবে পরিচিত বিক্রমাদিত্যের বন্ধু বসন্ত রায়ও এই বিদ্রোহে যোগদান করলেন না। তিনি জানতেন প্রতাপ ও তার দু’একজন মিত্রের মনে যে স্বাধীনতার চেতনার বিকাশ ঘটেছে তা সমগ্র দেশ না জাগলে বিফলে যাবে। তিনি প্রতাপকে এ বিষয়টি বুঝাতে ব্যর্থ হলেন। প্রতাপ তার উপর মনক্ষুন্নও হয়েছিলেন। বসন্ত রায় গঙ্গাতীরের রায়গড় দূর্গে স্থানান্তরিত হন এবং যশোরের ৬ আনা অংশের শাসনকার্য করতে থাকেন। এদিকে প্রতাপ ১৫৯৯ সালে মোঘলদের বশ্যতা অস্বীকার করে যশোরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং এই স্বাধীনতা ঘোষণার কিছু বৎসর আগে প্রতাপাদিত্য তার পিতৃতুল্য বসন্ত রায়কে আনুমানিক ১৫৯৪-৯৫ সালের দিকে হত্যা করে তার নিজ চরিত্রে অমোচনীয় কলঙ্ক লেপন করেন।

কথিত আছে প্রতাপাদিত্য সেসময় নিজ নামে মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পর প্রতাপাদিত্যের নিজ শাসিত রাজ্যেও বহু বিস্তৃত হয়ে পড়েছিলো। ১৬০০ খ্রিঃ প্রতাপের ক্ষমতা ও খ্যাতি পুরো ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে পড়েছিল। কবিবর রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র তাই লিখেছিলেন-

‘যশোর নগর ধাম

প্রতাপ আদিত্য নাম

মহারাজা বঙ্গজ কায়স্থ

নাহি মানে পাতশায়,

কেহ নাহি আটে তায়

ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ

বরপুত্র ভবানীর

প্রিয়তম পৃথিবীর

বায়ান্ন হাজার যার পল্লী

ষোড়শ হলকা হাতি

অযুত তুরঙ্গ সাতি

যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী।’সে সময় সকলে বিশ্বাস করতো যে দৈববল ছাড়া কেউ এমন বলশালী হতে পারে না। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহ কাশী হইতে রাজমহলে আসলেন এবং বঙ্গদেশকে প্রকৃতভাবে মোঘলদের করতলে নিয়ে আনার জন্য সর্বরকম আয়োজন শুরু করেন। প্রায় ২৫ বছর পাঠানরা বঙ্গে পরাজিত হলেও প্রতাপাদিত্য ও অন্যান্য ভূঁইয়াগণের কারণে সেই পরাজয়ে মোঘলদের কোন লাভ হয়নি। তাই আকবর তার সর্বপ্রধান সেনাপতিকে সবরকম সহযোগিতা দিয়ে পুনরায় বঙ্গে প্রেরণ করেন। ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে যশোর অভিমুখে যাত্রা করেন। মানসিংহের এ যাত্রা সম্পর্কে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র বলেন

‘আগে পাছে দুই পাশে দু’সারি লস্কর।

চললেন মানসিংহ যশোহর নগর।।

মজুন্দারে সঙ্গে নিলা ঘোড়া চড়াইয়া।

কাছে কাছে অশেষ বিশেষ জিজ্ঞাসিয়া।’

 

মানসিংহ কালিন্দি নদী পাড় হয়ে বসন্তপুরে ছাউনি করলেন এবং দেখলেন যে প্রতাপাদিত্য তার চারিদিকে সৈন্য সাজিয়ে যুদ্ধের সমস্ত আয়োজন করে রেখেছেন। বসন্তপুর ও শীতলপুরের পূর্বভাগে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। অগনিত দিন ধরে এ যুদ্ধ সংঘটিত হলো এবং মানসিংহ বিজয়ী হয়ে প্রতাপাদিত্যকে বন্দি করেছিলেন। মানসিংহ প্রতাপকে চিনতেন এবং অত্যন্ত ভালোবাসতেন। উড়িষ্যাভিযানে প্রতাপের বীরত্বের কথা তার মনে ছিলো। তিনি যশোর যুদ্ধে বঙ্গীয় বীরের অসাধারণ সমর কৌশলে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি নিজে মহাবীর, তাই বীরত্বের মর্যাদা বুঝতেন। যুদ্ধ শেষে জয়লাভ করলেও তিনি প্রতাপাদিত্যর সাথে সন্ধি করেছিলেন। প্রতাপাদিত্য যশোর রাজ্যের ১০ আনা অংশে ( বাকী ৬ আনা বসন্তরায়ের ছেলে কচু রায়) মোঘলদের সামন্ত রাজা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন।মানসিংহ স্বাধীনতার চিহ্ন পতাকা ও মুদ্রা বিলুপ্ত করবার আদেশ দিয়েছিলেন। মানসিংহের এই অভিযানের কিছু বছর পর ১৬০৯ খ্রিঃ আকবরের পুত্র সম্রাট জাহাংগীর ইসলাম খাঁর নেতৃত্বে পুনরায় বঙ্গে সৈন্য প্রেরণ করেন। সুদীর্ঘ আঁকাবাঁকা নদীপথ পাড়ি দিয়ে মোঘল সৈন্যরা যশোর রাজ্যের সীমান্তে এসে পৌঁছলো। যমুনা ও ইছামতির সঙ্গমে প্রতাপ বাহিনীর সাথে মোঘলদের পুনরায় সংঘর্ষ হয়। তাই প্রতাপের শেষ পতন ইসলাম খাঁর সময় মানসিংহের সময় নয়। প্রতাপাদিত্য মোঘলদের সমন্বিত আক্রমণ প্রতিহত না করতে পেরে আত্মসমর্পণ করেন। ইসলাম খাঁ প্রতাপকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখলেন এবং যশোর প্রদেশকে মোঘল সম্রাজ্যের অন্তর্গত করে নিলেন। এবং যশোর রাজ্যের পতন হলো। শুরু হলো বাংলায় মোঘল যুগ।

তেজস্বিতা, ধর্মনিষ্ঠা ও স্বাধীনতা স্থাপনের চেষ্টা প্রতাপকে এ অঞ্চলের লোকদের নিকটই শুধু নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের কাছে অমর করে রাখলো। গুরুদেব রামদাস স্বামী তাই লিখেছেন-

বলিলে যে বঙ্গদেশী প্রতাপের কথা,

শুন গুরুত্ব তার। তেজোবীর্য্যগুণে

প্রতাপ প্রস্ত্তত ছিলো স্বাধীনতা লাভে,

কিন্তু তা’র জাতি, দেশ না ছিল প্রস্তুত;

জ্ঞাতিবন্ধু বহু তা’র ছিল প্রতিকূল,

তাই হল ব্যর্থ চেষ্টা। মূঢ় সেই নর,

দেশ, কাল , পাত্র মনে না করি’ বিচার,

একা যে ছুটিতে চায়; চরণস্খলনে

নাহি রহে কেহ ধরি’ উঠাইতে তারে।

।এছাড়াও আমরা স্যার জেমস ওয়েস্টল্যান্ডের প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি যে, বিক্রমাদিত্যের এক ছেলে ছিল। যার নাম ছিল প্রতাপাদিত্য। তার সম্পর্কে বলা হতো তিনি ছিলেন পৃথিবীর সকল সুন্দর গুণের অধিকারী। প্রতাপাদিত্য তার পিতার মৃত্যুর পরে যশোরের সকল সম্পদের একমাত্র উত্তরসূরী হয়েছিলেন। তিনি ধুমঘাটে একটি শহরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তার প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেছিলেন সুন্দরবনের সীমানার প­বনভূমি পর্যন্ত এবং ২৪ পরগনা জেলার নিকটবর্তী ইছামতি নদীর পূর্ব সীমা পর্যন্ত। ঐ সময় বাংলা ও বাংলার নিচু অংশ ১২ জন ভূপতিদের মাঝে ভাগ করা ছিল। এই ভূপতিদের বলা হতো বার ভূইয়া। প্রতাপাদিত্য এই বার ভূইয়াদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্পদশালী ও প্রভাবশালী ছিলেন। এই বার ভূইয়াদের সকলেই খাজনা দিত এবং দিল্লী­র সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করত। এই ১২ জন ভূপতিদের মধ্যে রাজা প্রতাপাদিত্য অগ্রাধিকার পেত তার প্রভাব ও প্রতিপত্তির কারণে। দিনে দিনে প্রতাপাদিত্য আরো ক্ষমতাশীল হয়ে উঠলে তিনি দিল্লীর সম্রাটকে খাজনা প্রদান করতে অস্বীকার করেন। আর সে সময়টাতে গোটা বাংলায় এক ধরণের বিশৃঙ্খলা ও বিবাদমান পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল।দিলি­র সম্রাট আকবর অনেকবার সেনাবাহিনী পঠিয়েছেন এই সকল বিদ্রোহ দমনের জন্য কিন্তু সুন্দরবন প্রতাপাদিত্যকে একটি ভালো অবস্থান দিয়েছিলো যার ফলে সে সহজেই সম্রাটের বিরোধিতা করতে পারতেন। তার এই বিদ্রোহ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলেছিলো। তবে এই বিদ্রোহ কোন সাধারণ যুদ্ধের মত ছিল না। এই বিষয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকগণের নিরবতা এটা প্রমাণ করে যে স্থানীয় বিরোধ মিটানোর জন্য আসলে সম্রাট খুব ছোট একটা সৈন্য দল পাঠিয়েছিলেন। চাঁচড়ার রাজপরিবারের নথি থেকে জানা যায়, খান আজিম নামে আকবরের একজন সেনাপতি প্রতাপাদিত্যের কিছু পরগনা দখলে নিতে পেরেছিলেন। যদিও প্রতাপাদিত্য সেই রাজ শক্তিকে অনেকবার হারিয়েছিলেন কিন্তু এতে করে তার ক্ষমতা ও প্রভাবও অনেক কমে গিয়েছিলো। আকবর তার মহান সেনাপতি মানসিংহকে পাঠিয়েছিলেন এই অভিযানে। অনেক বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে, অনেক বনাঞ্চল ধ্বংস করে তিনি প্রতাপাদিত্যকে ধরতে সক্ষম হন। এরপর তিনি প্রতাপাদিত্যের সাথে একটি সন্ধিচুক্তি সম্পন্ন করেন। প্রতাপাদিত্য বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁ কর্তৃক ১৬০৯ সালে পরাজিত ও ধৃত হন। বন্দী অবস্থায় (কথিত আছে খঞ্জরাবদ্ধ অবস্থায়) দিল্লী প্রেরণকালে সম্ভবতঃ বারাণসীর সন্নিকটে প্রতাপাদিত্যের মৃত্যু হয়।

রাজা প্রতাপাদ্যিতের নৌ দূর্গ । সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানা সদর থেকে চার কিলোমিটার উত্তরে এর অবস্থান

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা ঘুরে: কে বলবে জীর্ণদশার এ ভবনটি একসময় যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের নৌ দুর্গ ছিলো! স্থানীয়ভাবে এটি জাহাজঘাটা নামেই বেশি পরিচিত।

রঙচটা লালচে-কালচে ইটের প্রাচীন দুর্গের ভেতরে হাঁটতে লাগলে ইতিহাস পাতা ওল্টায়, রাজা প্রতাপাদিত্যের তৎকালীন রাজধানী ঈশ্বরীপুরের উত্তর দিকে ছিলো সচল প্রবাহের যমুনা নদী।

এই যমুনারই ইছামতি নদীর তীরে বর্তমান মৌতলার কাছে রাজা প্রতাপাদিত্য নিজের যুদ্ধজাহাজ তৈরি ও মেরামতের জন্য একটি বৃহদাকার পোতাশ্রয় তৈরি করেন।

রাজা প্রথমদিকে পোত নির্মাণকারী কারিগর এনেছিলেন সপ্তগ্রাম থেকে। পরবর্তীতে এই কাজের দায়িত্ব দেন ফ্রেডারিক ডুডলিকে। তিনি জাহাজ নির্মাণ কাজের অধ্যক্ষ ছিলেন। জাহাজঘাটার একটু দূরে তার নামানুসারে একটি গ্রামের নাম হয়েছে দুদলী। ওই গ্রামে জাহাজ নির্মাণের ডক ছিলো।

সেসময় ইউরোপের জাহাজ নির্মাণের প্রধান কাঠ ছিলো ওক। রাজা প্রতাপের কাছাকাছি ছিলো সুন্দরবন, সেখানে প্রচুর সুন্দরী গাছ। জাহাজের তলা ও ডেকের কাঠ হিসেবে সুন্দরী বেশ প্রশংসা পায়।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানা সদর থেকে চার কিলোমিটার উত্তরে এ নৌ দুর্গের অবস্থান। তবে মৌতলা বাজারে না নেমে খানপুর নামাই ভালো। একটু সামনে এগিয়ে পাকা রাস্তার পূর্বপাশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাইনবোর্ড। নৌ দুর্গে যেতে ঢুকতে হবে এদিক দিয়েই। বায়ে ফাউন্ডেশনের দোতলা ভবন রেখে ছোট্ট পুকুরের পাড় ধরে এগোলেই দুর্গ।

এখানেই রাজা প্রতাপাদিত্যের নৌ বাহিনীর জন্য নানা প্রকার নৌকা তৈরি ও মেরামত করা হতো। তখন আজকের দিনের মতো ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছিলো না, ছিলো নানা আকৃতি-প্রকৃতির নৌকা। যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত নৌকাগুলো ছিলো কোনোটি সরু, কোনোটি বৃহদাকার পাল তোলা।

ষোড়শ শতকে নির্মিত এ নৌ দুর্গ কালের সাক্ষী হয়ে এখনও ৪১০ ফুট বাই ২১০ ফুট আয়তন বিশিষ্ট ভাঙা একতলা দালান হয়ে টিকে রয়েছে।

দূর্গের মূল নকশা অনুযায়ী, উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এ নৌ দুর্গটি দৈর্ঘ্যে ১০০ ফুট। মোট ৫টি কক্ষ বিশিষ্ট দুর্গের কক্ষ মাপ হলো- উত্তর দিক থেকে প্রথমটি ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি বাই ১৪ ফুট, দ্বিতীয়টি ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি বাই ১৪ ফুট, তৃতীয়টি ২ ফুট ৬ ইঞ্চি বাই ৯ ফুট ৬ ইঞ্চি। কক্ষের উপর দু’টি ও চতুর্থ কক্ষের উপর একটি গম্বুজ ছিলো। কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও নকশা অনুযায়ী কক্ষগুলো চিনতে অসুবিধা হয় না।

অবয়ব দেখে অনুমান করা যায়, প্রথম কক্ষটি জনসাধারণের জন্য, দ্বিতীয়টি অফিস, তৃতীয়টি মালামাল, চতুর্থটি শয়নকক্ষ ও পঞ্চমটি গোসলখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

কিন্তু দুর্গের অন্দর-বাহিরে এখন বেহাল দশা। কক্ষগুলো বাদুড়-মাকড়সার ডেরা। দেয়ালের ইট খসে খসে যাচ্ছে।

ধ্বংসপ্রায় এ ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি সংস্কারের দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর কাজ শুরু করেছিল ১৯৯৬-৯৭ সালে। কিছু অংশ সংস্কারের পর আর এগোয়নি।

এই নৌ দুর্গের তৈরি জাহাজ-নৌকা নিয়ে একসময় প্রতাপের সঙ্গে মোঘল বাহিনীর সঙ্গে লড়েছেন রাজা প্রতাপাদিত্য। সেসময় এর শান-শওকত সবই ছিলো। সময়ের পরিক্রমায় নৌ দুর্গের অবস্থা এখন ঠিক তার উল্টো। তবে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি হিসেবে এর মূল্য অনেক।

সংগৃহীত

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *