চার বছরেও ভবদহ মৎস্য ঘের নীতিমালা বাস্তবায়ন হয়নি

ছবিটি সাম্প্রতিক বিল বোকড় থেকে তোলা । ছবি প্রিয়ব্রত ধর ।
কামরুল ইসলাম,অভয়নগর
ভবদহ এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ভারসাম্য রাখতে সরকারি উদ্যোগে মৎস্যঘের স্থাপন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল, জলাবদ্ধতা নিরসন করে পরিকল্পিতভাবে মাছের ঘের স্থাপন, সরকারি খাল, নদ–নদী ও জমি অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার এবং এর নাব্যতা বৃদ্ধি। কিন্তু তিন বছরেও এ নীতিমালার বাস্তবায়ন হয়নি।
ভবদহ এলাকায় ২০০৪ সালে স্থানীয় লোকজন মাছের ঘের তৈরি করে চিংড়ি ও স্বাদুপানির মাছের চাষ শুরু করেন। ২০০৯ সাল থেকে ঘের স্থাপন ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। কিন্তু নদ–নদী ও খাল ভরাট হয়ে এসব ঘেরের পানিনিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ঘের এলাকার সমগ্র অঞ্চল বৃষ্টির সময় প্লাবিত হয়ে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। ঘেরসংলগ্ন নদ-নদীর পাড় ও রাস্তা ভেঙে যায়। এ জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালের জুনে ভবদহ এলাকায় মৎস্যঘের স্থাপন নীতিমালা প্রণয়ন করে।
ভবদহে জলাবদ্ধতার সমস্যা ক্রমেই প্রকট হলেও ওই নীতিমালার বাস্ত বায়ন হচ্ছে না। এমনকি মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারাও এ নীতিমালার বাস্তবায়ন কঠিন বলে মনে করছেন। এ সম্পর্কে মৎস্যঘের স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসচিব যশোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানান, ভবদহ এলাকায় মৎস্যঘের স্থাপন নীতিমালা বাস্তায়নের উপযুক্ত সময় এখনো আসেনি। মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালা করে ছেড়ে দিয়েছে। এটা বাস্তবায়ন করা কঠিন। এটার অনেক স্টেকহোল্ডার আছে। শুধু মৎস্য বিভাগ কেন এটা বাস্তবায়ন করবে না।
কমিটির সভাপতি যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, জনস্বার্থে দ্রæত নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হবে।
নীতিমালা অনুসারে, ভবদহ এলাকায় মৎস্যঘের করতে হলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার দপ্তর থেকে উপজেলা মৎস্যঘের স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমোদনক্রমে নিবন্ধন নিতে হবে। নিবন্ধনের মেয়াদ পাঁচ বছর। ঘের স্থাপনের পর নীতিমালা ভঙ্গ করলে নিবন্ধন কর্মকর্তা উপজেলা মৎস্যঘের স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির অনুমোদনক্রমে নিবন্ধন বাতিল করবেন। সরকারি খাল, সরকারি জমি, নদ–নদীর পাড় ও নদ–নদীর মধ্যে ঘের স্থাপন করা যাবে না। প্রতিটি ঘেরের আয়তন সর্বোচ্চ ১৫ হেক্টর হবে, তবে সমবায় সমিতির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫০ হেক্টর হবে। ঘেরমালিককে ঘেরের চারদিকে নিজ খরচে বাঁধ তৈরি করতে হবে, ঘেরের বাঁধের সঙ্গে সরকারি রাস্তা থাকলে ঘেরের বাঁধের উচ্চতা সরকারি রাস্তা থেকে কম হতে হবে। পানিনিষ্কাশনের সুবিধার্থে প্রত্যেক মালিককে ঘেরের বাঁধ অথবা পাড়ের বাইরে কমপক্ষে আড়াই ফুট করে জায়গা ছাড়তে হবে। উভয় ঘেরের পাড়ের মাঝখানে কমপক্ষে পাঁচ ফুট জায়গা থাকবে। এ জায়গা পানিনিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত হবে। সরকারি রাস্তা, স্থাপনা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধকে ঘেরের বাঁধ অথবা পাড় হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। পানিনিষ্কাশনে কেউ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো স্থায়ী জলকপাট নির্মাণ করা যাবে না।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, ভবদহ এলাকার প্রবহমান নদ–নদী, শাখা নদী, খাল ও খাসজমি ইজারা অথবা বন্দোবস্ত নিয়ে যেসব ঘের স্থাপন করা হয়েছে, সেই সব ইজারা অথবা বন্দোবস্ত বাতিল করে এবং ঘের অপসারণ করে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। যেসব ঘেরমালিক প্রবহমান নদী, শাখা নদী, খাল ও খাসজমি দখল করে ঘের স্থাপন করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং উপজেলা কমিটি উক্ত মালিক অথবা ইজারাগ্রহীতার অন্য ঘেরের নিবন্ধন বাতিল করবে। নদ–নদী অথবা খাল অবৈধ ইজারা অথবা অবৈধ বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
অভয়নগর উপজেলা মৎস্য বিভাগ গত ১৬ অক্টবর নিতীমালা বাস্তবায়নের লক্ষে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। বিজ্ঞপ্তিটিতে মৎস্য নীতিমালার ধারা গুলো উল্লেখ করা হয়। উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার ফারুক হোসাইন সাগর বলেন, নীতিমালায় শাস্তির বিধান স্পষ্ট না থাকলেও নিয়ম ভঙ্গকারিদের পরিবেশ ও ভোক্তাধিকার আইনে শাস্তি দেওয়া হবে।
যশোরের মনিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলার মুক্তেশ্বরী, টেকা, হরি ও আপারভদ্রা, হরিহর, বুড়িভদ্রা দ্বারা বেষ্টিত এলাকা ভবদহ নামে পরিচিত। এ এলাকায় ২৭টি বিল আছে। বৃষ্টি ও উজানের পানি নদী ও সংযুক্ত খালের মাধ্যমে ভাটিতে নিষ্কাশিত হয়। সমুদ্রের লোনাপানি প্রতিরোধে ও কৃষিযোগ্য মিঠাপানি ধরে রাখার জন্য ষাটের দশকে হরি-টেকা নদ–নদীর অভয়নগর উপজেলার ভবদহ নামক স্থানে ২১–ভেন্ট ও পরবর্তীকালে ৯-ভেন্ট–এর জলকপাট (¯øুইসগেট) নির্মাণ করা হয়। সত্তর দশকের পর থেকে এ অঞ্চলের নদ–নদীগুলোর পানির মূল প্রবাহ পদ্মা নদী থেকে বিছিন্ন হওয়ায় সাগরবাহিত পলি উজানের দিকের নদী ও খালের তলদেশে জমা হতে থাকে। এতে স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।