Type to search

শ্রমিক আন্দোলনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, শ্রমিক জননেতা প্রতাপ উদ্দিন আহম্মেদ-এর ২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত।

যশোর

শ্রমিক আন্দোলনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, শ্রমিক জননেতা প্রতাপ উদ্দিন আহম্মেদ-এর ২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত।

আজ ১৪ মার্চ-২০২৩ মঙ্গলবার জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ ও বাংলাদেশ নৌ-যান শ্রমিক ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শ্রমিক জননেতা প্রতাপ উদ্দিন আহম্মেদ-এর ২৫ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ ও বাংলাদেশ নৌ-যান শ্রমিক ফেডারেশন অভয়নগর থানা কমিটির উদ্যোগে এক স্মরণসভা বিকাল ৫ টায় নওয়াপাড়া পুরাতন বাস স্ট্যান্ডে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট থানা সহ-সভাপতি আবু বক্কার সরদার-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি কেন্দ্রীয় সভাপতি কৃষকনেতা হাফিজুর রহমান, বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ নৌ-যান শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি শ্রমিকনেতা বাহারুল ইসলাম (বাহার), জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট যশোর জেলা ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আশুতোষ বিশ্বাস, সংগঠনের নড়াইল জেলা সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, যশোর জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক সমীরণ বিশ্বাস, অভয়নগর থানা সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম,  সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিম জমাদ্দার, সহ-সম্পাদক এম আর টিটু বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়ন চট্টগ্রাম শাখার অন্যতম নেতা মোঃ আসাদ প্রমুখ। সভাটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ অভয়নগর থানা সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হুসাইন।
উল্লেখ্য, প্রতাপউদ্দিন আহম্মেদ এর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আমলা দালালপুঁজি বিরোধী জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের অন্যতম কান্ডারী। তিনি ছিলেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন, লঞ্চ লেবার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ- স্কপের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য। তিনি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা- আইএলও- এর সঙ্গে সম্পর্কিত ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি অব ওয়ার্কার্স এডুকেশন- এনসিসিডিব্লিউই- এর কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন।
প্রতাপউদ্দিন ছিলেন আপসহীন এবং আজীবন সংগ্রামী নেতা। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৩০ সালে বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার মোস্তফাপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের মাত্র আড়াই বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান। বাবা এরশাদউল্লা ছিলেন একজন (সি-ম্যান) জাহাজী শ্রমিক। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রতাপউদ্দিন কলকাতা যান। এই অল্প বয়সে তাঁকে উপার্জনের পথ বেছে নিতে হয়। তিনি ইন্ডিয়ান সি-ম্যান ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে এই ইউনিয়নের কালেক্টর (সদস্য চাঁদা আদায়কারী) নিযুক্ত হন। চাকরির পাশাপাশি লেখাপড়ার কাজও চালিয়ে যান। তিনি ঐ সময় এইচএসসি পাশ করেন। রাজনৈতিক কারণে লেখাপড়া আর বেশি দূর এগোয়নি।
ইন্ডিয়ান সি-ম্যান ইউনিয়নের নেতা মনসুর জিলানীসহ অন্যান্যদের সাথে তিনি যোগাযোগ গড়ে তোলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এম.এ. সামাদ, শেখ সালেহ, আবদুল হালিম খান, জ্যোতি বসু সহ অনেকের সংস্পর্শে আসেন এবং কমিউনিস্ট আদর্শ গ্রহণ করেন। যে আদর্শের জন্য মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত গণমানুষের স্বার্থে সংগ্রাম করার শক্তি পেয়েছেন। ১৯৫২ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ পান। আন্দোলনের অভিযোগে পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে চিহ্নিত করে সরকার ১৯৬৫ সালে তাঁকে ভারত থেকে বহিস্কার করলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশে) চলে আসেন। পূর্ব পাকিস্তানে আসার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আবদুল হক, মনি সিংহ, খোকা রায়, অনিল মুখার্জীর সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙ্গে যাওয়ার পর তিনি কমরেড আবদুল হকের নেতৃত্বাধীন পার্টির সাথে যুক্ত থাকেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এ সম্পর্ক অটুট ছিল।
প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। লঞ্চ শ্রমিকরা তাদের পূর্ব পরিচিত প্রতাপউদ্দিনকে নিজেদের মাঝে পেয়ে তাদের নেতা নির্বাচন করেন। এই সংগঠনের নেতৃত্বে আসার পর ১৯৬৯ সাল থেকে নৌ-যান শ্রমিকদের আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। নৌ-যান শ্রমিকরা তৎকালীন আইনে শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি। আন্দোলনের পরিণতিতে শ্রমিক হিসাবে তারা স্বীকৃতি পান এবং মালিক পক্ষের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হন। তিনি নৌ-যান শ্রমিকদের অবিসংবাদি নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বাকশাল গঠন করার পর বাকশালে যোগদানের জন্য দেশের বিভিন্ন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃস্থানীয়দের ওপর ফ্যাসীবাদী কায়দায় তীব্র চাপ সৃষ্টি করে। প্রতাপউদ্দিন আহমেদের ওপরও বাকশালীরা এই চাপ সৃষ্টি করে। তাঁর আদর্শিক দৃঢ়তা এবং সাহসিকতার কারণে বাকশালীরা তাঁকে দলে আনতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭৫ সালে পুনরায় নৌ-যান শ্রমিকদের সংগঠনে শক্তিশালী করার কাজে ব্রত হন। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন। ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, কৃষক সংগ্রাম সমিতি ও জাতীয় ছাত্রদলের সমন্বয়ে ১৯৮৮ সালে গঠিত হয় জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। তিনি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এই পদে আসীন থাকেন। তিনি বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসাবে আইএলও সভায় দুবার প্রতিনিধিত্ব করেন।
তিনি বাংলাদেশের হোটেল রেষ্টুরেন্ট ও সুইটমিট প্রতিষ্ঠানে শ্রম আইন লংঘনের অভিযোগ আইএলও-তে তুলে ধরেন। সরকার ওয়াদাবব্ধ হয়েও আজ পর্যন্ত এ সব শিল্পে শ্রম আইন বাস্ত—বায়ন করেনি।
শুধু হোটেল রেষ্টুরেন্ট নয় সারাদেশে আইএলও-এর কনভেনশন রেকটিফাই না করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আইএলও-র কাঠগড়ায় প্রতি বছর দাঁড়াতে হয়। প্রতাপউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে- শ্রমিক আন্দোলনে অবিসংবাদি নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তিনি শ্রমিক-কৃষকসহ মেহনতি মানুষের সংগ্রামে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে কারাবরণ করেন। নির্যাতন-নিপীড়নসহ সকল প্রকার ক্ষয়-ক্ষতিকে তিনি হাসি মুখে মেনে নিতেন।
প্রতাপউদ্দিন আহমেদ বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের মুক্তি নাই। আর এ সমাজ পরিবর্তন করতে হলে গ্রহণ করা দরকার শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির দর্শন- মার্কসীয় দর্শন। তিনি এই দর্শন গ্রহণ করেছিলেন সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার প্রয়োজনে। আজীবন সংগ্রামে অবিচল থাকা হচ্ছে প্রতাপউদ্দিন আহম্মেদের শিক্ষা। তাই তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সমাজ পরিবর্তনের দীর্ঘস্থায়ী কঠিন কঠোর লড়াইকে অগ্রসর করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে প্রতাপউদ্দিন আহমেদ ছিলেন সাপ্তাহিক সেবা পত্রিকার অন্যতম শুভানুধ্যায়ী ও পৃষ্টপোষক।
প্রতাপউদ্দিন আহমেদের মৃত্যু, মৃত্যুতেই শেষ নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নতুন জীবনে তাঁর আদর্শের অরুণোদয় ঘটবে।