Type to search

৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঝিকরগাছার আলোচিত ব্রিজটি ভেঙে ফেলার দিকেইে এগোচ্ছে

ঝিকরগাছা

৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঝিকরগাছার আলোচিত ব্রিজটি ভেঙে ফেলার দিকেইে এগোচ্ছে

অপরাজেয় বাংলা ডেক্স :  ভুল নকশার কারণে ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঝিকরগাছার আলোচিত ব্রিজটি ভেঙে ফেলার দিকেই সিদ্ধান্ত গড়াচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে সময় লাগবে এবং পাশাপাশি আরেকটি ব্রিজ নতুন নকশায় দাঁড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সম্প্রতি যশোরসহ দেশব্যাপী আলোচিত ঝিকরগাছা ব্রিজটির আদ্যপান্ত খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন দপ্তর ঘুরে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ঝিকরগাছা বাজারের কপোতাক্ষ নদের উপর এ ব্রিজটি নির্মাণে কোন নিয়মনীতি মানা হয়নি বলে সড়ক বিভাগ ও বিআইডাব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সূত্রের দাবি। নদী আইন অনুযায়ী কপোতাক্ষের পানির স্তর থেকে ব্রিজটি ২৫ ফুট উচ্চতায় হবার কথা থাকলেও নির্মিত হয়েছে মাত্র সাড়ে আট ফুটে। যা বিআইডাব্লুউটিসি কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত করে লাল কালির দাগ দিয়েছে। যে কারণে বর্ষাকালে এ ব্রিজের নিচ দিয়ে কোন ট্রলার তো দূরের কথা, ডিঙি নৌকাও যেতে পারবে না। এছাড়া, ব্রিজ নির্মাণের জরিপও ভুল ছিল বলে জানিয়েছেন তারা। একইসাথে নির্মাণ কাজে নেয়া হয়নি নৌ সংরক্ষণ ও সঞ্চালন বিভাগের কোন অনুমতি বা ছাড়পত্র।
কপোতাক্ষ নদের উপর গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজটি বয়সের ভারে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এটি ভেঙে নতুন ব্রিজ করার পরিকল্পনা করে সরকার। এরই প্রেক্ষিতে সরকারের সাথে যৌথভাবে দাতা সংস্থা জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) নতুন ব্রিজ নির্মাণের সাথে যুক্ত হয়। ২০১৫ সালে এটি নির্মাণের জন্য জরিপও করা হয়। সেখানে সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সড়ক, জনপথ ও সেতু বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জাইকার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এরপর ১২০ দশমিক ২০ মিটার বা ৩৯১ ফুট দৈর্ঘের ছয় লেনের এ ব্রিজের নকশা চুড়ান্ত করা হয়। এখানে ১৫ দশমিক ১ মিটার বা প্রায় ৫১ ফুট প্রশস্থের পাশাপাশি দুটি ব্রিজের নকশা করা হয়। মাঝখানে তিন মিটারের বা দশ ফুটের একটি ডিভাইডার রাখা হয়। যেটি দুই সেতুর মাঝখানে সংযোগ স্থাপন করবে এবং তিন লেন করে পাশাপাশি দুটি সড়ক পৃথক করবে। ব্রিজে মোট তিনটি স্প্যান ও পানি থেকে উচ্চতা (সফিট লেভেল) রাখা হয়েছে ৬ দশমিক ৩৫০ মিটার বা প্রায় ২১ ফুট। ভেঙে ফেলা পুরাতন ব্রিজটির উচ্চতা ছিল প্রায় ২০ ফুট। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট বাংলাদেশ-এর আওতায় এসব কর্মকান্ড শুরু হয়। এ কাজের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয় ওসিজি-ওসি-পেডিকো-জেভি ইন এসোসিয়েশন উইথ এসএমইসি-জেবিএসএল-বিসিএল-এসিই-ডিডিসি। পরবর্তীতে টেন্ডারের মাধ্যমে সেতুর ঠিকাদার নিয়োগ হয় ঢাকার কাকরাইল এলাকার মনিকো-ডায়ানকো জেভি লিমিটেড। এ ব্রিজ র্নিমাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ৭০ কোটি টাকা।
টেন্ডার অনুযায়ী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর থেকে ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু করে। কাজ শেষ হবার মেয়াদ রয়েছে ২০২২ সালের ২৫ মে। ইতিমধ্যে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান একটি অংশের ব্রিজ নির্মাণ করে বিতর্কের জন্ম দিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছেন। এ কারণে গত প্রায় আড়াই মাস এ নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। নকশা ও নিয়মানুযায়ী ব্রিজ নির্মাণ না হওয়ায় জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর (অব:) ডা. নাসির উদ্দীনসহ জনপ্রতিনিধিরা ব্রিজটি পরিদর্শনে গিয়ে বাস্তব অবস্থা দেখে গত ৮ আগষ্ট নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন।
বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগের পর জানা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডাব্লিউটিসি, সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল মালেকসহ কর্মকর্তারা এবং জাইকা প্রতিনিধিরা নির্মাণাধীন ব্রিজটি পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখনো কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। তবে বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্যরা তদন্ত শেষে গত অক্টোবর মাসে তদন্ত রিপোর্ট ও তাদের সুপারিশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। যতদূর জানা গেছে সবপক্ষের সুপারিশেই ব্রিজটি ভেঙে ফেলা বা পুণরায় নির্মাণের পক্ষে মত দেয়া হয়েছে।
সূত্রটি জানিয়েছে, নবনির্মিত ব্রিজটির ভাগ্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত এখন মন্ত্রণালয়ে অপেক্ষায় রয়েছে। তবে নির্মাণের অপেক্ষায় বাকী অন্য ব্রিজটি নতুন নকশায় সকল নিয়ম মেনেই আগে সম্পন্ন হবে। তাতে করে যানবাহন চলাচল নির্বিঘœ থাকবে।
ঝিকরগাছা ব্রিজ বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক আশরাফুজ্জামান বাবু জানান, কপোতাক্ষ নদের উপর ব্রিজটি নির্মাণের নকশা দেখে তারা প্রথমেই প্রতিবাদ জানান। কিন্তু তাদের এ কথায় কেউ কর্ণপাত করেননি। পরবর্তীতে ব্রিজটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেলে উপজেলাবাসী দেখে হতবাক হন। নদী আইন অনুযায়ী পানি থেকে এটি ২৫ ফুট উচ্চতায় নির্মিত হবার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। উচ্চতা রাখা হয়েছে মাত্র সাড়ে ৮ ফুট। এর প্রতিবাদে তাদের সংগঠনসহ নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সড়ক অবরোধ ও ঝিকরগাছায় মানববন্ধন করে এবং প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর (অব:) ডা. নাসির উদ্দীনের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে গত ৮ আগষ্ট এমপিসহ উপজেলার জনপ্রতিনিধিরা ব্রিজটি পরিদর্শন শেষে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন।
ব্রিজ নিয়ে নাগরিক অধিকার আন্দোলন যশোরের সমন্বয়ক মাসুদুজ্জামান মিঠু বলেন, তাদের সংগঠনের আন্দোলনের কারণে নকশা ও নিয়মনীতি বর্জিত ব্রিজটির নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। তারা জানতে পেরেছেন, এবার নবনির্মিত ব্রিজটি ভেঙে ফেলে নতুন নকশায় ও নিয়মানুযায়ী পূর্ণাঙ্গ রুপে ব্রিজ নির্মিত হবে। এতে কপোতাক্ষ নদ বাঁচবে, নৌকা ও ট্রলার চলাচল করতে পারবে। কপোতাক্ষ নিয়ে মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসবে।
তিনি বলেন, তাদের আন্দোলনের কারণে গত আগষ্ট মাসে জাইকা প্রতিনিধি এবং সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ব্রিজ নিয়ে তদন্ত কমিটির আহবায়ক আব্দুল মালেক ব্রিজটি পরিদর্শনে আসেন।
এদিকে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মনিকো-ডায়ানকো জেভি লিমিটেডের সাইড ইঞ্জিনিয়ার রবিউল ইসলাম বলেন, নির্মাণাধীন এ ব্রিজের নকশা করেছেন জাইকা কর্তৃপক্ষ। টেন্ডারে কাজ প্রাপ্তির পর এ নকশা তাদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী তারা নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, নকশা অনুযায়ী পুরাতন ও নবনির্মিত ব্রিজের উচ্চতা প্রায় সমান। তবে সমস্যা হচ্ছে নতুন স্টাইলে নির্মিত এ ব্রিজের নীচে চার ফুটের গার্ডার রয়েছে। এ কারণে নীচের উচ্চতা কম দেখাচ্ছে। অথচ পুরাতন ব্রিজে গার্ডার পদ্ধতি ছিল না। এ জন্য সেটি দেখতে উঁচু মনে হতো। ব্রিজের নির্মাণ কাজে তারা কোন অনিয়ম করেননি বলে তিনি দাবি করেন।
সর্বশেষ গত ১৪ নভেম্বর জাইকার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্রিজ পরিদর্শন করে কাজ বন্ধ রাখার কথা জানিয়ে গেছেন।
বিষয়টি নিয়ে ব্রিজ নির্মাণের তদারককারী জাইকা কর্মকর্তা সাব অ্যাসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার নূর ইসলাম বলেন, নবনির্মিত ব্রিজের উচ্চতা আগেরটির থেকে বেশি। ২০১৫ সালে জরিপের মাধ্যমে নকশা চুড়ান্ত করে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। আধুনিক নির্মাণ শৈলীর গার্ডারের কারণে এটি নিচু দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্রিজটি কপোতাক্ষ নদের পানি থেকে ১৫ ফুট উচ্চতায় রয়েছে। নকশাসহ সকল নিয়মনীতি মেনেই তারা ব্রিজের নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে ঝিকরগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহবুবুল হক বলেন, ব্রিজটি তার উপজেলায় হলেও ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় নির্মাণ কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। যেহেতু উপজেলায় এ প্রজেক্টের কোন অফিস নেই, সেহেতু এ সংক্রান্ত আপডেট তথ্য তাদের জানা নেই। বর্তমানে নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে, তবে অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে বলে তিনি জানান।
ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের ডেপুটি ম্যানেজার সুমন কুমার বিশ্বাস বলেন, ঝিকরগাছা ব্রিজের নির্মাণ কাজের বিষয়টি এখন আর তাদের হাতে নেই। পুরোটাই তদারকি করছেন সড়ক ও সেতু বিভাগ। সরকারের মাধ্যমে তাদের দেয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই তারা ব্রিজ সংক্রান্ত পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্রিজের নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। এটি ভেঙে ফেলা হবে বা নতুন করে নির্মাণ করা হবে কিনা সেটা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ নৌ সংরক্ষণ ও সঞ্চালন বিভাগের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক আশরাফ হোসেন বলেন, ঝিকরগাছা ব্রিজ নির্মাণ কাজের জন্য নিয়মানুযায়ী তাদের কাছ থেকে কোন অনুমতি বা ছাড়পত্র নেয়া হয়নি। এ নিয়ে জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে তারা ঘটনাস্থল তিন থেকে চারবার ভিজিট করেছেন। এসময়ে তারা দেখতে পেয়েছেন কপোতাক্ষ নদের পানির ধারা থেকে ২৫ ফুট উচ্চতায় ব্রিজটি নির্মাণ হবার কথা থাকলেও তারা মেপে দেখেছেন এটি সাড়ে ৮ ফুট উচ্চতায় নির্মিত হয়েছে। যা আইনের পরিপন্থী। বিষয়টি নিয়ে তারা প্রতিবেদন তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছেন। পরবর্তীতে সরকার এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে তিনি জানান।
এ ব্যাপারে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল মালেক বলেন, ব্রিজ নির্মাণে জটিলতা সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির তিনি আহবায়ক। এ নিয়ে তিনি ঝিকরগাছায় গিয়ে জনপ্রতিনিধিসহ আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলেছেন এবং তারই ভিত্তিতে রিপোর্ট ও সুপারিশ দাখিল করেছেন। তিনি ব্রিজের উচ্চতা কম দেখতে পেয়েছেন এবং বাস্তব অবস্থা জানিয়ে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এ বিষয়ে তিনি জাইকা কর্মকর্তাদের সাথেও কথা বলেছেন। তিনি বলেন, যেহেতু এর পাশেই আরো একটি ব্রিজ নির্মিত হবে। এ কারণে সেটির উচ্চতা নির্ধারণ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্মাণ করে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর এ ব্রিজটি ভাঙতে হবে না নতুন করে নির্মাণ করতে হবে সে বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
এ ব্যাপারে টিআইবি যশোরের সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক সুকুমার দাস বলেন, জনমত জরিপ বা যাচাই ছাড়া এ ধরনের পরিকল্পনাহীন অবকাঠামো নির্মাণে শুধু রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতিই হয় না, পাশাপাশি জনগণ দুর্ভোগ ও ভোগান্তির শিকার হয়।
সূত্র: গ্রামের কাগজ