Type to search

১৭ই রমজানে বদরের যুদ্ধ :একটি পর্যালোচনা- প্রফেসর ড. সৈয়দ মাকসুদুর রহমান

ধর্ম

১৭ই রমজানে বদরের যুদ্ধ :একটি পর্যালোচনা- প্রফেসর ড. সৈয়দ মাকসুদুর রহমান

ভূমিকা:

আমরা বদরের বা গাযওযাতে বদর নিয়ে অনেক আলোচনা পেয়েছি। অনেক বর্ণনা এবং ফলাফল কিছুটা কাল্পনিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে বদরের যুদ্ধ বিষয়ক আলোচনা কুরআন ও হাদীস এর আলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে। আশা করি পাঠকগণ সঠিক ইতিহাস জানতে পারবেন এবং সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে উপকৃত হবেন। বদর যুদ্ধ বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,

“যখন তোমাদের দু’টি দল সাহস হারাবার উপক্রম হলো, অথচ আল্লাহ তাদের সাহায্যকারী ছিলেন, আর আল্লাহর উপরই ভরসা করা মুমিনদের উচিত।” (আলে ইমরান: আয়াত: ১২২-১২৩) আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন-
অর্থ: “হে নবী! স্মরণ করুন যখন আপনি বিশ্বাসীগণকে বলেছিলেন, এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের প্রতিপালক তিন হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে তোমাদেরকে সাহায্য করবেন?” (আলে ইমরান: আয়াত: ১২৪-১২৫) এ আয়াতের তাফসীরে এসেছে-

বদর যুদ্ধ প্রথম প্রধান যুদ্ধ
মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত ইসলামের ইতিহাসে প্রথম প্রধান যুদ্ধ। বদরের যুদ্ধ যাকে আরবি ভাষায় (غزوة بدر‎‎) বলা হয়। যে যুদ্ধের নেতৃত্ব স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদান করেন। অনেকেই বলেছেন, যে যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অংশ গ্রহণ করেন তাকে গাযওযাত বলে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অংশ গ্রহণ করেনি সেটাকে সারিয়্যাহ। এ বিষয়ে কিছু তথ্য প্রদান করা হলো-
২ হিজরির ১৭ রমজান (১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ) মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সংঘটিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এটি প্রথম প্রধান যুদ্ধ। এতে জয়ের ফলে মুসলিমদের ক্ষমতা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,
﴿وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ ۚ إِ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا﴾
অর্থ: “আর বলুন, ‘হক এসেছে ও বাতিল বিলুপ্ত হয়েছে; ‘নিশ্চয় বাতিল বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।” (সূরা আল ইসরা :আয়াত ৮১)

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ:
বদর যুদ্ধ মুসলিম ও কুরাইশ এর মধ্যে সংঘটিত হয়। এখানে হাদীসের সারসংক্ষেপ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদর যুদ্ধের পূর্বে কোনো অত্যাচার ও নির্যাতনের উত্তর দেননি। যেমন, শুরুতে কুরাইশগণ মল্ল যুদ্ধের আহ্বান জানায় হামজা রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আলি আলী রাদি আল্লাহ তা’আলা আনহু কর্তৃক মুসলিম বাহিনীর অংশ গ্রহণ করার জন্য। তারা আহবান জানালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম অনুমতি দেন।

তারিখ ১৭ রমজান ২ হিজরি / ১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ (অবস্থান মদিনার দক্ষিণ পশ্চিমে ৮০ মাইল অদূরে বদর উপত্যকা ৩১৩জন পদাতিক, ২টি ঘোড়া, ৭০টি উট।

বদর যুদ্ধের ফলাফল
মুসলিমদের (বিজয়) যুদ্ধমান পক্ষ মদিনার মুসলিম মক্কার কুরাইশ সেনাধিপতি মুহাম্মদ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু, উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু, হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু, আলি ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু,  কাফেরদের নেতৃত্ব দেয় আবু জাহল। আল্লাহ তায়ালার বাণী-
অর্থ: “নিশ্চয়ই দুটো দলের মোকাবিলার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন ছিল। একটি দল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছিল। আর অপর দল ছিল অবিশ্বাসী। এরা বিশ্বাসীদেরকে দ্বিগুণ দেখছিল এবং এর ফলে কাফেররা ভীত হয়ে পড়েছিল। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন নিজের সাহায্যের মাধ্যমে শক্তি দান করেন। নিশ্চয়ই এতে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্নদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে।” (আলে ইমরান, আয়াত: ১৩)

কাফেরদের মধ্যে উতবা ইবনে রাবিয়া এবং উবাই ইবনে খালাফ, ৯৫০জন পদাতিক, ১০০টি ঘোড়া, ১৭০টি উট  আমিরূল মুমিনুন উমার ইবন খাত্তব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত-
অনুরূপ বারা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহাবীগণ পরস্পর আলোচনা করতাম যে, বাদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সহাবীদের সংখ্যা তালুতের সঙ্গে যারা নদী পার হয়েছিলেন তাদের সমানই ছিল এবং তিনশ’ দশ জনের অধিক ঈমানদার ব্যতীত কেউ তাঁর সঙ্গে নদী পার হতে পারেনি। (সহীহ মুসলিম, খন্ড-৯, পৃ. ২১৪) হাদীস নং ৩৩০৯ হাদীসে এসেছে-

অর্থ: “বারা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহাবীগণ পরস্পর আলোচনা করতাম যে, বাদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সহাবীদের সংখ্যা তালুতের সঙ্গে যারা নদী পার হয়েছিলেন তাদের সমানই ছিল এবং তিনশ’ দশ জনের অধিক ঈমানদার ব্যতীত কেউ তাঁর সঙ্গে নদী পার হতে পারেনি। হাদীস নং [৩৯৫৭] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদেরর যুদ্ধে  অংশ গ্রহণকারী সকলের জন্য সুসংবাদ প্রদান করেন,

হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি নিহত ১৪ (শহীদ হন):
এ যুদ্ধে ১৪ জন সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুম শাহাদত বরণ করেন। (বদরের যুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাদের পরিচয় হল

﴾হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি নিহত ১৪ (শহীদ হন):
এ যুদ্ধে ১৪ জন সাহাবী রাদিয়াল্লাহু আনহুম শাহাদত বরণ করেন। (বদরের যুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাদের পরিচয় হলঃ

এই বুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছে হাদীসে  এসেছে

১.  হযরত ওবায়দা ইবনে হারিছ রাদিয়াল্লাহু আনহু – মুহাজির।
২.  হযরত ওমায়ের ইবনে আবু ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু – মুহাজির।
৩. হযরত যুশ-শিমালাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু মুহাজির।
৪.  হযরত আকিল ইবনে বুকাইল রাদিয়াল্লাহু আনহু – মুহাজের।
৫. হযরত মাহজা ইবনে সালেহ রাদিয়াল্লাহু আনহু মুহাজির। তিনি ছিলেন হযরত ওমর ইযনুল রাদিয়াল্লাহু আনহু এর আযাদকৃত ক্রীতদাস।
৬. হযরত সাফওয়ান ইবনে বায়দা রাদিয়াল্লাহু আনহু মুহাজির।
৭.  হযরত সাদ ইবনে খায়সামা রাদিয়াল্লাহু আনহু – আনসার।
৮.  হযরত মুবাশ্বর ইবনে আবদুল মুনযির রাদিয়াল্লাহু আনহু আনসার।
৯.  হযরত ওমায়ের ইবনে হুমাম রাদিয়াল্লাহু আনহু আনসার।
১০.  হযরত ইয়াযিদ ইবনে হারিছ রাদিয়াল্লাহু আনহু – আনসার।
১১.  হযরত রাফি ইবনে মুয়াল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু আনসার।
১২. হযরত হারিছা ইবনে সুরাকা রাদিয়াল্লাহু আনহু – আনসার।
১৩. হযরত আওফ ইবনে হারিছ  রাদিয়াল্লাহু আনহু – আনসার।
১৪. হযরত মুআওবিয ইবনে হারিছ রাদিয়াল্লাহু আনহু আনসার।

শূহাদা বদর এর কবরের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছেন লেখক
আল্লাহ তায়ালার বাণী-
অর্থ: “যারা নিজের ওপর অত্যাচার করেছে, তাদের প্রাণ হরণের সময় ফেরেশতারা বলবে তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা উত্তরে বলবে, আমরা আমাদের শহরে অসহায় ছিলাম। ফেরেশতারা বলবে, আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না? তোমরা হিজরত করতে পারতে। অতএব, এদের বাসস্থান হলো জাহান্নাম এবং তা অতি মন্দ স্থান।” (সূরা নিসা, আয়াত:৯৭)

অর্থ: “কিন্তু পুরুষ, নারী ও শিশুদের মধ্যে যারা অসহায় এবং মুক্তির জন্য কোন উপায় বের করতে পারে না এবং কোন পথও জানে না।” (সূরা নিসা, আয়াত::৯৮) কাফিরদের মধ্যে নিহত ৭০জন। তাদের মধ্যে অন্যতম, বন্দী ৭০। আল-হাদীস এসেছে-
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-
﴿ قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا سَتُغْلَبُونَ وَتُحْشَرُونَ إِلَى جَهَنَّمَ وَبِئْسَ الْمِهَادُ ﴾
অর্থ: “যারা আমার নিদর্শনকে অবিশ্বাস করেছে তাদেরকে বলুন, শীঘ্রই তোমরা পরাজিত হবে এবং তোমাদেরকে জাহান্নামে জড়ো করা হবে। জাহান্নাম খুবই নিকৃষ্ট।” (আলে ইমরান, আয়াত:১২)

যুদ্ধের পূর্বে ৬২৩ থেকে ৬২৪ সালের মধ্যে মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে বেশ কিছু খন্ডযুদ্ধ হয়। বদর ছিল দুই বাহিনীর মধ্যে প্রথম বড় আকারের যুদ্ধ। যুদ্ধে সুসংগঠিত মুসলিমরা মক্কার সৈনিকদের সারি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে মুসলিমদের প্রধান প্রতিপক্ষ আবু জাহল নিহত হয়। মুসলিমদের বিজয়ের অন্যদের কাছে বার্তা পৌছায় যে মুসলিমরা আরবে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং এর ফলে নেতা হিসেবে মুহাম্মাদ এর অবস্থান দৃঢ় হয়।

পটভূমি
বদর যুদ্ধের মানচিত্র কী ছিল। এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে-
বদরে যাত্রা সম্পাদনা মুহাম্মাদ এর সাথে মুসলিম বাহিনীতে ছিলেন আবু বকর, উমর ইবনুল খাত্তাব, আলি ইবনে আবি তালিব, হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, মুসআব ইবনে উমাইর, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আম্মার ইবনে ইয়াসির ও আবু যার আল-গিফারী। স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে উসমান ইবনে আফফান যুদ্ধে যেতে পারেননি।

সালমান ফারসি এসময় অন্যের দাস ছিলেন তাই তিনিও যুদ্ধে অংশ নেননি। বাহিনীতে সৈনিক সংখ্যা ছিল ৩১৩জন। এর মধ্যে মুহাজির ছিলেন ৮২জন এবং আনসারদের মধ্যে আওস গোত্রের ছিলেন ৬১জন ও খাজরাজ গোত্রের ছিলেন ১৭০জন। মুসলিমদের সাথে ৭০টি উট ও দুইটি ঘোড়া ছিল। ফলে তাদের সামনে পায়ে হেটে যাওয়া বা প্রতি দুই বা তিনজনের জন্য একটি উট ব্যবহার ছাড়া উপায় ছিল না। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-

অর্থ: “কোন নবীর পক্ষেই অন্যায়ভাবে কিছু গোপন করা সম্ভব নয়। যে অন্যায়ভাবে কিছু গোপন করে কেয়ামতের দিন অর্থাৎ বিচার দিবসে সে তা নিয়ে আসবে। প্রত্যেক ব্যক্তি যা অর্জন করেছে তার পূর্ণ প্রতিফল তাকে দেয়া হবে এবং কারো ওপর জুলুম করা হবে না।” (আলে ইমরান, আয়াত:১৬১)

ইমাম তিরমিজি এ আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হাদীস উপস্থাপন করেন,
একটি উটে পালাক্রমে দুই বা তিনজন আরোহণ করতেন। এই ব্যবস্থায় মুহাম্মাদ , আলি ইবনে আবি তালিব ও মারসাদ ইবনে আবি মারসাদের জন্য একটি উট বরাদ্দ হয়েছিল। হাদীসে এসেছে-

মুহাম্মাদ সার্বিক নেতৃত্বের জন্য মুসআব ইবনে উমাইরকে একটি সাদা পতাকা প্রদান করেন। মুহাজিরদের ও আনসারদের জন্য একটি করে কালো পতাকা যথাক্রমে আলি ইবনে আবি তালিব এবং সাদ ইবনে মুয়াজকে প্রদান করা হয়। বাহিনীর ডান ও বাম অংশের প্রধান হিসেবে যথাক্রমে যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও মিকদাদ ইবনে আমরকে নিযুক্ত করা হয়। মুসলিম বাহিনীতে থাকা দুইটি ঘোড়ায় তারা আরোহণ করেছিলেন। পেছনের অংশের প্রধান হিসেবে কাইস ইবনে আবিকে নিয়োগ দেয়া হয়। মুহাম্মাদ সমগ্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।কুরাইশ কাফেলা
আক্রমণের আশঙ্কায় কুরাইশ কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান-

যাত্রাপথে সাক্ষাত লাভ করা বিভিন্ন কাফেলাগুলির কাছ থেকে মুসলিম বাহিনীর সম্ভাব্য অভিযানের ব্যাপারে তথ্য নিচ্ছিলেন। ফলে তিনি মুসলিমদের আক্রমণের খবর পান। তাই সাহায্য চেয়ে জমজম ইবনে আমর গিফারিকে বার্তা বাহক হিসেবে মক্কা পাঠানো হয়। সে দ্রুত মক্কা পৌছায় এবং তৎকালীন আরব রীতি অনুযায়ী উটের নাক চাপড়ায়, আসন উল্টিয়ে দেয়, নিজের জামা ছিড়ে ফেলে এবং উটে বসে ঘোষণা করে যে মক্কার কাফেলা মুসলিমদের হাতে পড়তে পারে।
মক্কার বাহিনী
কুরাইশগণ, কাফেলা আক্রান্ত, কাফেলা আক্রান্ত। আবু সুফিয়ানের সাথে তোমাদের সম্পদ রয়েছে, তার উপর আক্রমণ চালানোর জন্য মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীরা এগিয়ে আসছে। তাই আমার মনে হয় না যে তোমরা তা পাবে। তাই সাহায্যের জন্য “এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো” মক্কায় পৌঁছানোর পর জমজম ইবনে আমর গিফারির আহ্বান-

এই খবর শোনার পর মক্কায় আলোড়ন শুরু হয়। দ্রুত ১,৩০০ সৈনিকের এক বাহিনী গড়ে তোলা হয় এবং আবু জাহল বাহিনীর প্রধান হন। এই বাহিনীতে অসংখ্য উট, ১০০ ঘোড়া ও ৬০০ লৌহবর্ম‌ ছিল। নয়জন সম্ভ্রান্ত কুরাইশ রসদ সরবরাহের দায়িত্ব নেন। বাহিনীর জন্য দৈনিক কখনো ৯টি এবং কখনো ১০টি উট জবাই করা হত। আবু জাহল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া, আবুল বাখতারি ইবনে হিশাম, হাকিম ইবনে হিজাম, নওফেল ইবনে খুয়াইলিদ, হারিস ইবনে আমির, তুয়াইমা ইবনে আদি, নাদার ইবনে হারিস, জামআ ইবনে আসওয়াদ ও উমাইয়া ইবনে খালাফসহ মক্কার অনেক অভিজাত ব্যক্তি মক্কার বাহিনীতে যোগ দেন। এর কয়েকটি কারণ ছিল। কেউ কাফেলায় নিজেদের সম্পদ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, অন্যরা ইবনে আল-হাদরামির মৃত্যুর বদলা নিতে চেয়েছিলেন। এছাড়া মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহজে জয়ী হওয়া যাবে এই বিশ্বাসেও কেউ কেউ যোগ দেয়।আবু লাহাব নিজে যুদ্ধে অংশ না নিয়ে তার কাছে ৪,০০০ দিরহাম ঋণগ্রস্থ আসি ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে ঋণের বিনিময়ে পাঠায়। উমাইয়া ইবনে খালাফ প্রথমে যুদ্ধে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এসময় উকবা ইবনে আবু মুয়াইত তাকে নারী হিসেবে সম্বোধন করে। এর ফলে উমাইয়া ইবনে খালাফ লজ্জিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। তবে কুরাইশদের মধ্যে বনু আদি গোত্রের কেউ এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি।

অন্যদিকে আবু সুফিয়ান ক্রমাগত খবরাখবর সংগ্রহ করছিলেন। বদরের নিকটে পৌছার পর মাজদি ইবনে আমর নামক এক ব্যক্তির সাথে তার সাক্ষাত হয়। তাকে তিনি মদিনার বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে মাজদি স্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি। তবে জানান যে দুইজন উষ্ট্রারোহীকে তিনি টিলার পাশে উট বসিয়ে মশকে পানি পূর্ণ করতে দেখেছেন। তাই আবু সুফিয়ান সতর্কতা হিসেবে সেখানে যান এবং উটের গোবর ভেঙে দেখেন। গোবর থেকে প্রাপ্ত খেজুরের বিচি দেখে বুঝতে পারেন এগুলি মদিনার খেজুর ফলে মুসলিমদের আগমনের ব্যাপারে তিনি সন্দেহমুক্ত হন। এরপর তিনি কাফেলাকে নিয়ে সমুদ্র উপকূলের দিকে ইয়ানবুতে চলে যান। মক্কার বাহিনী জুহফা নামক স্থানে পৌছার পর আবু সুফিয়ানের প্রেরিত বার্তা বাহক এসে জানায় যে কাফেলা নিরাপদ আছে তাই আর অগ্রসর না হয়ে ফিরে যাওয়া উচিত।

এই খবর পাওয়ার পর মক্কার বাহিনীর অধিকাংশ ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত দেয়। কিন্তু বাহিনীর প্রধান আবু জাহল যুদ্ধ না করে ফিরে যেতে এরপর বনু জুহরা গোত্রের মিত্র ও গোত্রটির সেনাপ্রধান আখনাস ইবনে শারিক ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু অধিকাংশ তার পক্ষে সায় না দেয়ায় তিনি বনু জুহরা গোত্রের ৩০০ সদস্য নিয়ে মক্কা ফিরে আসেন। এর ফলে মক্কার বাহিনীতে সেনাসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১,০০০। পরবর্তীতে বনু জুহরা গোত্রের সদস্যরা আখনাসের এই সিদ্ধান্তের কারণে আনন্দ প্রকাশ করেছিল।

একইভাবে বনু হাশিমও মক্কায় ফিরে যেতে চায়। কিন্তু আবু জাহলের জেদের কারণে তারা যুদ্ধে অংশ নেয়। মক্কার বাহিনী অগ্রসর হয়ে বদর উপত্যকার একটি টিলার পেছনে আশ্রয় নেয়। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-

অর্থ: “এবং আমি সংহার করেছিলাম কারুন, ফেরাউন ও হামানকে; মূসা ওদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসহ এসেছিল, তারপরও তারা দেশে অহংকার ও দম্ভ করেছিল; কিন্তু ওরা আমার শাস্তি এড়াতে পারেনি।” (সূরা আনকাবুল, আয়াত: ৩৯)

লেখকের পিছনে রয়েছে মাসজিদুল আরীশ যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের পরামর্শ করেছিলেন।
মুসলিম পরিকল্পনা
এ বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-

অর্থ: “আর স্মরণ করো, আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে দুই দলের এক দল তোমাদের আয়ত্তে আসবে। অথচ তোমরা চাইছিলে যে নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়ত্তে আসুক, আর আল্লাহ চাইছিলেন সত্যকে তার বাণী দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং অবিশ্বাসীদেরকে নির্মূল করতে।” (সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৭)

মুসলিমরা মক্কার বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর পায়। মুসলিম বাহিনীটি মূলত কাফেলা আক্রমণের জন্য গঠিত হয়েছিল, ব্যাপক যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। মুসলিমরা এসময় কুরাইশদের মুখোমুখি না হয়ে ফিরে যেতে পারত কিন্তু এর ফলে কুরাইশদের ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেত এবং তারা অগ্রসর হয়ে মদিনা আক্রমণ করতে পারত। অন্যদিকে বাহিনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মদিনার আনসাররা আকাবার বাইয়াত অনুযায়ী মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য ছিল না এবং অভিযানের ব্যয়ভার তাদের উপর বেশি ছিল। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার জন্য মুহাম্মাদ যুদ্ধসভার আহ্বান করেন। সভায় মুহাজির, আনসার সকলেই কুরাইশদের মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারে মত দেয়। এরপর মুসলিমরা অগ্রসর হয়ে বদরের নিকটে পৌঁছায়।

এখানে পৌঁছার পর মুহাম্মাদ ও আবু বকর প্রতিপক্ষের খবর সংগ্রহের জন্য বের হন। এসময় এক বৃদ্ধ লোককে তারা দেখতে পান। মুহাম্মাদ তাকে মুসলিম ও কুরাইশ উভয় বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। ঐ ব্যক্তি দুই বাহিনী সম্পর্কেই সঠিক তথ্য দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় আলি ইবনে আবি তালিব, যুবাইর ইবনুল আওয়াম ও সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করা হয়। তারা বদরের কূয়ায় দুইজন পানি সংগ্রহরত ব্যক্তিকে বন্দী করেন। জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা জানায় যে তারা মক্কার বাহিনীর সদস্য এবং বাহিনীর জন্য পানি সংগ্রহ করছিল। মুহাম্মাদ এসময় নামাজরত ছিলেন। উপস্থিত মুসলিমরা তার কথার সত্যতা সম্পর্কে সন্দিহান ছিল। তাই তারা তাদের মারধর করে পুনরায় একই প্রশ্ন করে। এরপর তারা জবাব দেয় যে তারা কুরাইশ বাহিনীর নয় বরং আবু সুফিয়ানের কাফেলার লোক।

একথা জানতে পেরে মুহাম্মাদ ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন যে তারা সত্যই বলছিল অথচ এরপরও তাদের মারধর করা হয়েছে। এরপর তিনি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা উপত্যকার শেষ প্রান্তের টিলা দেখিয়ে বলে যে কুরাইশরা তার পেছনে অবস্থান করছে এবং প্রতিদিন নয় বা দশটি উট তাদের জন্য জবাই করা হয়। একথা শোনার পর মুহাম্মাদ বলেন যে তাদের সংখ্যা ৯০০ থেকে ১,০০০ হবে। এরপর বন্দীরা বাহিনীতে আগত সম্ভ্রান্ত কুরাইশ নেতাদের নাম বলে-

বদরের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তাদের মর্যাদার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

উপসংহার
উপরের আলোচনা থেকে বুঝতে পারছি যে, আল্লাহ তাআলা মূসলিম জাতির সামাজিক অবহেলা থেকে মুক্তি প্রদান করা। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-

অর্থ: “যদি কাফেররা ঐ সময়টি জানত, যখন তারা তাদের সম্মুখ ও পৃষ্ঠদেশ থেকে অগ্নি প্রতিরোধ করতে পারবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্ত হবে না।  এভাবে সকল জুলুম নির্যাতন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধি পায়।” (সূরা হজ্ব, আয়াত: ৩৯)

আল্লাহ আমাদেরকে বদরের যুদ্ধ থেকে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক : চেয়ারম্যান, আল হাদিস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়।