Type to search

সহজে কর আদায়েই মনোযোগ বেশি

জাতীয়

সহজে কর আদায়েই মনোযোগ বেশি

‘ধনীরা রাজনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী। ব্যবসায়ীরা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে এনবিআর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। অথচ তাঁরা দিনের পর দিন শুল্ক-কর সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে

সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, এনবিআরের

এখন চাকরিজীবীদের করজালের বাইরে থাকা কঠিন। তবে বাড়ির মালিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীদের অনেকেই করজালের বাইরে রয়ে গেছেন। এঁদের অনেকে কর দিলেও তা প্রকৃত আয়ের চেয়ে কম।

সরকার ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায় করতে পারে না বলে পণ্য ও সেবার ওপর সহজে নানা ধরনের কর আরোপ করা হচ্ছে। যেমন মুঠোফোন সেবা। এখন মুঠোফোনে কথা বলতে একজন মানুষের কাছ থেকে প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে ২৫ টাকা নিয়ে নেয় সরকার। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে মুঠোফোন সেবায় সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। ফলে সব মিলিয়ে করভার দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। উল্লেখ্য, এই সেবার ওপর এখন মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ১৫ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ ও সারচার্জ ১ শতাংশ। সম্পূরক শুল্ক সাধারণত আরোপ করা হয় কোনো পণ্য ও সেবার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে। কিন্তু সরকার এটিকে রাজস্ব আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

এবার করদাতারা যেভাবে কর দেবেন

এবার করদাতারা যেভাবে কর দেবেন

মুঠোফোন সেবায় ‘উচ্চ’ করভার চাপছে দরিদ্রদের ওপরও। গ্রামের একজন নিম্ন আয়ের মানুষকেও ১০০ টাকা ব্যবহারে ২৫ টাকা সরকারকে দিতে হয়। শুধু মুঠোফোন সেবা নয়, এমন নানা পণ্য ও সেবা রয়েছে, যার ওপর বেশি হারে কর আরোপ করে রাখা হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এখানে আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। করোনাকালে ভিটামিন ‘সি’র উৎস হিসেবে বাজারে মাল্টার কদর বেড়েছে। এই পবিত্র রমজান উপলক্ষে ফলটির দাম বেড়েছে। বাজারে এখন এক কেজি মাল্টার দাম ১৮০ টাকা। মাল্টা আমদানিতে করভার মোট ৮৯ শতাংশ। শুধু মাল্টা নয়, এমন উচ্চ হারে কর আরোপ করে রাখা হয়েছে আপেল, কমলা, আঙুরসহ বিভিন্ন ফলের ওপর।

বেসরকারি সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, বাড়তি শুল্কের কারণে দেশের মানুষকে পণ্য কিনতে বছরে ১ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা।

ধনীদের কাছ থেকে কর আদায় বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধনীরা রাজনৈতিকভাবে বেশ শক্তিশালী। ব্যবসায়ীরা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে এনবিআর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। অথচ তাঁরা দিনের পর দিন শুল্ক-কর সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সাধারণত বড় ব্যবসায়ীদেরই বড় করদাতা হওয়া উচিত। কিন্তু দেশের শীর্ষ করদাতা হন কাউছ মিয়ার মতো ব্যবসায়ীরা। আমরা জানি, কারা বড় বড় ব্যবসায়ী, কারা ধনী। কিন্তু আমলা, ব্যবসায়ীদের একটা শ্রেণি নানাভাবে কর ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে।’

আবদুল মজিদ আরও বলেন, বড়দের কাছ থেকে আদায় করতে না পেরে ছোটদের ওপর কর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ধনী-গরিবনির্বিশেষ বিভিন্ন খাতে উৎসে কর বসিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, এই কর আদায় করতে পরিশ্রম করতে হয় না।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সম্পদ করের মাধ্যমে দেশে ধনীদের কাছ থেকে প্রথমবারের মতো বাড়তি পরিমাণে কর আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু আইনি জটিলতা তৈরি হওয়ায় তা পরে বাতিল করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর একটু ভিন্নভাবে আবার ধনীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে আরোপ করা হয় সারচার্জ। বলা হয়, দুই কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে সারচার্জ দিতে হবে। এই কর আরোপের পর প্রথম বছর ৪ হাজার ৪৪৬ জন করদাতা সারচার্জ দেন।

২০১৯-২০ অর্থবছরে আয়কর বিভাগ ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি আয়কর আদায় করেছে। এর মধ্যে ৬০ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা এসেছে উৎসে কর ও অগ্রিম কর থেকে। ঠিকাদার, আমদানি পর্যায়ে এবং সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে অগ্রিম কর আদায় হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।

এনবিআরের তথ্য বলছে, প্রতিবছরই সারচার্জ প্রদানকারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে সংস্থাটির কর্মকর্তারাই মনে করেন, দেশের প্রকৃত ধনীর সংখ্যার তুলনায় সারচার্জ প্রদানকারীর সংখ্যা খুবই কম। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে এমন মাত্র ১৪ হাজার করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন। উল্লেখ্য, শুরুতে সারচার্জ আরোপের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সম্পদসীমা ২ কোটি টাকা ছিল। পরে তা বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, উত্তরা ও পূর্বাচলে প্লট আছে, এমন মানুষের সংখ্যা অন্তত ৫০ হাজার হবে। শুধু পূর্বাচলেই এখন তিন থেকে পাঁচ কাঠার একেকটি প্লটের বাজারমূল্য অন্তত ৩ থেকে ১০ কোটি টাকা। ঢাকার অন্যান্য অভিজাত এলাকায় সেটি আরও বেশি। রাজধানীর বাকি এলাকাগুলোতেও জমির দাম অত্যন্ত চড়া। অবশ্য সারচার্জ আদায়ের ক্ষেত্রে সম্পদের কেনা দাম বিবেচনায় নেওয়ায় বিপুলসংখ্যক সম্পদশালীকে এই কর দিতে হচ্ছে না।

পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, সম্পদের বাজারদরভিত্তিক মূল্যায়ন না হওয়ায় সারচার্জ আদায় করা যাচ্ছে না। সৎ করদাতার প্রতি বৈরী আচরণ করা হচ্ছে। সম্পদের সঠিক মূল্যায়নে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

সারচার্জ আদায়ের ক্ষেত্রে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওপর বেশি নির্ভরশীল এনবিআর। দুই–তৃতীয়াংশ সারচার্জ প্রদানকারী এই দুই অঞ্চলের। বগুড়া, রংপুর, কুমিল্লার মতো জেলা থেকে তেমন কোনো সারচার্জ আদায় হয় না। এনবিআরের সর্বশেষ হিসাবমতে, বগুড়া ও আশপাশের জেলায় মাত্র ৮৯ জন করদাতার সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

ধনীর সম্পদ থাকে প্রতিষ্ঠানের নামে

দেশের বড় বড় করদাতারা বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ) নিবন্ধিত। সেখানে ৭৩৬ জন বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতির কর–নথি আছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাবে, তাঁদের মধ্যে মাত্র ২৩১ জন ৩ কোটি টাকার বেশি সম্পদ কর–নথিতে দেখিয়েছেন। বাস্তবের চিত্র ভিন্ন বলেই মনে করেন কর আদায়কারী। তাঁরা বলছেন, বিত্তশালীরা নিজ নামে সম্পদ রাখেন না। বাড়ি-গাড়ি সবই থাকে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নামে। ফলে প্রতিষ্ঠানের ওপর সারচার্জ আরোপ করা হয় না। তাই বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের কাছে বাড়তি কর হিসেবে সারচার্জ আদায় করা যায় না।

বাংলাদেশে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০২০ সালে বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষ ১০টি দেশের একটি হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ৫০ লাখ ডলার বা ৪৩ কোটি টাকার বেশি (তৎকালীন ডলার দর ধরে) সম্পদের মালিক বেড়েছে ১৪ শতাংশের বেশি।

সাবেক কর কর্মকর্তারা মনে করেন, ধনীদের খুঁজে বের করে কর আদায় কঠিন কিছু নয়। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে জমির মালিক, ফ্ল্যাটের মালিক, গাড়ির মালিকের তালিকা ধরে অনুসন্ধান চালালেই হয়। সে তালিকা সরকারি সংস্থার কাছেই আছে। এ জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

এনবিআর যে ধনীদের খুঁজে বের করতে পারে না, তা নয়। ২০১৭ সালে সংস্থাটি শুল্ক ফাঁকি দেওয়া গাড়ির মালিকদের খুঁজে বের করতে অভিযান শুরু করেছিল। তখন বেশ কয়েকটি গাড়ি ধরা হয়। তখন একটি বিলাসবহুল গাড়ি ঢাকার হাতিরঝিলে ফেলে রেখে যান এক ব্যবসায়ী। সঙ্গে তিনি একটি চিঠিও রেখে যান, যেখানে লেখা ছিল, গাড়িটি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা।

করদাতা মাত্র ২৬ লাখ

বাংলাদেশে এখন পৌনে ১ কোটি কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) রয়েছেন। এর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ টিআইএনধারী প্রতিবছর আয়-ব্যয়ের খবর জানিয়ে রিটার্ন জমা দেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে আয়করদাতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৬ লাখ।

অবশ্য সব টিআইএনধারীর রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক। টিআইএনধারীরা কেন রিটার্ন দেন না, তা নিয়ে এনবিআরের কর কর্মকর্তাদের তেমন উদ্যোগ নেই। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ও বড় শহরগুলোর বাইরে জেলা শহর, উপজেলা পর্যায়ে করযোগ্য ব্যক্তির সংখ্যাও বাড়ছে। কিন্তু তাঁদের করজালের আওতায় আনতে তেমন কার্যকর উদ্যোগ এনবিআরের নেই।

ভারতের কর বিভাগের কর্মকর্তাদের তৎপরতার একটি উদাহরণ দেন এনবিআরের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, কর ফাঁকি ধরতে ভারতের কর কর্মকর্তারা প্রতিবছর গড়ে আড়াই হাজার করদাতার বাড়িতে অভিযান চালান। এই সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে মন্ত্রী-সাংসদ, ব্যবসায়ীরাও বাদ যান না। ভারতের কর বিভাগের কর্মকর্তাদের তল্লাশি ও গ্রেপ্তারি ক্ষমতা দেওয়া আছে, যা বাংলাদেশের কর কর্মকর্তাদেরও আছে।

৮৬ শতাংশই উৎসে কর ও অগ্রিম কর

কর বিভাগ প্রতিবছর যত কর আদায় করে, এর মধ্যে ৮৬ শতাংশই আসে উৎসে কর ও অগ্রিম কর থেকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয়কর বিভাগ ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি আয়কর আদায় করেছে। এর মধ্যে ৬০ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা এসেছে উৎসে কর ও অগ্রিম কর থেকে। ঠিকাদার, আমদানি পর্যায়ে এবং সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে অগ্রিম কর আদায় হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা।

উৎসে কর বা অগ্রিম কর আদায় করতে কর কর্মকর্তাদের তেমন একটা কষ্ট করতে হয় না। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন খাতে সেবা ও পণ্য কেনার বিপরীতে বিল পরিশোধের সময় উৎসে কর কেটে রাখে হয়। আবার আমানত, সঞ্চয়পত্রের সুদের টাকা ওঠানোর সময় ব্যাংক অগ্রিম আয়কর কেটে রাখে ব্যাংক। ঠিকাদারের বিল পরিশোধের সময়ও একইভাবে উৎসে কেটে রাখা হয়।

এনবিআরের হিসাবে, এসব উৎসে কর বা অগ্রিম কর কাটার জন্য সারা দেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ প্রতিষ্ঠান আছে, যারা এনবিআরের পক্ষে উৎসে কর কেটে সরকারের কোষাগারে জমা দেয়। কর কর্মকর্তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছাড়াই ৮৬ শতাংশ কর আদায় হয়ে যায়। বর্তমানে ৫৩টি খাত থেকে এমন উৎসে কর আদায় হয়।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, দেশে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। এটা কমাতে প্রগতিশীল করব্যবস্থা দরকার, যেখানে ধনীদের কাছ থেকে বাড়তি কর আদায় করে দরিদ্রদের পেছনে ব্যয় করতে হবে।

সূত্র প্রতম আলো :

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *