Type to search

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুঙ্খান ; বিবিসি বিশ্লেষণ

আন্তর্জাতিক

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুঙ্খান ; বিবিসি বিশ্লেষণ

ফ্লোরা ড্রুরি

ঠিক এ সময়টাতেই কেন এ ঘটনা ঘটলো? এর পরই বা কী ঘটবে? মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা দখলের পর বিশ্লেষকরা এসব প্রশ্নেরই জবাব খুঁজেছেন।
সোমবারই অং সান সুচির রাজনৈতিক দল এনএলডির নির্বাচনী বিজয়ের পর ক্ষমতায় তাদের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করার কথা ছিল।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যদিও গত দশ বছর ধরেই বেসামরিক সরকারের হাতে ক্রমে ক্রমে ক্ষমতা ছেড়ে দিচ্ছিল; কিন্তু পর্দার আড়ালে তারা দেশটির ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ ঠিকই বজায় রেখেছিল।
দেশটির সংবিধানেও এর নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।
পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন এবং সবচেয়ে ক্ষমতাধর মন্ত্রণালয়গুলো এখনো সামরিক বাহিনীর হাতে।

ঠিক এখনই অভ্যুত্থান হলো কেন
এর ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন নয়। বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা জোনাথন হেড বলছেন, সোমবারই নির্বাচনের পর পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল এবং তাতে নির্বাচনের ফল পূর্ণতা পেতো- যা এখন আর হবে না।
নভেম্বরের ওই নির্বাচনে এনএলডি ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পায়। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যার অভিযোগ সত্বেও এ দলটি এখনো মিয়ানমারে বিপুলভাবে জনপ্রিয়।
কিন্তু ভোটের পর পরই জালিয়াতির অভিযোগ তোলে সামরিক বাহিনী। এক বছরের জরুরি অবস্থা জারিকে যৌক্তিকতা দেওয়ার জন্য নতুন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরিত বিবৃতিতেও এ অভিযোগটি পুনর্ব্যক্ত হয়েছে।
এতে বলা হয়, “৮ নভেম্বরের নির্বাচনে ভোটার তালিকায় যে গুরুতর অনিয়ম ছিল, তার সমাধান করতে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে।”
যদিও এ অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ দেওয়া হয়েছে সামান্যই।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলছিলেন,” অং সান সুচি স্পষ্টতই নির্বাচনে বিপুল বিজয় পেয়েছেন। নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগগুলো অনেকটা ট্রাম্পসুলভ। এসব অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ ছিল না।”
মি. রবার্টসন বলছেন, এই ক্ষমতা দখলের ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন।

সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা হারানোর ভয়
নভেম্বরের নির্বাচনে সামরিক বাহিনী-সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ভোটের খুব সামান্য অংশই পেয়েছে।
কিন্তু তার পরও সামরিক বাহিনী এখনো মিয়ানমারে সরকারের ওপর ব্যাপক প্রভাব রাখতে সক্ষম।
কারণ, ২০০৮ সালে সামরিক শাসনের সময় যে বিতর্কিত সংবিধানটি তৈরি হয়েছিল তাতে সামরিক বাহিনীকে পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ আসন দেওয়া হয়।
অন্য দিকে প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র এবং সীমান্তবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণও তুলে দেওয়া হয় সামরিক বাহিনীর হাতে।
সেই সংবিধান যতদিন বহাল আছে, ততদিন সামরিক বাহিনীর হাতেও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থেকে যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, নভেম্বরের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের ফলে এনএলডি কি সেই সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা পেয়ে যেত?
জোনাখন হেড বলছেন, তেমন সম্ভাবনা ছিল খুবই কম।
কারণ সংবিধান বদলাতে হলে পার্লামেন্টের ৭৫ শতাংশ সমর্থন দরকার। আর, সামরিক বাহিনীর হাতে যদি ২৫ শতাংশ আসন থাকে, তাহলে তা প্রায় অসম্ভব।

‘তাহলে কেন অভ্যুত্থান হলো’
সাবেক সাংবাদিক এবং প্রযুক্তিবিদ আয়ে মিন থান্ট আভাস দিচ্ছেন, এর পেছনে হয়তো আরেকটা কারণ থাকতে পারে।
সেটি হলো, নির্বাচনের এই ফলাফল সেনাবাহিনীকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে।
“তারা আশা করেনি যে, তারা এভাবে হারবে”- ইয়াঙ্গন থেকে তিনি বলছিলেন, “যেসব লোকের পরিবারের সদস্যরা সামরিক বাহিনীতে আছে, এমনকি তারাও তাদের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।”
তবে এটা বলতেই হবে যে, এর চেয়ে অনেক বড় কিছু কারণও আছে।
আয়ে মিন থান্ট বলছিলেন, “আপনাকে বুঝতে হবে সামরিক বাহিনী মিয়ানমারে তাদের অবস্থানকে কীভাবে দেখে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া অং সান সুচিকে দেশের ‘মা’ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। তবে সামরিক বাহিনী নিজেদের মনে করে তারাই এ দেশের পিতা।”
“বিশেষ করে তারা বাইরের লোকদেরকে একটা বিপদ হিসেবে দেখে থাকে।”
করোনাভাইরাস মহামারি এবং নভেম্বরের নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ভো্ট দিতে না দেওয়ায় আন্তর্জাতিক উদ্বেগ- সামরিক বাহিনীর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে যে এখনই কিছু একটা করতে হবে- এমন আভাস দিচ্ছেন আয়ে মিন থান্ট।
কিন্তু তার পরও এ ঘটনা তাকে বিস্মিত করেছে।

‘অনেকেই বুঝতে পারছেন না’
বাস্তবিক, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ঠিক কেন এ ঘটনা ঘটালো, তা বিশেষজ্ঞরাও নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না।
কারণ, এতে তাদের যে বিশেষ কোনো লাভ হবে- তা মনে হচ্ছে না।
“এটা মনে রাখতে হবে যে মিয়ানমারের বর্তমান পদ্ধতি সেনাবাহিনীর জন্য খুবই সুবিধাজনক। তাদের কমান্ড কাঠামোর সম্পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন আছে, তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থসমূহে বেশ বড় পরিমাণ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আছে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের হাত থেকে রাজনৈতিক সুরক্ষাও আছে,” বলছিলেন জেরার্ড ম্যাককার্থি, সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফেলো।
তার মতে, “তাদের কথা মতো এক বছরের জন্য ক্ষমতা দখল করায় তারা চীনা নয়- এমন আন্তর্জাতিক অংশীদারদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, সামরিক বাহিনীর বাণিজ্যিক স্বার্থও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এবং যারা মিস সুচি ও এনএলডিকে আরেক মেয়াদের জন্য ভোট দিয়েছে সেই লক্ষ লক্ষ লোকের দিক থেকে প্রতিরোধের সম্ভাবনা উস্কে দেবে।”
মি. ম্যাককার্থি বলছেন, সামরিক বাহিনী হয়তো ভবিষ্যৎ নির্বাচনে ইউএসডিপির অবস্থা ভালো হবে- এমন আশা করছে, তবে এমন পদক্ষেপের ঝুঁকিও কম নয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন বলছেন, সামরিক বাহিনীর এ পদক্ষেপ মিয়ানমারকে আবার একঘরে রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং জনগণকে ক্রুদ্ধ করে তোলার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
তিনি বলছেন, “আমার মনে হয় না মিয়ানমারের জনগণ এটা বিনা প্রশ্নে মেনে নেবে। তারা সামরিক শাসনে ফিরে যেতে চায় না । বরং তারা অং সান সুচিকে তা প্রতিরোধের এক হাতিয়ার বলে মনে করে।”
ফিল রবার্টসনের মতে, এমন আশা এখনো আছে যে আলোচনার মাধ্যমে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হতে পারে।
“কিন্তু যদি দেখা যায় যে বড় আকারের প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেছে, তাহলে বুঝতে হবে আমরা বড় এক সংকটে পড়েছি।”
[বিবিসির বিশ্লেষণ]

আরও পড়ুন