Type to search

মানুষের সৃষ্টি রহস্য : কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান

অন্যান্য

মানুষের সৃষ্টি রহস্য : কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান

মানুষের সৃষ্টি রহস্য : কুরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান
বিলাল হোসেন মাহিনী
নানা মত, পথ, ধর্ম-দর্শনের এই পৃথিবী।  ধর্ম ও দর্শনের ভিন্নতার কারণে ভিন্ন চিন্তার মানুষের নিকট সৃষ্টি রহস্য ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। নব্বই শতাংশ মুসলিম, যারা বিশ্বাস করে বিশ্বজগতের সব কিছুর স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা। শুধু তাই নয়, যারা অন্যান্য ধর্মের মানুষ, তারাও বিশ্বাস করে তাদের সৃষ্টিকর্তা আছেন। সেখানে ধর্মভেদে কেউ ঈশ্বরকে আবার কেউ গডকে স্রষ্টা জ্ঞান করে। যাইহোক, সকল ধর্মের মানুষের বিশ্বাস হলো তাদের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। ধর্ম বিশ্বাসী কোনো মানুষ এ কথা বিশ্বাস করে না যে, তারা বানর থেকে বা কোনো প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়ে পৃথিবীতে এসেছে। কেননা, পশু-প্রাণী থেকে সৃষ্ট মানুষ কখনো আশরাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা জীব) হতে পারে না।
এখন প্রশ্ন হলো, দেশের ৯৮ শতাংশ ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের বিপরীতে এসে পাঠ্য বইতে কেনো ঢালাওভাবে বানর বা কোনো প্রাণী থেকে মানব সৃষ্টির দর্শন বা শিক্ষা ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের সন্তানদের শেখাতে হবে? হ্যাঁ, বিভিন্ন ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি বিবর্তনের মাধ্যমে যে মানব সভ্যতার সূচনা হয়েছে, সেটা কতিপয় বিজ্ঞানী বা দার্শনিকের মত হিসেবে দেখানো যেতো। কিন্তু না, এমনভাবে বিষয়টি পাঠ্যে আনা হয়েছে যে, মানুষের সৃষ্টি যেনো বানর থেকেই হয়েছে! কী অদ্ভুত চিন্তা!
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে সৃষ্টির নতুন নতুন তথ্য উদ্ধার করছেন। অথচ পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আ.) কে সৃষ্টির পর থেকে মহান আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীবাসীকে এই তথ্য তাঁর রাসুলের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। বলা যেতে পারে, কুরআনই সুশৃঙ্খল কল্যাণকর অকৃত্রিম বিস্ময়কর ঐশী বিজ্ঞান এবং রাসুল (সা.) সর্বকালের যুগশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। প্রমাণ স্বরূপ গুগলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) লিখে সার্চ দিয়ে দেখা যেতে পারে। এছাড়াও বিজ্ঞানময় কুরআন লিখে গুগল সার্চ দিলে খোঁজ মিলবে বিজ্ঞানের শত শাখায় কুরআনের বক্তব্য।
কতিপয় বিজ্ঞান গবেষক ও দার্শনিক বলছেন, বানর থেকে রূপান্তরিত হয়ে মানুষ চারটি ধাপে উন্নীত হয়ে আধুনিক মানবে পরিণত হয়েছে। এই চারটি ধাপের প্রাণীদেরকে নিম্নলিখিত নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ১.অষ্ট্রালোপিথেকাস ২. পিথেকেনথ্রোপাইন ৩.নিন্দারথেলাস ৪. হোমো সেপিয়েন। কিন্তু, এইগুলো একেকজন ব্যক্তি গোষ্ঠীর মত ছাড়া কিছুই নয়। এগুলো কোনো প্রতিষ্ঠিত সত্যও নয়।
পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টির মূল উপাদান পানি। এই মৌলিক উপাদান পৃথিবীর সব জীবদেহের মধ্যে বিদ্যমান। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর (আমি) প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৩০)। জীববিজ্ঞানের মতে, সাগরের অভ্যন্তরের পানিতে যে প্রটোপ্লাজম বা জীবনের আদিম মূলীভূত উপাদান রয়েছে তা থেকেই সব জীবের সৃষ্টি। আবার সব জীবদেহ কোষ দ্বারা গঠিত। আর এই কোষ গঠনের মূল উপাদান হচ্ছে পানি। ভিন্নমতে, পানি অর্থ শুক্র বা শুক্রাণু। তাছাড়া আকাশ ও পৃথিবী বন্ধ ছিল, অর্থাৎ আগে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হতো না এবং জমিনে তরুলতা জন্মাত না। আল্লাহর ইচ্ছায় বৃষ্টি বর্ষিত হলো এবং মাটি তা থেকে উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করে। (ইবনে আব্বাস)
বিজ্ঞানী মাত্রেই স্বীকার করেন, পৃথিবীর জীবকোষের মূল উপাদান পানি, এই পানিই মাটির উৎপাদন ক্ষমতা লাভের প্রধান উপাদান। মহান আল্লাহ এই ধরণিতে মাটি থেকে একজন প্রতিনিধি সৃষ্টি করেন এবং তারপর তার থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এই মানবজাতি। মহান আল্লাহর ভাষায়, ‘হে মানবম-লী! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পরে পরিচিতি লাভ করতে পারো।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে ‘মানব ক্লোন’। এই ক্লোন পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দিতে গেলে পুরুষের জীবকোষের প্রয়োজন। অর্থাৎ একজন পুরুষের জীবকোষ বা শুক্রাণু ব্যতীত একজন নারী সন্তান জন্মদানে অক্ষম। কেননা নারীর ডিম্বাণু (ওয়াই ক্রমোজম) ও পুরুষের শুক্রাণু (্এক্স বা ওয়াই ক্রমোজম) পুত্র-কন্যা সন্তান গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
মানুষ সৃষ্টির আদি কথা :
আদি পিতা আদম (আ.)-এর সৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন বস্তুবাদী গবেষক, দার্শনিক নানা বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। যেমন, আদি মানব সম্প্রদায় বানর ছিল! কালের আবর্তনে পর্যায়ক্রমে বানর থেকে মানবে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান যুগে কি বিশ্বের কোথাও একটি বানর মানবে রূপান্তরিত হয়ে জীবন যাপন করছে? কিংবা কোনো বানরের গর্ভ থেকে মানব সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে ও বেঁচে আছে? অথবা, কোনো মানুষ বিবর্তিত হতে হতে অন্য কোনো রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং তাদের আলাদা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে? এর জবাব হলো নেতিবাচক। এটা সকলের জানা। আদি মানব কী বস্তু থেকে সৃষ্টি তা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মহান আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে ‘কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা।’ (সুরা সাজদাহ, আয়াত : ৭), অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আমি মানবকে বিশুদ্ধ ঠনঠনে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা হিজর, আয়াত : ২৬) অন্য আয়াতে এসেছে, ‘পোড়া মাটির মতো শুষ্ক মাটি থেকে (মানুষকে) সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আর-রহমান, আয়াত : ১৪) আদম (আ.) মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি। কিন্তু মা হাওয়া (আ.) কী দিয়ে সৃষ্টি সে সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর তিনি তার (আদম) থেকে তার যুগল (হাওয়াকে) সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৬) আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি তার (আদম) থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন আর বিস্তার করেছেন তাদের দুইজন থেকে অগণিত নারী-পুরুষ।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১)। মানুষের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ হলো, তিনি তাকে বিশেষ দেহ-কাঠামো দান করেছেন। সুন্দর চেহারা, সুষম দেহ, উপযুক্ত প্রকৃতি ও অঙ্গসৌষ্ঠব আল্লাহর বিশেষ দান। ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।’ (সুরা ত্বিন, আয়াত : ৪)
মানব ভ্রুণ সৃষ্টি : চিকিৎসা বিজ্ঞান ও কুরআন :
চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, গর্ভে সন্তান গঠনের চক্র সাধারণত দীর্ঘ ২৮০ দিন যাবত চলতে থাকে। যা ৪০ দিন অন্তর সুনির্দিষ্ট সাতটি চক্রে বিভক্ত। নারী-পুরুষের যৌন মিলনের সময় নারীর ডিম্বনালির ফানেলের মতো অংশে ডিম্বাণু নেমে আসে। ওই সময় পুরুষের নিক্ষিপ্ত বীর্যের শুক্রাণু জরায়ু বেয়ে ওপরে উঠে আসে এবং তা ডিম্বনালিতে প্রবেশ করে। প্রথমে একটি শক্তিশালী শুক্রাণু ডিম্বাণুটির দেহে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে অন্য কোনো শুক্রাণু প্রবেশ করতে পারে না। এভাবে নারীর ডিম্বাণু নিষিক্ত হয় এবং নিষিক্ত ডিম্বাণুটি জরায়ুতে নেমে প্রোথিত হয়। (গাইনোকলজি শিক্ষা, পৃষ্ঠা : ২২)
এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘আমরা (আল্লাহ) মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমরা তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে (জরায়ুতে) স্থাপন করেছি। এরপর শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে গোশতপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর গোশতপি- থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে গোশত দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুনরূপে করেছি।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১২-১৪) তিনি আরও বলেন, ‘এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত, অতঃপর আমরা একে গঠন করেছি পরিমিতভাবে, আমরা কত সুনিপুণ ¯্রষ্টা।’ (সুরা মুরসালাত, আয়াত : ২২-২৩)। আরও বলা হয়েছে, ‘অতঃপর তিনি তাকে সুষম করেন এবং তাতে রূহ (প্রাণ) সঞ্চার করেন।’ (সুরা সাজদাহ, আয়াত : ৯)
রূহ বা প্রাণ কী? আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা, শক্তি ও তাওফিককেই বলে ‘রূহ’। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তারা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, “(হে নবী) আপনি বলে দিন যে, (রূহ হলো) আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে (একটি) নির্দেশ বা শক্তি, (সূরা ইসরা, ৮৫) ।
মাতৃগর্ভে শিশুকে সংরক্ষণের জন্য মাতৃজঠরের তিনটি পর্দা বা স্তরের কথা কুরআনে বলা হয়েছে। যথা, পেট বা গর্ভ, রেহেম বা জরায়ু এবং ভ্রূণের আবরণ বা ভ্রূণের ঝিল্লি গর্ভফুল। (বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ২৭৭)
এই তিন স্তর সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে, পর্যায়ক্রমে, একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৩৯/৬) আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকে পবিত্র কুরআনে যে ‘ত্রিবিধ অন্ধকারের’ কথা বলা হয়েছে। এই তিনটি অন্ধকার হলো, ১. রেহেম, ২. মাশীমা বা গর্ভফুল এবং ৩. মায়ের পেট।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসা বিজ্ঞান ও কুরআনের তথ্যে চমৎকার মিল রয়েছে। তাহলে বানর থেকে মানুষ হতে যাবে কেনো সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ? বরং, সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কিত ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো সবিস্তরে বর্ণনা করলে সমস্য কী ছিলো? জ্ঞানের কোনো শেষ নেই, যতদিন পৃথিবী আছে, ততদিন মানুষের জানার পরিধি বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তো, মানব সৃষ্টি সক্রান্ত সকল মতবাদ ও জ্ঞান শিক্ষার্থীসহ সকলের সামনে উন্মোচিত হোক। এরপর মানুষ তার চিন্তাশক্তি দিয়ে যাচাই করুক মানব সৃষ্টি সংক্রান্ত কোন মতবাদটি তার কাছে অধিকতর যুক্তিযুক্ত।

বিলাল হোসেন মাহিনী
প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, যশোর ও পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

[email protected]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *