Type to search

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের ৫২তম শাহাদতবার্ষিকী আজ : বিনম্র শ্রদ্ধা

জাতীয়

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের ৫২তম শাহাদতবার্ষিকী আজ : বিনম্র শ্রদ্ধা

বিলাল হোসেন মাহিনী

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের ৫২তম শাহাদৎবার্ষিকী আজ মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর)। ১৯৭১ সালের এই দিনে যশোর জেলার গোয়ালহাটি গ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদৎবরণ করেন তিনি। এদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ এবং দলীয় সঙ্গীদের জীবন ও অস্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন নূর মোহাম্মদ শেখ। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্সনায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন যশোর জেলার নড়াইল সদর উপজেলার চন্ডীবরপুর ইউনিয়নের মহিষখোলা গ্রামে (বর্তমান নাম নূর মোহাম্মদ নগর) জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আমানত শেখ ও মা জেন্নাতুন্নেছা, মতান্তরে জেন্নাতা খানম। বাল্যকালেই বাবা-মাকে হারান তিনি। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ’র জন্মস্থান মহিষখোলার নাম পরিবর্তন করে ২০০৮ সালের ১৮ মার্চ নূর মোহাম্মদ নগর করা হয়। বর্তমানে উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে নূর মোহাম্মদ নগর। তার স্মৃতিরক্ষার্থে নূর মোহাম্মদ নগরে নির্মাণ করা হয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’ এবং স্মৃতিস্তম্ভ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৫৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) যোগদান করেন নূর মোহাম্মদ শেখ। দীর্ঘদিন দিনাজপুর সীমান্তে চাকরি করার পরে ১৯৭০ সালের ১০ জুলাই যশোর সেক্টরে বদলি হন। পরে ল্যান্স নায়েক পদোন্নতি পান তিনি। ১৯৭১ সালে যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যশোর জেলার গোয়ালহাটি ও ছুটিপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে তিন সঙ্গীকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করার অনন্য নজির স্থাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ সরকার তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। নূর মোহাম্মদ যশোরের শার্শা উপজেলার কাশিপুর সীমান্তের বয়রা অঞ্চলে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ শত্রুমুক্ত করেন। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখকে শার্শা উপজেলার কাশিপুর গ্রামে দাফন করা হয়।

নূর মোহাম্মদ শেখের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে নূর মোহাম্মদ নগরে জেলা প্রশাসন ও বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ ট্রাস্টের আয়োজনে মাজার জিয়ারত, র‌্যালি, পুষ্পমাল্য অর্পণ, সশস্ত্র সালাম, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

শাহাদাৎ-এর ঘটনা : হানাদারদের সম্ভব্য পরিকল্পনা বুঝে উঠতেই নূর মোহাম্মদ সঙ্গীদের নিয়ে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করেন। শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। মারাত্মক আহত হন সঙ্গী নান্নু মিয়া। তাকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলে হানাদারদের মর্টার শেল মারাত্মকভাবে জখম করে নূর মোহাম্মাদকে। মৃত্যু আসন্ন বুঝে তিনি সিপাহী মোস্তফা কামালের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়ে আহত নান্নু মিয়াকে নিয়ে সবাইকে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলেন। উপায়ান্তর না পেয়ে সঙ্গীরাও তাই করলেন। কিন্তু একটি এসএলআর রেখে যান মারাত্মক আহত কমান্ডারের কাছে। নূর মোহাম্মাদ মৃত্যুপথযাত্রী হয়েও এসএলআর নিয়ে শেষবারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন হানাদারদের ওপর। সেখানেই তিনি শহীদ হন। পরবর্তীতে নিকটবর্তী একটি ঝোঁপের মধ্যে এই বীরের মরদেহ পাওয়া যায়। শত্রুর বেয়নেটে তার দেহ ছিল ক্ষত-বিক্ষত, চোখ দু’টি কোটর থেকে উপড়ে ফেলেছিল নরঘাতকরা। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

আকস্মিক গোলাগুলির মুখে সতর্ক হয়ে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধারা। সংখ্যায় তাঁরা ছিলেন মাত্র চারজন নূর মোহাম্মদ শেখ, মোস্তফা কামাল (বীরপ্রতীক), নান্নু মিয়া (বীর প্রতীক) ও আরেকজন। শত শত গুলি ধেয়ে আসতে থাকে তাঁদের দিকে। তাঁরা বুঝতে পারেন, পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের আক্রমণ করেছে। সাহসের সঙ্গে তাঁরা চারজন আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকেন। এ ঘটনা গোয়ালহাটিতে। ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। গোয়ালহাটি যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার অন্তর্গত সীমান্তবর্তী এলাকা।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য সুতিপুর প্রতিরক্ষার অগ্রবর্তী এলাকা গোয়ালহাটিতে নিয়োজিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্ট্যান্ডিং প্যাট্রোল পার্টি। এই প্যাট্রোল পার্টির অধিনায়ক ছিলেন নূর মোহাম্মদ শেখ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের এই স্ট্যান্ডিং প্যাট্রোলের অবস্থান কীভাবে যেন টের পেয়ে যায়। খবর পাওয়া মাত্র তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে তিন দিক থেকে ছোট ওই প্যাট্রোল পার্টির ওপর আক্রমণ চালায়। জরুরি অবস্থা বুঝতে পেরে নূর মোহাম্মদ শেখ সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন।

কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা ছিল অনেক ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারেন, তাঁরা বেশিক্ষণ পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে লড়াই করতে পারবেন না। মূল প্রতিরক্ষা অবস্থানের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁরা পেছনে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এ সময় নান্নু মিয়া গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আহত নান্নু মিয়াকে কাঁধে নিয়ে নূর মোহাম্মদ শেখ গুলি করতে করতে পেছনে সরে আসছিলেন। তখন হঠাৎ দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলার আঘাতে তাঁর ডান পায়ের হাঁটু ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
বিপর্যয়কর এই অবস্থায় নূর মোহাম্মদ শেখ দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করেন। তিনি সহযোদ্ধা মোস্তফা কামালকে নির্দেশ দেন, আহত নান্নু মিয়াকে কাঁধে করে নিয়ে পেছনে সরে যেতে। আর তাঁদের পশ্চাদপসরণের সহযোগিতার জন্য কাভারিং ফায়ার দেওয়ার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন। মোস্তফা কামাল তাঁকে ফেলে কোনোভাবে পিছু হটতে রাজি ছিলেন না। নূর মোহাম্মদ শেখ জোর করে তাঁদের পেছনে পাঠান। এরপর মর্টার শেলের আঘাতে যন্ত্রণায় কাতর নূর মোহাম্মদ একাই লড়াই করতে করতে শহীদ হন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা: খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, দ্বিতীয় খন্ড, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা ২০১৩