Type to search

বাঙালির আত্মচিন্তা ও আত্মদর্শন

সাহিত্য

বাঙালির আত্মচিন্তা ও আত্মদর্শন

বিলাল মাহিনী

বাঙালি আত্মকেন্দ্রিক, একগুয়ে ও বহু মত-পথে বিভক্ত জাতি! এর কারণ বাঙালি সংকর জাতি। আমাদের রক্তে মিশে আছে প্রাচীন আর্য থেকে শুরু করে সর্বশেষ পাকিস্তানি ‘জিন’। কারো কারো মতে, বাবা আদম থেকে শুরু করে যতো জাতের, রঙের, বিশ্বাসের মানুষ এই পৃথিবীতে চরেছে; তার বোধ হয় প্রায় সবার রক্ত বাঙালির শিরায় পাওয়া যাবে! সিন্ধুর অববাহিকায় গঙ্গা, পদ্মা, নাফ, সুরমা হয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদী, উপনদী, শাখা নদী, খাল-বিলের পাদদেশে গড়ে উঠা জনপদের একটি বিশাল অংশ এই (পশ্চিম ও পুব) বঙ্গে  বাস করে। সিন্দু তীরের বাসিন্দা এই জনপদের মানুষ নিজেদের ‘হিন্দু’ বলতো। যাদের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। এই হাজার বছরে এই অঞ্চলে ব্যবসায়-বাণিজ্য, ধর্ম প্রচারসহ নানা কাজে আফ্রিকা-ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর তাবত দেশের মানুষের আসা-যাওয়া ছিলো, এখনো আছে। বিভিন্ন অঞ্চল, ভাষা, বর্ণ ও সংস্কৃতির লোকজন এ অঞ্চলে এসে অনেক সময় আর নিজ দেশে ফিরে যায়নি। যার ফলে তারা এদেশে বৈবাহিক সূত্রে বসতি গড়েছে। পরবর্তিতে দেখা গেছে, এই বঙ্গের মানুষ আর একই বর্ণ-গঠন-ভাষা ও সভ্যতায় একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি।

এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে বহুমূখী জ্ঞান নেই। তুলনামূলক স্টাডি (গবেষণা) নেই বললে চলে। সত্য জানা ও তা প্রকাশের আগ্রহ নেই। আর আজকের আধুনিক যুগে এ বঙ্গের মানুষের সাথে আর মাটির সম্পর্কও তেমন নেই। বর্তমানে বেশিরভাগ ছাত্র-যুবক শুধু বিনোদনের নিমিত্তে অনলাইনে ডুবে থাকে। উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনায় ভরা অশ্লিল ভিডিও দেখে বহু কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে তরুণ-যুবকদের। স্মার্টফোনসহ ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণায় কাজে লাগানো যায় আজকের ক’জন বাঙালি তা বোঝে? অন্যদিকে পল্লী অঞ্চলের অর্ধশিক্ষিত মানুষ আগের মতো আর মানবিক হয়ে উঠছে না। নগরে তো নয়ই। বাঙালি সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য জানে না। জানলেও মানে না হালাল-হারাম। হাজারো যুক্তিবানে জর্জরিত বাঙালির মগজ। এখানে কেউ বা কতেক মানুষ একটা ভালো কাজের উদ্যোগ নিলে তাতেও বিপক্ষ তৈরি হয়ে যায়। বাঙালি কেউ কারো ভালো চায় না। বাঙালি সবকিছুতে যুক্তি খোঁজে। ভাবে; যুক্তিতেই মুক্তি। এখানে সফলতার মানে বিত্ত-বৈভব ও ক্ষমতা। তাছাড়া বাঙালি প্রচ- আত্মকেন্দ্রিক ও একরোখা। পৃথিবীর তাবত দর্শন বাঙালির কাছে হার মানে। কতোভাবে যে বাঙালি বিভক্ত তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আর মুসলিম বাঙালির তো মতপার্থক্যের শেষ নেই। তারা ধর্মকে কতোপ্রকারে যে বিভক্ত করে রেখেছে তা নির্ণয় অসম্ভব। কেউ সুন্নি আবার কেউ শিয়া। কেউ পীরপন্থি তো কেউ তার বিরুদ্ধ। একই মাসয়ালার কতো রকম যে ফতোয়া, তা বলা মুশকিল। সবাই কুরআন ও সহিহ হাদিস দিয়ে দলিল দেন। বিবি তালাকের ফতোয়া থেকে শুরু করে জিহাদের বিধান; সর্বত্র বহু মত বহু সিদ্ধান্ত। এখানে প্রত্যেক হুজুরই নিজেকে বা নিজের ফতোয়াকে সঠিক ভাবেন, অন্যেরটা ভুল।

বাঙালির আর একটা পরিচয় হলো, এরা বেইমান, মুনাফিক। সে যে পাতে খায় সেই পাতেই হাগু করে। এরা জাতির পিতাকে পর্যন্ত হত্যা করেছে। হত্যা করেছে রণাঙ্গনের বীর সেক্টর কমা-ার বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়াউর রহমানকেও। বাঙালি নবীর সুন্নাত (দাঁড়ি) মু-ন করে  হয় মসজিদের সভাপতি আবার যাত্রাপালা বা কনসার্টের অতিথি। ওয়াজ মাহফিলও দেয়, আবার (মুসলিমদের দৃষ্টিতে) হারাম বাদ্যযন্ত্রের গানের আসরও বসায়। বাঙালি মুখে সুদ-ঘুষের বিরোধিতা করে আবার প্রয়োজনে সুদ-ঘুষের লেনদেনও করে। মানে বহুরূপী আর কি!

অসৎ পথের ইনকাম হারাম জ্ঞানে, আবার হারামখোরদের অর্থে মসজিদ-মাদরাসা গড়ে। কী অদ্ভত বাঙালি! গোপনে আ’লীগ-বিএনপি বা নেতা-নেত্রী’র গোষ্ঠি উদ্ধার করে আবার সামনে প্রশংসার ফুলঝুরি উড়ায়। পা-চাটা গোলাম আর কি! বাঙালি মূর্খের কদর করে, অবজ্ঞা করে জ্ঞানী ও গুণী মানুষকে। বাঙালি সমালোচনা করতে জানে, সইতে জানে না। শৃঙ্খলার বুলি আওড়িয়ে বিশৃঙ্খলায় গা ভাসায়। বাঙালি পরস্পর ফাঁকিদানে পটু। ওজনে কম দেয়া, দুধে জল মেশানো, ভালোর সাথে খারাপ মিশিয়ে বেচে দিতে বাঙালি খুবই দক্ষ। অপরকে ঠকিয়ে নিজেকে খুব চালাক মনে করে বাঙালি। তবে পরাধীনতা বাঙালির বড্ড ভালো লাগে। তাইতো হাজার বছর ধরে নানা ফরমেটে দাসত্ব বরণ করে আসছে বাঙালি। চাটুকারিতা, ঈর্ষা, লোভ বাঙালির রক্তে মিশে আছে। বাঙালি অলস জাতি। সে বাধ্য না হলে নড়ে না। কর্মবিমূখতা বাঙালির স্বভাবজাত ধর্ম। সে স্বার্থপর। ত্যাগ বোঝে না। অধ্যাবসায় ও শ্রম ছাড়াই পেতে চায় সাফল্য। বাঙালি পড়ে ও লেখে ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ কিন্তু কাম করে উল্টো। তবে বাঙালি নিজেকে প্রতিষ্ঠায় ছুটে চলে অবিরত। ধন-সম্পদ অর্জনে ছাড় দিতে নারাজ বাঙালি। উপার্জনে হালাল-হারাম বাছ-বিচার করার টাইম নেই বাঙালির। বর্তমানে (বাংলাদেশি) বাঙালি রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে ত্রিবিভক্ত। একদিকে বঙ্গবন্ধু’র আদর্শ, দ্বিতীয়ত শহীদ জিয়ার দর্শন। আর তৃতীয়ভাগে ধর্মভিত্তিক বিশেষতঃ মুসলিম দর্শন। যদিও ধর্মীয় বলয়ে একক আধিপত্য নেই কোনো ব্যক্তি বা দলের। তবে এই তিন বিভক্তির বাইরে একটা গোষ্ঠী আছে, যারা সাম্য মানবিক মর্যাদা সামাজিক সুশাসন ও গণ মানুষের অধিকারের নিমিত্তে বেড়ে উঠছে। তবে ঐ যে সমস্যা, বহুধা বিভক্ত বাঙালির ঐক্যের অভাব। যার করণে ফলাফল শুণ্য। ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধকে সর্বোচ্চ সম্মান জানিয়ে এবং এই দুই মহান বিষয়কে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নিজস্ব শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্বকীয়তায় একটি প্লাটফর্ম গড়ে উঠবে এমন প্রত্যাশা বিজ্ঞজনের।
তবে সেখানেও নানা মত পথ ও দরজা। বাঙালি স্বভাবসূলভ লক্ষহীন, নেতৃত্বহীন। নির্জিব রক্ত-মাংসের জীব। বাঙালি গুজবে পটু। নানা ইস্যুতে মূহুর্তে ফেটে পড়ে আবার সামান্য আঘাতে ভেঙ্গেও পড়ে। বাঙালি ভীতু। একটা ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে উঠছে বাঙালি সমাজে। যে যার মতো চলতে পছন্দ করছি আমরা। সামান্য স্বার্থে কথা বন্ধ হয়ে যায় রক্তের সম্পর্কের সাথে, প্রতিবেশির সাথে। অপরের বিরোধীতা করা বাঙালির অভ্যেস। হোক সে নোবেল জয়ী কিংবা মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি।

বাঙালি এই নোংরা আত্মদর্শন থেকে বেরিয়ে আসুক। নিজেকে সমৃদ্ধ করুক শিক্ষা ও দীক্ষায়। সভ্যতা শিখুক। হোক সভ্য। অপরের কল্যাণকামী হোক। সত্য বলা ও সত্যের ওপর অটল থাকতে শিখুক। নিজেকে কলুষমুক্ত করে আগামির বাংলাদেশ, সমৃদ্ধির বাংলাদেশ গড়ে তুলুক। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের দেশ গড়–ক।  প্রত্যেকে ফিরে পাক স্ব স্ব অধিকার। ভালোবাস ও ভ্রাতৃত্বে গড়ে উঠুক আমার বাংলাদেশ। স্বতন্ত্র বাঙালি জাতি। (কৈফিয়ত : এখানে বাঙালি বলতে সবাইকে নয়, বেশিরভাগের চিন্তা, ধর্ম, দর্শন ও কর্ম তুলে ধরা হয়েছে। তারপরও লেখাটি কারও মনোকষ্টের কারণ হলে ক্ষমার চোখে দেখার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।)