Type to search

বাংলা সাহিত্যে গদ্য ও পদ্য

সাহিত্য

বাংলা সাহিত্যে গদ্য ও পদ্য

বিলাল মাহিনী

বাংলা ভাষা পৃথিবীর সর্বাধিক প্রচলিত ও ব্যবহৃত ভাষা সমূহের মধ্যে অন্যতম। বাংলা ভাষার প্রশাসনিক রাজধানী ঢাকা। আর বাণিজ্যিক রাজধানী কোলকাতা তথা পশ্চিম বাংলা। বাংলা ভাষার প্রশাসনিক রাজধানী ঢাকা এজন্য যে, সমগ্র দেশে এ ভাষা প্রশাসনিকভাবে প্রথম ও জনসাধারণের প্রধান ভাষা। বাংলাদেশের মাতৃভাষা বাংলা। যদিও কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও উপজাতির নিজস্ব ভাষা রয়েছে। তথাপি বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশীদের সার্বজনীন ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে পশ্চিমবাংলাকে বাংলা ভাষার বাণিজ্যিক রাজধানী বলার কারণ হলো, সে দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষের ভাষা হিন্দি। রয়েছে ইংরেজির ঢের প্রচলন। তাছাড়াও ভারতে রাজ্য ও প্রদেশ ভিত্তিক ভাষাকে গুরুত্ব দেয়া হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম, ঝাড়খ-, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বাংলা ভাষার ব্যবহার দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজির ব্যবহারও চোখে পড়ার মতো। তবে বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কোলকাতা কেন্দ্রীক বাংলার রয়েছে যথেষ্ট ভুমিকা। বাংলা সাহিত্যে নোবেলটাও এসেছে কোলকাতা কেন্দ্রীক বাংলা সাহিত্যের হাত ধরে।

পৃথিবীর প্রসিদ্ধ প্রায় সব ভাষারই সাহিত্য ভাণ্ডার রয়েছে। সাহিত্যে প্রধানত দুটি ধারা লক্ষণীয়। গদ্য ও পদ্য। গদ্য সাহিত্যে থাকে উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গল্প, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী, ফিচার, সংবাদ পরিক্রমা ও পর্যালোচনা, থাকে সাহিত্য সমালোচনার নানা দিক ও বিভাগ। পদ্য সাহিত্যেও রয়েছে কয়েকটি শৈল্পিক ধারা। এক কালের পুঁথিগাঁথা ও পালাগান থেকে পদ্যছন্দের সৃষ্টি বলে মনে করেন অনেকে। পদ্য বলতে ছন্দবদ্ধ শব্দ বিন্যাসকে বুঝালেও এখন পদ্য সাহিত্যে লেগেছে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার ছোঁয়া। পদ্য সাহিত্যকে এখন কবিতা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বেশিরভাগ কবি-সাহিত্যিক। আধুনিক পদ্য সাহিত্যে গদ্য কবিতার প্রভাব বেশি। তবে ছড়া কবিতার আবেদন কমেনি কখনো। কবিতায় এখন চতুর্দশপদী ও দীর্ঘ কবিতার চলও শুরু হয়েছে। তবে মহাকাব্যের দেখা মেলা ভার আজকের বাংলা সাহিত্যে। আমরা আজকের আলোচনায় গদ্য সাহিত্যের দুটি শাখা (গল্প ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ) এবং পদ্য সাহিত্যের দুটি শাখা (ছড়া কবিতা ও আধুনিক গদ্য কবিতা) সম্পর্কে জানবো।

বাংলা পদ্য সাহিত্য রচনা শুরু চর্যাপদ থেকে; কিন্তু গদ্যের ইতিহাস ততটা প্রাচীন নয়। গদ্যের চারিত্র্য নির্ভর করে শব্দের ব্যবহার এবং বাক্যে পদ (শব্দ) স্থাপনার ক্রমের ওপর। আধুনিক যুগে গদ্যের প্রধান দুটি ব্যবহার হলো কথাসাহিত্য (গল্প-উপন্যাস) এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধ। আঠারো শতকে বাংলা গদ্যের বিকাশ সূচীত হয়েছিল একটি সরল কাঠামো নিয়ে। গদ্য সাহিত্য হলো মানুষের কথ্য ভাষার লেখ্যরূপ। এর বিপরীত হলো পদ্য বা কাব্য। গদ্যের প্রাথমিক ব্যবহার চিঠিপত্র লেখায়, দলিল-দস্তাবেজ প্রণয়নে এবং ধর্মীয় গ্রন্থাদি রচনায়। পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারক ম্যনোএল দা আস্সুম্পসাঁউ-এর রচনা রীতি বাংলা গদ্যের অন্যতম আদি নিদর্শন। প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত ‘আলালের ঘরে দুলাল’ বাংলা ভাষায় রচিত আদি গদ্যসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এটি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থের ভাষা ‘আলাল ভাষা’ নামে পরিচিত। বাংলা গদ্য শুরুতে ছিলো সংস্কৃতি গদ্যের চালে রচিত যার প্রমাণ বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ। প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন। ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ পাদ্রী উইলিয়াম কেরিকে বাংলা গদ্যের পথিকৃৎ বলা হয়, তবে বাংলা গদ্যের জনক হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। পরবর্তীতে বাংলা গদ্য সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে যারা ভুমিকা রেখেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- প্যারিচাঁদ মিত্র, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, গিরিশ চন্দ্র সেন, বঙ্কিম চন্দ্র, মীর মোশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, স্বামী বিবেকানন্দ, প্রমথ চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, জীবনানন্দ দাস, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জহির রায়হান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হুমায়ুন আহমেদ, আহমদ ছফা প্রমুখ।

কবিতা, কাব্য বা পদ্য হচ্ছে শব্দ  প্রয়োগের ছান্দসিক কিংবা অনিবার্য ভাবার্থের বাক্য বিন্যাস- যা একজন কবির আবেগ-অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তা করার সংক্ষিপ্ত রূপ এবং তা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে আন্দোলিত সৃষ্টির উদাহরণ। পৃথিবী নামক গ্রহের তাবৎ বিষয়কে পুজি করে কবিতা ফলত সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে। কাঠামোর বিচারে কবিতা নানা রকম। যুগে যুগে কবিরা কবিতার বৈশিষ্ট্য ও কাঠামোতে পরিবর্তন এনেছেন। কবিতা শিল্পের মহত্তম শাখা হিসেবে পরিগণিত।

বাংলা পদ্য সাহিত্যের নক্ষত্রের নায়কদের মধ্যে রয়েছেন- আব্দুল হাকিম, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কাহ্নপা, কায়কোবাদ, কালিদাস রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, লালন সাঁইজি, সুকান্ত, সুফিয়া কামাল, হেলাল হাফিজ, জীবনানন্দ দাস, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হাসন রাজা, হুমাউন আজাদ, তসলিমা নাসরিন, আল-মুজাহিদী, মতিউর রহমান মল্লিক প্রমুখ।

কবিতা বহু প্রকারে বিভক্ত : রুবাই, ক্বাসিদা, চতুর্দশপদী, লিমেরিক, গজল, শব্দকবিতা, চ্যাটি কবিতা, অণুকবিতা, পরমাণু কবিতা। কবিতার রয়েছে কয়েকটি ধারা : আখ্যান কবিতা, মহাকাব্য, নাট্যকাব্য, বিদ্রুপাত্মক কবিতা, গীতিকাব্য, শোককাব্য, পদ্য আখ্যান, গদ্য কবিতা। আধুনিক পদ্য সাহিত্যে গদ্য কবিতার প্রভাব বেশি। গদ্য কবিতা বলতে সে সব কবিতাকে বুঝায় যেগুলো গদ্যে লিখিত হয়। এগুলো পদ্য ও গদ্যের সংমিশ্রণে সৃষ্ট। প্রকৃতির বাস্তবতার কাব্যিক ব্যঞ্জনার নাম গদ্য কবিতা বলে মনে করেন অনেক আধুনিক কবি। তবে এটিকে কবিতা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারো মতে গদ্য কবিতা একটি বিশেষ ধারার কবিতা; কেননা এটা রূপক ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। অপর কারো মতে গদ্য কবিতা মূলতঃ গদ্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘গদ্যকাব্য নিয়ে সন্দিগ্ধ পাঠকের মনে তর্ক চলছে। এতে আশ্চর্যের বিষয় নেই। ছন্দের মধ্যে যে বেগ আছে সেই বেগের অভিঘাত রসগর্ভ বাক্য সহজে হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করে, মনকে দুলিয়ে তোলে, এ কথা স্বীকার করতে হবে। তবে ছন্দটাই যে ঐকান্তিকভাবে কাব্য তা নয়। কাব্যের মূল কথাটা থাকে রসে, ছন্দটা এই রসের পরিচয় দেয় তার অনুষঙ্গ হয়ে। পদ্য ছন্দে বললেই যে তা কবিতা হবে- এমন ধারণা ঠিক নয়। কারণ কবিতা ও পদ্য একই বিষয় নয়। কবিতা সাহিত্যের অন্যান্য প্রকরণ নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প প্রভৃতির মতো একটি পৃথক সাহিত্য প্রকরণ। কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তার প্রকৃতিগত কিছু বৈশিষ্ট দরকার- যেগুলো থাকলেই আমরা তাকে কবিতা বলতে পারবো। অথচ প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট না জানার কারণে বহুজন কবিতা ও পদ্যকে সমার্থক মনে করেন। এর অন্যতম একটা কারণ হতে পারে, দীর্ঘদিন পদ্যই ছিল আমাদের সাহিত্যের মাধ্যম। তার ফলে রাধা-কৃষ্ণের লীলা থেকে শুরু করে গৌড়ীয় বৈষ্ণবতত্ত্বের মতো দুরূহ গ্রন্থও লেখা হয়েছে পদ্য মাধ্যমেই। কবিতায় ছন্দ এবং অন্ত্যমিলের ব্যবহার করা বা না করা, পদ্য ও কবিতার মধ্যে অন্যতম একটি পার্থক- এমন কথাও অনেকে বলেন।

কাব্যরূপ ও আঙ্গিকের বিচারে ছন্দের প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া চলে না। তার জন্মলগ্ন থেকে কবিতা দীর্ঘকাল অন্ত্যমিলসম্পন্ন, নিরূপিত ছন্দের অধীনের ছিলো। ছন্দ বলতে অন্ত্যমিলসম্পন্ন ছড়াকে বোঝাচ্ছি না। ছন্দের দোলা, মিল থাক বা না থাক, কাব্যিক প্রকারান্তরে বলা যেতে পারে এক ধরনের ছন্দ-স্পন্দ এবং কবিরা প্রায় সকলেই এই সঙ্গীতধর্ম বজায় রেখে থাকেন। কবি যখন একটি বিশেষ আবেগকে বাণীরূপ দান করেন, তখন কোনও একটি ছন্দের স্পন্দিত রূপবন্ধনেই তা প্রকাশিক হয়। এই সমিল, সুষম ছন্দে বিধৃত রূপবন্ধ কবিতার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নয়। কবিতা ছন্দবদ্ধ কথা নাও হতে পারে। “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পুনশ্চ’ কাব্যের ভূমিকায় বলেছেন, “পদ্যকাব্যে ভাষার ও প্রকাশরীতিতে যে একটা সসজ্জ সলজ্জ অবগুণ্ঠনপ্রথা আছে, তাও দূর করলে তবেই গদ্যের স্বাধীন ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে। অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব এই আমার বিশ্বাস।’
পদ্য সাহিত্যে ‘গদ্য’ও  কবিতার মাধ্যমে হতে পারে, যদি তাতে থাকে ছন্দস্পন্দ, থাকে তাল ও লয়ের সৌন্র‌্যসুষমা- যা কবিতার আবেগী, কল্পনাশ্রয়ী প্রকাশের উপযোগী হয়। অবশ্যই সে গদ্য বিজ্ঞান বা তর্কশাস্ত্রের বস্তুনিষ্ঠ গদ্যের থেকে একেবারেই আলাদা। জীবনানন্দ দাশের একটি লেখা পড়লেই বোঝা যাবে, গদ্যেও রচিত হতে পারে হৃদয় ছোঁয়া কবিতা।
‘সোমেনও বললে, মনে পড়ে একদিন বকমোহনার নদীর পাড়ে ভাঁটশ্যাওড়া/ জিউলি ময়নাকাঁটা আলোকলতা জঙ্গলে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম; বাড়ি/ তোমাদের আধ ক্রোশ দূর সেখান থেকে; তুমি ঘাড় নেড়ে বলেছিলে, “খুব পারব/ চিনে যেতে- কতবার গিয়েছি!”- কিন্তু একবারও যাওনি; আম কাঁঠাল বাঁশের জঙ্গলে হারিয়ে গেলে।’

ওপরে উদ্ধৃত অংশটি একটু মনযোগ দিয়ে পড়লে পদ্য কবিতার অবশ্যম্ভাবী মাধ্যম বা কাঠামো- এমনটা হতে পারে; তা মেনে নেওয়া কঠিন। রাখতে হবে, বর্তমান সময়ে গদ্যমাধ্যমে কবিতা লেখার প্রবণতা ক্রমবিস্তার লাভ করছে, তবে কবিতা লেখার জন্য কবিতার নিদিষ্ট শিল্পরূপ জানতে হবে- এর কোন বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, ছন্দের মিলই কখনো কবিতা হতে পারে না; কবিতা যখন আবেগ-অনুভূতিতে-কল্পনায়-চেতনায় এক বাচনিক রূপ হয়ে ফুটে উঠবে, ছন্দ তখন তার অস্তিত্বের অঙ্গীভূত হয়ে থাকবে; তখনই তা কবিতা হয়ে উঠবে।

আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি/ ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল/ শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে/ তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো কিন্তু সেই বোষ্টুমী আর এলো না।’

কবিতা ও ছড়ার মধ্যে রয়েছে কিছু পার্থক্য। যেমন সাহিত্যিক ও ব্যাকরণবিদ ড. মোহাম্মদ আমীন বলেন- ‘ছড়া, সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা। বলা হয় ছড়ার মাধ্যমে সাহিত্যের সূচনা। সাধারণভাবে স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত মুখে মুখে উচ্চারিত ঝংকারনিনাদ পদ্যই ছড়া।’ তবে, সাধারণত: কবিতা ও ছড়ার মধ্যে পার্থক্য হলো কবিতাতে শিক্ষামূলক অনেক কিছু থাকে কিন্তু বেশিরভাগ ছড়ায় শিক্ষামূলক তেমন কিছু থাকে না।

ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘দূরের পাল্লা’ কবিতায় লিখেছেন-
ছিপখান তিন-দাঁড়/ তিনজন মাল্লা,/ চৌপর দিন-ভোর/ দ্যায় দূর-পাল্লা!
পাড়ময় ঝোপঝাড়/ জঙ্গল-জঞ্জাল,/ জলময় শৈবাল/ পান্নার টাঁকশাল ।
কঞ্চির তীর-ঘর/  ঐ-চর জাগছে,/ বন-হাঁস ডিম তার/ শ্যাওলায় ঢাকছে।
চুপ চুপ ওই ডুব/ দ্যায় পান্ কৌটি/ দ্যায় ডুব টুপ টুপ/ ঘোমটার বৌটি!

আবার কবিগুরু রবি ঠাকুর লিখেছেন ‘সোনার তরী’ কবিতায়-
‘এতকাল নদীকূলে/ যাহা লয়ে ছিনু ভুলে’/ সকলি দিলাম তুলে/ থরে বিথরে/ এখন আমারে লহ করুণা করে’!
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই! ছোট সে তরী/ আমারি সোনার ধানে গিয়াছে ভরি’।
শ্রাবণ গগন ঘিরে/ ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,/ শূন্য নদীর তীরে/ রহিনু পড়ি’,
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।’

ফকির লালন সাঁইজি (১৭৭৪-১৮৯০) ভক্তিমনে প্রার্থনা করেছেন এভাবে-

‘ক্ষমো ক্ষমো অপরাধ/ দাসের পানে এশবার চাও হে দয়াময়
বড়ো সংকটে পড়িয়া এবার/ বারে বারে ডাকি তোমায়।’
তিনি আরো বলেন-
‘আমি অপার হয়ে বসে আছি/ ও হে দয়াময়
পারে লয়ে যাও আমায়।’
পদ্য ছন্দে রচিয়া পংক্তি হাসন রাজা বলেন-
‘কান্দে কান্দে হাসন রাজা, কি হবে উপায়/ হাশরের দিন যখন পুছিবে খোদায়
ছাড় ছাড় হাসন রাজা এই ভবের আশ/ একমনে চিন্তা কর, হইবায়, বন্ধে দাশ।’
এছাড়াও সোনাবন্দের রূপে হাসন রাজার বাঁকা দুই নয়নে নেশা লেগে যায়, তিনি লেখেন-
‘নিশা লাগিলরে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিল রে/ হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে…।’

সাম্যবাদী কবিতায় বাঙালির জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-

‘গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/ যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।’
তিনি আরও লেখেন-
‘উহার প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ;/ আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।
উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,/ আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।’

জাতীয় জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ লিখেছেন-

‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?/ দীঘল রাতের শ্রান্ত সফর শেষে
কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে/ আমরা পড়েছি এসে?
এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব/ তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব
অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।/ তুমি মাস্তুলে, আমি দাড় টানি ভুলে;
সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।/ রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

ছন্দ কবিতার মহামিলনের ‘বাংলাদেশ’ কবিতায় কবি নজরুল লিখেছেন-
‘নমঃ নমঃ নমঃ বাঙলা দেশ মম/ চির-মনোরম চির-মধুর।/ বুকে নিরবধি বহে শত নদী/ চরণে জলধির বাজে নূপুর।’

একুশের কবিতায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কবি আল মাহমুদ লেখেন-
‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/ দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?/ বরকতের রক্ত।
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/  আমায় নেবে সঙ্গে,/ বাংলা আমার বচন,/  আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।’
আবার গদ্য ধারায় লেখা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায় শামসুর রাহমান লেখেন–
‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার ?/ উনিশ শো’ বাহন্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/ বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে/ কতো নোংরা হাতের হিংশ্রতা ধেয়ে আসে।/ এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,/
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস !/ তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,/ বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’

বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রধান বাহন ছোটগল্পের প্রকৃতি সম্পর্কে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) তাঁর ‘বর্ষাযাপন’ কবিতায় লিখেছেন-
‘ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা/ ছোটো ছোটো দুঃখ কথা/ নিতান্তই সহজ সরল,/ সহস্র বিস্মৃতিরাশি  প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/ তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা/  ঘটনার ঘনঘটা,/ নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।/ অন্তরে অতৃপ্তি রবে/ সাঙ্গ করি মনে হবে/ শেষ  হয়ে হইল না শেষ।’

ছোটগল্পের কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো: এর ক্ষুদ্রায়তনের মধ্যে বৃহতের ইঙ্গিত থাকবে, এর আরম্ভ ও উপসংহার হবে নাটকীয়, এর বিষয়বস্তু সাধারণত স্থান, কাল ও ঘটনার ঐক্য মেনে চলবে, এতে মানবজীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত, ভাব বা চরিত্রের একটি বিশেষ দিক উজ্জ্বল  হয়ে উঠবে, যেকোনো ধরনের বাহুল্য বর্জনের মাধ্যমে গল্পটি হয়ে উঠবে রসঘন, এতে থাকবে রূপক বা প্রতীকের মাধ্যমে অব্যক্ত কোনো বিষয়ের ইঙ্গিত ইত্যাদি। সর্বোপরি গল্পসমাপ্তির পরেও পাঠকের মনের মধ্যে এর গুঞ্জরণ চলতে থাকবে। তাহলেই তা সার্থক ছোটগল্পে পরিণত হবে।

সাহিত্যের বর্তমান মধ্যমনি প্রবন্ধ-নিবন্ধ। প্রবন্ধের চেয়ে নিবন্ধ সুনির্দিষ্ট, গভীর, বিশ্লেষণধর্মী । বস্তুত, কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশ্লেষণ ধর্মী লেখাই নিবন্ধ। এর সঙ্গে অধিকতর বর্ণনা যোগ হলে তা হয়ে যায় প্রবন্ধ। সব নিবন্ধ প্রবন্ধ নয়, তবে সব প্রবন্ধই নিবন্ধ। ড. মোহাম্মদ আমীন বলেন-
প্রবন্ধ আর নিবন্ধ শব্দদ্বয় আজকাল অনেকটা অভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হলেও এদের বুৎপত্তি ও প্রায়োগিক পার্থক্য রয়েছে। প্রকৃষ্ট বন্ধন যার সেটি প্রবন্ধ। এখানে সংশ্লিষ্টতা পরম্পরায় প্রবন্ধের বিস্তৃতি ও গভীরতা অসীম । ‘নির্দিষ্ট বন্ধন যার’ সেটি নিবন্ধ। যে বাক্যসমূহের বন্ধনে বা রচনায় উদ্দীষ্ট বিষয় প্রকৃষ্টরূপে প্রকাশ পায় তাই প্রবন্ধ আর যে বাক্যসমূহের বন্ধনে বা রচনায় উদ্দীষ্ট বিষয়ের প্রকাশে ‘বিনিগ্রহ’ অর্থাৎ ‘নিরোধ’ বা ‘নিয়মন’ বা ‘নিয়ন্ত্রণ’ থাকে তাকে ‘নিবন্ধ’ বলে । ‘প্র’ এবং ‘নি’ উপসর্গের অর্থভেদের কারণেই ‘প্রবন্ধ’ আর ‘নিবন্ধ’-কে সমার্থক হতে দেয় নি। সরকারী দপ্তরে বা ফরমায়েসি লেখায় নিবন্ধ রচিত হয় আর স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীন চিন্তার প্রতিফলন ঘটে প্রবন্ধে ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *