Type to search

নড়াইলে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে সচিবের নির্বাচনী প্রচার! এলাকায় সমালোচনার ঝড়

নড়াইল

নড়াইলে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে সচিবের নির্বাচনী প্রচার! এলাকায় সমালোচনার ঝড়

নড়াইল প্রতিনিধি
সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রণীত আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে ভোটের মাঠে
নেমেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব খাজা মিয়া। আগামী
নির্বাচনে নিজ এলাকা নড়াইল-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দিয়ে
শুরু করেছেন নির্বাচনী প্রচার। অথচ তার চাকরির মেয়াদ আছে আরও এক বছর।
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তার অবসর গ্রহণের পর
৩ বছর পার হওয়ার আগে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫(১) ধারায় (রাজনীতি ও
নির্বাচনে অংশগ্রহণ) বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা
রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে
পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ
করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।’
অন্যদিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২-এর ১২ (১) (চ) ধারায় বলা
হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বা প্রতিরক্ষা
কর্ম বিভাগের কোনো চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছেন বা অবসর গমন করেছেন এবং
উক্ত পদত্যাগ বা অবসর গমনের পর তিন বছর অতিবাহিত না হয়ে থাকে। অর্থাৎ
অবসর বা পদত্যাগের পর তিন বছর শেষ না হলে কোনো সরকারি চাকরিজীবী
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।’ অবশ্য এ বিধান বাতিল চেয়ে
হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়েছে। বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক
মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে দায়িত্বরত খাজা মিয়ার সরকারি চাকরির মেয়াদ শেষ হবে
২০২৪ সালের ৪ জুলাই। অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে
আগামী বছরের জানুয়ারিতে। তবে সরকারি চাকরি ছাড়ার তিন বছর পর নির্বাচন
করার বিধান হাইকোর্টে বাতিল হলেই স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়ে আওয়ামী লীগের
প্রার্থী হতে চান খাজা মিয়া। সেই লক্ষ্যেই নির্বাচনী এলাকায় উঠান বৈঠক,
পথসভা ও জনসংযোগ করে বেড়াচ্ছেন তিনি, যা সরকারি চাকরিবিধির সুস্পষ্ট
লঙ্ঘন।
জানা গেছে, সচিব খাজা মিয়ার বাড়ি কালিয়া উপজেলার ফুলদাহ গ্রামে। অনেকদিন
ধরেই ওই এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তিনি। সর্বশেষ ঈদুল
আজহার ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যান তিনি। ঈদের আগে ও পরে এলাকায় বেশ কয়েকটি
পথসভা ও উঠান বৈঠক করেছেন এই আমলা। এর আগেও তিনি নড়াইল সদরের একাংশ,
কালিয়া ও নড়াগাতিতে সভা-সমাবেশ করেছেন। এসব সভায় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী
লীগের মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
জানা গেছে, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নড়াইল-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য
কবিররুল হক মুক্তির কঠোর সমালোচনা করেন সচিব খাজা মিয়া। সংসদ সদস্যের
বিরুদ্ধে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ এনে
প্রকাশ্য সভায় বক্তব্য দিয়েছেন এই সরকারি কর্মকর্তা, যা ইতোমধ্যে সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি চাকরিতে বহাল থেকে তার এমন বক্তব্য
নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে সমালোচনা হচ্ছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা
মিয়া। তিনি বলেন, ‘এলাকায় আমি যেসব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি— সেগুলো
নির্বাচনী প্রচারণা ছিল না। কালিয়াসহ নড়াইলের বিভিন্ন এলাকার জনগণের
সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। এলাকার সার্বিক উন্নয়নসহ অন্যান্য
বিষয়ে তাদের সঙ্গে মতবিনিময়। এলাকার মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্যার
কথা শোনা ও সমাধানের চেষ্টা করেছি।
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি চাকরিরত অবস্থায় নির্বাচনী প্রচার চালানো যায় না।
এলাকার উন্নয়ন ও আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে প্রত্যেক সচিবকে একটি জেলার দায়িত্ব
দেওয়া হয়েছে। আমাকে নড়াইলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে আমি এলাকার
সবার সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। অবসরে গেলে আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করব।
তখন মনোনয়নের বিষয় আসবে।’
তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে খাজা মিয়াকে
স্পষ্টভাবে নির্বাচনে মনোনয়নসহ নির্বাচন নিয়ে বক্তৃতা দিতে দেখা গেছে।
ভিডিওটি গত ৩০ জুন অনুষ্ঠিত একটি পথসভার। সেখানে সচিব খাজা মিয়া বলেন,
‘নড়াইল-১ আসনে আমি কিন্তু উন্নয়নের জোয়ার দেখি না। আমি গত দুদিন যেসব
অঞ্চলে গিয়েছি, অধিকাংশ জায়গায় রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। চলাফেরা করার
মতো কোনো ব্যবস্থা নেই রাস্তার। বাজারগুলোতে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, এখানে
উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে, আমার কাছে তা মনে হয়নি। এরকম একটা পরিবেশে এই ১৫
বছর ধরে আমাদের এই নড়াইল-১ (কালিয়া) আসনে সংসদ সদস্য ক্ষমতায় রয়েছেন। আশা
করেছিলাম তিনি একলাস উদ্দিন সাহেবের পুত্র, তিনি এলাকার উন্নয়নের জন্য
কাজ করবেন। হয়তো করছেন, হয়তো পারছেন না—সেটা আমার বিষয় নয়। আমার বিষয়
হচ্ছে এই যে, আমি এখন পর্যন্ত উন্নয়নের ছোঁয়া দেখতে পাচ্ছি না। বরং আমি
উল্টো কিছু শুনেছি।
এরপর খাজা মিয়া স্থানীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেন,
‘প্রতিটি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা থেকে অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে কতিপয়
ব্যক্তি, তার নেতৃত্বে কি না সেটা আমি বলব না, বিপুল অর্থের মালিক হয়েছে।
নড়াইল-১ আসনের ২০টি ইউনিয়নের প্রতিটি স্কুলে, প্রতিটি বিদ্যালয়ে অযোগ্য
লোকদের নিয়োগ করে, স্থানীয় লোক বাদ দিয়ে নিজের পছন্দমতো ম্যানেজিং কমিটির
সভাপতি গঠন করে তাদের মাধ্যমে এই অবৈধ অর্থের ্র মালিক হয়ে আজকে অনেকে
খুলনা ও ঢাকায় বাড়ি করেছেন। এই নড়াইলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন না করে
তিনি (এমপি) নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন।’
নড়াইল-১ আসনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমি
ব্যক্তিগতভাবে একটা কথা বলতে চাই, প্রিয় এলাকাবাসী, আপনাদের মাধ্যমে
নড়াইল-১ আসনের সব জনগণের কাছে একটা কথা পৌঁছে দিতে চাই। আমি আমার
চাকরিজীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। আমি শেষপ্রান্তে পৌঁছে
প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, আমার মাত্র আর কয়েক মাস চাকরি আছে। আমি আর চাকরি
করব না। আপনি আমাকে নমিনেশন (মনোনয়ন) দেন। আমি কালিয়ায় ফিরে যেতে চাই। এই
কালিয়ায় আমার জন্ম, আমি এখানেই বেড়ে উঠেছি, এখানেই আমি গড়ে উঠেছি। এখানে
আমি ছাত্র রাজনীতি করেছি। উনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, তোমাদের একটি
মামলা আছে, তোমাদের একটি আইনি বার (বাধা) আছে, তিন বছরের আগে নির্বাচন
করতে পারবে না। আমি বলেছিলাম, নেত্রী, আমরা ওই তিন বছরের আইনি বার তুলে
দিতে হাইকোর্টে মামলা করেছি। মামলার রায় হয়তো আমাদের পক্ষে আসবে। আমরা
আশা করছি। ইতোমধ্যে আমরা সব প্রকার যোগাযোগ স্থাপন করেছি। ইনশাআল্লাহ,
আমরা রায় পাব। রায় পেলে আমি নেত্রীর কাছে গিয়ে বলব যে, আমি এলাকার
মানুষের কাছে ফিরে যেতে চাই। যদি আমাকে নমিনেশন দেন তাহলে মানুষের কাজে
নিজেকে আত্মনিয়োগ করে যেতে চাই।’
স্থানীয় সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তিকে উদ্দেশ্য করে সচিব খাজা মিয়া আরও
বলেন, ‘আমাকে দুর্বল ভাববেন না, আমার একজন লোকের গায়ে হাত দিলে আপনার ১০
জনের হাত ভেঙে দেওয়া হবে।’
সচিবের এ ধরনের কর্মকান্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তি
বলেন,‘প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী কী করে প্রকাশ্যে সরকারের বিরুদ্ধে,
সরকারের এমপির বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে পারেন? চাকরিবিধি পরিপন্থি বক্তব্য
দিয়েছেন তিনি।’
সংসদ সদস্য জানান, ‘খাজা মিয়া নিজের প্রভাব খাটিয়ে জেলা প্রশাসন ও
পুলিশকে কাজে লাগিয়ে তার নিজ গ্রামের প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালিয়ে
বাড়িঘর ভাঙচুর করেছেন। এসব ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে।’
সচিবের এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ
সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ দেবেন বলেও কবিররুল হক মুক্তি জানান।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়ার এসব তৎপরতা সম্পর্কে অবগত
করা হলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘শুধু সচিব নন,
কোনো সরকারি কর্মচারীই এভাবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেন না। যারা এ
জাতীয় কর্মকান্ডে যুক্ত হবেন, তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন
চৌধুরী বলেন, ‘তিনি নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন কিনা আমার জানা নেই।
আমার কাছে এমন কোনো বিষয় আসেনি। তবে সরকারি কর্মচারীদের অবশ্যই আচরণবিধি
মেনে চলা উচিত।