Type to search

চৌগাছার ইউএনওর হুইল চেয়ার পেয়ে কাঁদলেন পত্রিকা হকার শফি

চৌগাছা

চৌগাছার ইউএনওর হুইল চেয়ার পেয়ে কাঁদলেন পত্রিকা হকার শফি

আজিজুর রহমান, চৌগাছা:
দীর্ঘ দিন যাবৎ যশোরের চৌগাছা শহরে ঘুরে ঘুরে পত্রিকার হকারি করতেন শফিকুল ইসলাম (৬৫)। চৌগাছার সবাই তাকে শফিভাই বলেই জানেন। উপজেলার সিংহঝুলি ইউনিয়নের হুদা ফতেপুর গ্রামের পৈত্রিক জমিতে একটি ঝুপড়ি ঘরে তার বসবাস। সংসারে স্ত্রী, সম্মান প্রথম বর্ষে পড়া একমাত্র ছেলে ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া মেয়েকে নিয়ে ছিল তার সংসার। ছিলো বলতে হচ্ছে এজন্য স্ত্রী গত হয়েছেন গত বছর ১৫ আগস্ট।
করোনা তাঁকে স্তব্ধ করে দেয়। ২০২০ সালের শেষ দিকে করোনা হয়েছে কিনা বুঝতে না পারলেও ব্রেণ স্ট্রোক করেন শফি। সহায় সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসা করে পরিবার। বিছানাধারী হয়ে পড়েন শফি। সারাদিন শুয়ে থাকেন মাটি-চাটাই-টিনের ঝুপড়ি ঘরের বারান্দার একটি চৌকিতে। বাম হাত একেবারেই অকেজো। কোনভাবেই নিজে চলাচল করতে পারেন না তিনি। কলেজে এইচএসসি পড়া ছেলেকে নামতে হয় দিন মজুরীতে। পত্রিকা বিক্রিও করোনায় একেবারেই কমে গেলে মজুরী ছাড়া আর উপায়ও ছিলোনা এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেটির। ছেলের মজুরীতে স্ত্রীর সেবায় শফির চিকিৎসা চলছিলো কোনভাবে। তবে সেই স্ত্রীও শফিকে ছেড়ে যান ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট। একেবারেই অসহায় অবস্থা। সদ্য এইচএসসি পাশ ছেলে আর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া মেয়ে বাবাকে নিয়ে কি করবে? তবুও দমে না যেয়ে ছেলে মজুরী করতে থাকে পরের খেতে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া ছোট বোনকে বাড়িতে রেখে ছেলেটি যায় পরের খেতে মজুরী দিতে। দিন শেষে সন্ধ্যায় এসে বাবাকে প্রশ্রাব-মলত্যাগ করিয়ে খাইয়ে আবারো শুইয়ে দেন। রাতে বাবার বাথরুম করার ছেলে নিজেই। ছোটবোনটিকেও আগলে রাখেন। তবে ঘরে কিছু খাবার থাকলেও দিনে বাবাকে খাওয়াতে পারেন না, খাওয়ার পর বাথরুমে নেবে কে এই ভয়ে। শফির ছোট্ট মেয়েটি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়, মাঝে মধ্যে নিজে রান্না করে খায়। আর বারান্দায় শুয়ে থাকা বাবাকে চোকি দেয়।
শফির খুব ইচ্ছা একটি হুইল চেয়ার হলে অন্তত বসে থাকতে পারতো দিনে কিছু সময়। বা শেষ জীবনে একটু ঘুরে বেড়াতে পারতেন।
বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ পান চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা। চৌগাছা সমিতি-ঢাকা গত ঈদ উল ফিতরের পরদিন উপজেলা শতাধিক ব্যক্তিকে হুইল চেয়ার প্রদান করে। তার মধ্যে একটি চেয়ার ছিলো ইউএনওর কাছে। তিনি রোববার বিকেলে সেটি নিয়ে পৌছেন শফির বাড়িতে। হুইল চেয়ার খুলে বের করতেই শফি আনন্দে কেঁদে ফেলেন। কানে না শোনা শফি জোরে জোরে বলতে থাকেন এটা আমার জন্য! ইচ্ছা প্রকাশ করেন সেটিতে ওঠার জন্য। ইউএনওর নির্দেশে তার আনছার আর গাড়ী চালক সেলিম ও স্থানীয় এক ব্যক্তির সহায়তায় হুইল চেয়ারে ওঠানো হয়। শফি বিশ^াসই করতে পারছিলেন না এটি তার জন্য। কানের গোড়ায় যেয়ে জোরে ইউএনও এসেছেন এটি নিয়ে বলতেই শুনে হাত উপরে তুলে এটেনশনের মতো করে সালাম দেন ইউএনওকে। শুরু হয়ে যায় শফির জোরে জোরে কান্না। আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেন ইউএনওর জন্য। ইচ্ছা পোষণ করেন তাকে একটু উঠানে নামানোর জন্য। আনছার ও গাড়ি চালক সেলিমের সহায়তায় নামানো হয় উঠানে। দেখিয়ে দেয়া হয় নিজেই চালাতে পারবেন হুইল চেয়ার। শফি আবেগে জোরে জোরে কেঁদে ফেলেন। বলতে থাকেন আমি নিজেই ঘুরতে পারবো, নিজেই চালাতে পারবো। মেয়ে পিছনে ধরে রাখবে। আবেগে কেঁদে কেঁদে ইউএনওকে জানান আমার এই মেয়ে গালে তুলে খাওয়ায়। ওর মা মারা গেছে গত বছর আগস্টের ১৫ তারিখে। উপরে আল্লাহ আছেন, তিনি আপনার ভালো করুন। দীর্ঘজীবি করুন।
সর্বশেষ যখন ইউএনও বিদায় নিতে চান শফিকে আবারো তুলে দেয়া হয় তার শোবার বারান্দায়। তখন শফি বলতে থাকেন এটা পত্রিকায় ছাপা হবে না? পত্রিকায় ছাপা হবে না? বলা হয় অসুবিধা নেই। ছাপা হবে। শফির আবদার আমাকে একটা পত্রিকা পাঠিয়ে দিতে হবে। ইউএনও আশ^াস দেন পত্রিকা পাঠিয়ে দেয়া হবে। আরও আশ^াস দেন ছেলে আসলে তার অফিসে যেয়ে দেখা করার জন্য।