Type to search

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি : হতদরিদ্ররা হঠাৎ স্বচ্ছল!

অভয়নগর

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি : হতদরিদ্ররা হঠাৎ স্বচ্ছল!

স্টাফ রির্পোটার :   হারুণ শেখ দিনমজুর। মা, স্ত্রী এবং দুই মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। জমিজিরাত বলতে ২৮ শতক। হতদরিদ্র হিসাবে ২০১৬ সালে তিনি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে প্রকৃত হতদরিদ্রদের ভোক্তা তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত হয়েছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদের(ইউপি) সদস্য তাঁকে হতদরিদ্র হিসাবে শনাক্ত করেছিলেন। হারুণ শেখ এখন স্বচ্ছল! তিন বছরের মাথায় এসে সেই ইউপি সদস্য তাঁকে স্বচ্ছল হিসাবে শনাক্ত করেছেন। তাঁর পরিবর্তে ভোক্তা তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত হয়েছেন একই গ্রামের পরিমল দাস। তিনি পানের ব্যবসা করেন।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভাটপাড়া গ্রামের এই দিনমজুর বলেন, ‘১০ টাকা কেজি দরের চালের কার্ড বাতিল হওয়ার খবর শুনে মেম্বর ওসমান শেখের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, তিনবছর ধরে চাল পাচ্ছিস। আর কতো? সামনে নির্বাচন। আমি নির্বাচন করবো। সেই অনুয়ায়ী আমি কার্ড পাল্টায়ে দিয়েছি।’’
হারুণ শেখের মতো যশোরের অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নে ২৬০ জন হতদরিদ্ররা হঠাৎ স্বচ্ছল বনে গেছেন।
বাঘুটিয়া ইউনিয়নের ওই সময়ের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শেখ গোলাম বলেন,‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির তালিকায় প্রায় সবাই হতদরিদ্র। কিন্তু ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি নাম পরিবর্তন করা হয়েছে ৪ নস্বর ও ৫ নস্বর ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডের সদস্যরা কীভাবে নাম পরিবর্তন করেছেন তা আমি জানি না। এটা তাঁদের ব্যাপার। তবে আমার ওয়ার্ডে কার্ড ডাবল হয়ে যাওয়াতে মাত্র ১১ জনের নাম পরিবর্তন করেছি।
পল্লী অঞ্চলের দরিদ্র জনসাধারণকে স্বল্পমূল্যে খাদ্য সহায়তা প্রদান ও পুষ্টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি বিতরণ ব্যবস্থায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য ২০১৬ সালে ‘ইউনিয়ন পর্যায়ে হতদরিদ্রদের জন্য সরকার নির্ধারিত মূল্যের কার্ডের মাধ্যমে খাদ্যশস্য বিতরণ নীতিমালা, ২০১৬’ প্রণয়ন করা হয়। ২০১৭ সালে নীতিমালা পরিবর্তন করে ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি নীতিমালা, ২০১৭’ প্রণয়ন করা হয়। নীতিমালা অনুসারে, ইউনিয়ন পর্যায়ে বসবাসরত নিম্নআয়ের দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে থেকে হতদরিদ্র পরিবার সম্পর্কিত পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপজেলা দপ্তরে সংরক্ষিত ডিপি(ড্রিস্টেস প্রাইওরিটি) লিস্ট ইত্যাদি বিবেচনা করে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সংখ্যক পরিবারকে নির্বাচন করে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে অন্তুর্ভুক্ত করতে হবে। গ্রামে বসবাসরত সবচেয়ে হতদরিদ্র পরিবার; ভুমিহীন, কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, উপার্জনে অক্ষম, বিধবা/তালাকপ্রাপ্তা/ স্বামী পরিত্যক্তা/অস্বচ্ছল বয়ষ্ক নারী প্রধান পরিবার এবং যেসব দুঃস্থ পরিবারে শিশু বা প্রতিবন্ধী রয়েছে তারা অগ্রাধিকার পাবে। একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি এবং ভিজিডি কর্মসূচির সুবিধাপ্রাপ্তদেরকে তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করা যাবে না।
অভয়নগর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর সূত্র জানায়, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে প্রকৃত হতদরিদ্রদের ভোক্তা তালিকায় অন্তুর্ভুক্তি ও অভিযোগ নিরসনের জন্য খাদ্য অধিদপ্তর গত ১৮ নভেম্বর একটি চিঠি দেয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালে সাত মাসব্যাপী খাদ্যবন্ধব কর্মসূচিতে চাল বিতরণ অব্যাহত থাকবে। কিন্তু খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ভোক্তা তালিকায় অস্বচ্ছল ও হতদরিদ্রের পরিবর্তে আথিকভাবে স্বচ্ছল ও ক্ষমতাবান এবং ভুয়া ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে মর্মে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এ ছাড়া, পূর্বে তালিকাভুক্ত অনেক উপকারভোগী মৃত্যুবরণ করলেও মূল তালিকা সংশোধন করা হয়নি। এমতাবস্থায়, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে উপকারভোগীর তালিকা হতে মৃত, স্বচ্ছল ও ভুঁয়া ব্যক্তিদের পরিবর্তে প্রকৃত হতদরিদ্রদেরকে অন্তুর্ভুক্ত করতে নির্দেশনা প্রদান করা হলো। ভবিষ্যতে এ কার্যক্রমে কোনো ভুল বা গাফিলতি পরিলক্ষিত হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু খাদ্য অধিদপ্তরের সে নির্দেশনা মানেননি বাঘুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা।
সূত্র জানায়, উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে উপকারভোগীর সংখ্যা ২ হাজার ২২৮ জন। এরমধ্যে ২৬০ জনকে বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে ২৬০ জনকে অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাদ পড়া ২২৪ জনকে স্বচ্ছল দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া, অবশিষ্ট ৩৬ জনের মধ্যে ১৮ জন ভিজিডি প্রাপ্ত, আটজনের মৃত্যু, সাতজনের এলাকা ত্যাগ, একজনের বিদেশ গমন, একজনের পরিবারে দুটি ভাতার কার্ড এবং একজনের মায়ের নামে ভাতার কার্ড রয়েছে বলে বাদ পড়ার কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, ভাটপাড়া গ্রামের দিনমজুর আনিসুর রহমানের নাম বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে সচ্ছল প্রসাদ কৃষ্ণ দাসকে তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে। একই গ্রামের পুঁটিরাম বিশ্বাসের পরিবারে চারজন সদস্যের নাম তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে। হতদরিদ্র রিপন বিশ্বাস, বিকাশ বিশ্বাস, শিমূল বিশ্বাস ও জাহানারা বেগমের নাম বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে পুঁটিরাম বিশ্বাসের ছেলে নিতাই বিশ্বাস, স্ত্রী ঋতা বিশ্বাস, মেয়ে পার্বতী বিশ্বাস এবং ছেলে তপন বিশ্বাসের নাম অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিবনগর গ্রামের হতদরিদ্র স্বপন কুমার তিন বছর আগে ভারতে চলে গেছেন। এই তিন বছর তাঁর নামে চাল তোলা হয়েছে। তাঁর পরিবর্তে অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে গ্রামের স্বচ্ছল অসিত বিশ্বাসকে।
পাইকপাড়া গ্রামের ইউপি সদস্য আব্বাস বিশ্বাসের ভাইয়ের ছেলে বি এম জিয়াউর রহমান, চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী রেভা বেগম এবং ভাগ্নে হাবিব খানকে তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাঁরা সচ্ছল। তাঁদের পরিবর্তে হতদরিদ্র রবিউল ইসলাম, মুসারেফ এবং মুকুল অধিকারীকে সচ্ছল দেখিয়ে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গ্রামের হতদরিদ্র সাইদ গাজীকে বাদ দিয়ে সচ্ছল নিতাই মণ্ডল এবং হতদরিদ্র সাইফুল ইসলামকে বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য জাহিদুর রহমানের নাম অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে। মায়ের নামে ভাতার কার্ড থাকায় তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে পোতপাড়া গ্রামের মুজিবর রহমানের নাম। তাঁর পরিবর্তে তালিকায় অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে রেকসনা বেগমের নাম।
৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ওসমান শেখ বলেন,‘যাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে তাঁরা সবাই স্বচ্ছল লোক। তাঁদের বাদ দিয়ে অস্বচ্ছল লোকদের তালিকাভূক্ত করা হয়েছে।’
৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্বাস বিশ্বাস বলেন,‘তালিকায় যাঁদের বাদ দেওয়া তাঁরা আমার জানামতে স্বচ্ছল আর যাঁদের অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে তাঁরা অস্বচ্ছল। আর এ ব্যাপারে কৈফিয়ত আমি আপনাকে দেবো না। আপনি এটা জানতে চাইতে পারেন না। এটা কেবল ইউএনও সাহেব এবং খাদ্য কর্মকর্তা জানতে চাইতে পারেন।’
উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মীনা খানম বলেন,‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে উপকারভোগীদের নাম সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন করা হয়েছে বাঘুটিয়া ইউনিয়নে। ট্যাগ অফিসারকে দিয়ে আমরা যাচাই বাছাই করিয়েছিলাম। তাতে কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়নি। অভিযোগ যখন উঠেছে তখন তদন্ত করে দেখা যেতে পারে।’

উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুসেইন খাঁন বলেন,‘বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।’