Type to search

এ শহর কতটা নারীর

অন্যান্য

এ শহর কতটা নারীর

গণপরিবহনে চলাচল করেন এমন নারীদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার হন

বিশ্বব্যাংকের ‘জেন্ডার-ইনক্লুসিভ আরবান প্ল্যানিং অ্যান্ড ডিজাইন হ্যান্ডবুক’ একটি শহরের ছয়টি মূল বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে—সুযোগ-সুবিধার প্রাপ্যতা, চলাচলের পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা, সহিংসতা থেকে রক্ষা, জলবায়ু সহনশীলতা এবং বাসিন্দাদের নিরাপত্তা।

যে নারীরা অফিসের কাছেই থাকেন কিংবা যে মা বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন কিংবা বাজার করতে বের হন, তাঁরাও নানা দৈনন্দিন সমস্যার কথা বলেছেন। চলাচলের যোগ্য ফুটপাত কিংবা খোলা জায়গার অভাবের কথাও উঠে এল তাঁদের বক্তব্যে।

সারাহ দীনা পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন। প্রায়ই ঢাকার নীলক্ষেতের রাস্তায় চলাচলের অভিজ্ঞতা থেকে বলছিলেন, হকাররা এমনভাবে ফুটপাত দখল করে রাখেন যে এটুকু পথ তাঁর কাছে দুঃস্বপ্নের মতো লাগে। দীনা বলেন, হোক নীলক্ষেত বা কারওয়ান বাজার, এসব এলাকায় যেহেতু এমনিতেই ভিড় লেগে থাকে, ফুটপাতও দখল হয়ে গেলে সেটা যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষের জন্যই সমস্যার কারণ।

যে মায়েরা বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় চলাচল করেন, তাঁরা মনে করেন, ফুটপাতগুলো যথেষ্ট প্রশস্ত নয়। এমনিতেই জায়গা কম, সেটুকুও চলে যায় হকারদের দখলে।

এই প্রতিবেদনের জন্য তথ্য সংগ্রহের সময় এক মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর মেয়ের ক্লাস শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর কোলে এক বছর বয়সী আরও এক সন্তান। বলছিলেন, ‘ঢাকা শহরে এমন একটা রাস্তা অথবা ফুটপাত দেখান, যেখানে আপনি নিরাপদে আপনার বাচ্চাকে স্ট্রলারে বসিয়ে চলাচল করতে পারবেন।’

প্রতিবাদ করাও যে কখনো কখনো অপরাধ হয়ে যায়, সে কথা উঠে এল বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীর বক্তব্যে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘মাস দুয়েক আগে বাসে চড়ে কলেজে যাওয়ার সময় এক লোক আমার গায়ের ওপর এসে পড়ছিল, গায়ে হাত দিচ্ছিল। যখন প্রতিবাদ করলাম, অন্য যাত্রী আর হেলপার উল্টো আমাকে দোষারোপ করতে লাগল। বলল এতই যদি সমস্যা থাকে, তো প্রাইভেট গাড়িতে চড়েন না কেন?’

২০১৮ সালে ‘নারীর জন্য নিরাপদ সড়ক: বাংলাদেশে যৌন হয়রানি ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধ’ শীর্ষক ব্র্যাকের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে যে নারীরা গণপরিবহনে চলাচল করেন, তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার।

বিশ্বব্যাংকের হ্যান্ডবুক-ও বলছে, ‘২০১৫ সালে হওয়া নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা জরিপ অনুযায়ী, কর্মস্থল এবং স্বামীর বাড়ির পর বাংলাদেশের নারীরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন গণপরিবহনে বা রাস্তায় (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০১৬)। ’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, ‘মূল সমস্যাটা হলো, আমাদের দেশে কোনো পর্যায়ের মানুষই লিঙ্গ সংবেদনশীলতার ব্যাপারে অবগত নয়। পেশাগতভাবে আমরা যখন নগর-পরিকল্পনা বিষয়ে কোনো কর্মশালা করি, দেখি জেন্ডার ইনক্লুসিভিটি নিয়ে কেউ কথা বলে না। আমাদের পরিবার বা সমাজে এ বিষয়ে সচেতনতা নেই। আমাদের পাঠক্রমে এ–সংক্রান্ত কিছু নেই। মেয়েরা ঘরে থাকবে—আমাদের মনের ভেতরে এই ধারণাই এখনো দৃঢ় হয়ে বসে আছে।

‘যদি আপনার গণপরিবহনের সংখ্যা যথেষ্ট হয়, তাহলে তো আর সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন পড়ে না। যদি সড়কবাতিগুলো ঠিকমতো বসানো হয়, তাহলে হয়তো অপরাধের পরিমাণ কমবে। নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত সবার জন্যই পাবলিক প্লেসগুলো নিরাপদ করা।’

লিঙ্গকে বিবেচনায় নিতে হলে নীতি, আইন, এবং সম্পদ বরাদ্দ—সব ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষের সমান ভাগ থাকা উচিত। ১৯৯৫ সালে নারী-পুরুষ সমতা বিষয়ে জাতিসংঘ নির্ধারিত বৈশ্বিক পরিকল্পনায় এমনটাই বলা হয়েছে।

মহিলা পরিষদের প্রেসিডেন্ট ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘জেন্ডারের ধারণা একটা শহরের মূলনীতিতেই থাকা উচিত। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কিছু অগোছালো পরিকল্পনা করেন, যেগুলো আদতে কার্যকর নয়। নারীদের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে পরিবহনব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট, রুট প্ল্যান করা, ডে কেয়ার সেন্টার রাখা তো দূরের কথা।’

ফওজিয়া মোসলেম জানালেন, বেশ কয়েকবার তাঁরা শহরের কাউন্সিলরদের সঙ্গে বসেছেন। স্থানীয় সরকার ও পৌরসভা–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও নারী সংবেদনশীল শহর বিষয়ে তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। সিটি নির্বাচনের আগেও তাঁরা বেশ কিছু দাবিদাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। ফওজিয়া মনে করেন, যদি নারী কাউন্সিলরদের যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে তাঁদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে ঢাকাকে নারীবান্ধব করা সম্ভব।

(প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে একাডেমির নারী সাংবাদিক মেন্টরশিপ কর্মসূচির আওতায় তৈরি। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মো. সাইফুল্লাহ)