Type to search

আল্লাহর শ্রেষ্ঠ যিকির সালাত

জাতীয়

আল্লাহর শ্রেষ্ঠ যিকির সালাত

বিলাল হোসেন মাহিনী

আল্লাহর যিকিরে অন্তর প্রাণবন্ত হয়। আর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ যিকির হলো নামাজ। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “জেনে রাখ! আল্লাহর যিকিরেই আত্মা প্রশান্ত হয়।” (সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ২৮) তিনি আরও বলেন, “আমার যিকিরের (স্মরণের) জন্য সালাত প্রতিষ্ঠা কর।” (সূরা ত্বাহা, আয়াত: ১৪) আল্লাহ তায়ালা বলেন,  ‘তোমরা সালাত কায়েম করো আর মুশরিকদের দলভুক্ত হয়ো না। (সূরা রুম: ৩১)। আল্লাহ রব্বুল আলামিন মু’মিনদের সন্বন্ধে বলেছেন, ‘এরা এমন লোক যাদেরকে ব্যবসা ও ক্রয়-বিক্রয় কিছুই আল্লাহর জিকির থেকে গাফিল করতে পারে না।’ (সূরা নূর : ৩৭)।
হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ (রহ:) উপরে বর্ণিত এই মর্ম উদ্ধার করেছেন যে, যার মুখে আল্লাহর জিকির এতোই স্বতঃস্ফূর্ত এবং অন্তরে সালাতের চিন্তা এতই প্রবল যে, চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে জিকির শুরু হয়ে যায়, সে কিছুতেই গাফিল ও অচৈতন্য অবস্থায় ঘুমোতে পারবে না। -(হুজ্জাতুলাহি’ল -বালিগাহ, খ- ১, পৃ:৭৮)।

সালাত গুনাহ ও মন্দ কাজের কাফ্ফারা : নবী (সা.) বলেছেন: “যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি সালাতের ওয়াক্ত পেলো আর সালাতের জন্য উত্তমরূপে অযু করল যথাযথ খুশু-খুযু নিয়ে সালাত আদায় করল, ঠিকমত রুকু করলো। এ সালাত তার বিগত গুনাহের কাফ্ফারা হবে যতক্ষণ পর্যন্ত সে কবীরা গুনাহে লিপ্ত না হবে। আর এই ফজীলত সব সময়ের জন্য।” (সহীহ মুসলিম) সালাত সর্বোত্তম আমলের অন্তর্ভুক্ত: আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন : সর্বোত্তম আমল কোনটি? তিনি বলেন, “সময়মত সালাত আদায় করা”। (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)  সালাত আল্লাহর শ্রেষ্ঠ যিকির। “যে আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, অবশ্য তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব।” (সুরা ত্বাহা, আয়াত: ১২৪) “তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪৫)

এ জন্য রাসূল (সা) যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় পতিত হতেন তখনই ভয় ও ভীতির সঙ্গে দ্রুত সালাত পড়তে যেতেন। হুযাইফা (রা.) বলেন, “যখন নবী (সা.) কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের সম্মুখীন হতেন তখন সালাত আদায় করতেন।” (মুসনাদে আহমদ) হযরত সাবেত (রহ.) বলেন, “নবীগণ যখন কোনো বড় কাজের সম্মুখীন হতেন সালাতের দিকে অগ্রসর হতেন।” (তাফসীর ইবন কাসীর) “অবশ্যই মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়-ন¤্র।” (সূরা আল-মুমিন, আয়াত: ১-২)  যে ব্যক্তি সকালের (ফজরের) সালাত আদায় করল সে আল্লাহর জিম্মায় (নিরাপত্তায়), কেউ যেন আল্লাহর এ জিম্মাদারী নষ্ট না করে। যে কেউ তাকে হত্যা করবে, আল্লাহ তাকে পাকড়াও করবেন এবং তাকে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে অধোমুখে নিক্ষেপ করবেন।” (সহীহ মুসলিম)

নামাজে গাফেল ব্যক্তিদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “সুতরাং দুর্ভোগ (‘ওয়াইল’ জাহান্নামের একটি স্থান) সেই সালাত আদায়কারীদের যারা তাদের সালাত সম্পর্কে উদাসীন।” (সূরা আল-মাউন, আয়াত: ৪-৫) তাফসীরকারকগণ এই আয়াতের তাফসীর করেন যে, এই আয়াত দ্বারা ঐ সমস্ত লোক বুঝায়, যারা সালাতকে তার সময় থেকে পিছিয়ে অসময়ে আদায় করে। সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী (সা.) কে উক্ত আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেন “এরা ঐ সমস্ত মানুষ যারা সালাতকে তার (প্রকৃত) সময়ে আদায় না করে পরে আদায় করে”। (তাফসীর ইবন কাসীর)

নবী করীম (সা.) সালাত আদায়ের পদ্ধতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘তোমরা সেভাবে সালাত পড় যেভাবে আমাকে সালাত পড়তে দেখ।’ (সহীহ বুখারি) অন্যান্য সালাত অপেক্ষা ফজর সালাতের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বেশি। নবী (সা.) বলেন, “এশা ও ফজর সালাতে কী ফযীলত রয়েছে মানুষ যদি তা জানত তবে উক্ত সালাতে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও উপস্থিত হত।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)

নবী করীম (সা.) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি এশার সালাত জামা‘আতে আদায় করল, সে যেন রাত্রির অর্ধাংশ ইবাদতে লিপ্ত থাকল এবং যে ফজর সালাত জামা‘আতে আদায় করল সে যেন পূর্ণ রাত্রি সালাত আদায় করল।” (সহীহ মুসলিম) এবং তিনি (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি ফজরের সালাত আদায় করল সে আল্লাহর জিম্মার অন্তর্ভুক্ত হল।” (সহীহ মুসলিম)
আল্লাহর রাসুল (সা.) আরো বলেন, “ফজরের (সুন্নাত) দু’রাকাত সালাত দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু রয়েছে তা অপেক্ষা উত্তম।” (সহীহ মুসলিম) “আর সাজদাহ কর ও (আমার) নিকটবর্তী হও।” (সূরা আল-‘আলাক, আয়াত: ১৯) অর্থাৎ আল্লাহর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং সমস্ত সৎ কাজের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভ কর, আর সৎ কাজের মধ্যে আল্লাহর জন্য সাজদাহ হচ্ছে সবচেয়ে বড়। নবী করীম (সা.) বলেছেন : “বান্দা স্বীয় রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় সাজদাহ অবস্থায়। অতএব, তোমরা সাজদায় বেশি-বেশি দো‘আ কর।” (সহীহ মুসলিম ও নাসাঈ)
“আমাদের ও তাদের (কাফিরদের) মধ্যে যে পার্থক্য তা হলো সালাত। অতএব, যে সালাত ছেড়ে দিল সে কুফুরী করল।” (আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ) প্রখ্যাত তাবেঈ শাকীক ইবন আব্দুল্লাহ আল-উকাইলী বলেন, “সাহাবায়ে কিরাম সালাত ব্যতীত অন্য কোনো আমল ছেড়ে দেওয়াকে কুফুরী মনে করতেন না।” (সুনান তিরমিযী)
উমার (রা.) বলেন, “যে ব্যক্তি সালাত ছেড়ে দিল ইসলামে তার কোনো অংশ নেই।” ‘যে ব্যক্তি সালাতের হেফাজত করলো, সালাত তার জন্য কিয়ামতের দিন জ্যোতি, প্রমাণ ও নাজাতের উসীলা হবে, আর যে সালাতের হিফাযত করলো না, তার জন্য সালাত কিয়ামতের দিন জ্যোতি, প্রমাণ ও নাজাতের উসীলা হবে না এবং কারূন, ফিরাউন, হামান এবং উবাই ইবন খালফের সাথে তার হাশর হবে।” (মুসনাদে ইমাম আহমদ)

সালাত আদায়ে উদাসীনতা কাম্য নয় :

সালাত আদায়ে দায়সারা ভাব দেখানো মোটেই উচিত নয়। আল্লাহ তায়ালার প্রতি ধ্যান রেখে পরিপূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে নামাজ আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘সেই সব মুমিন সফলকাম, যারা তাদের নামাজে বিনয়াবনত থাকে।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত :১-২) সঠিক ভাবে নামাজ আদায় ও মনোযোগ ধরে রাখার ব্যাপারে এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.)-এর কাছে জনৈক ব্যক্তি সংক্ষিপ্ত উপদেশ কামনা করলে তিনি তাকে বলেন, ‘যখন তুমি নামাজে দ-ায়মান হবে, তখন এমনভাবে নামাজ আদায় করো, যেন এটিই তোমার জীবনের শেষ নামাজ।’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত, হাদিস : ৫২২৬) এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) আরো বলেন, আপনি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবেন, যেন আপনি তাকে দেখছেন, আর যদি আপনি তাকে দেখতে না পান, তবে (বিশ্বাস রাখবেন যে) তিনি অর্থাৎ আল্লাহ আপনাকে দেখছেন।

প্রতিদিন সিজদা দিয়ে বান্দা এটিই প্রমাণ করে যে, সে একমাত্র আল্লাহর কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য করে না। একমাত্র নামাজের মাধ্যমেই মহান রবের কাছাকাছি আসা যায়। একমাত্র নামাজের মাধ্যমেই বান্দা তার প্রভুর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পায়। ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে কোনো দালাল ছাড়াই সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে বান্দা নামাজের মাধ্যমে সাক্ষাৎ করতে পারে এবং নিজের জন্য সাহায্য কামনা করতে পারে। এ প্রসঙ্গে সূরা বাকারার ১৫৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য্য ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো।’
নামাজের মধ্যে অন্যতম একটি সৌন্দর্য হচ্ছে, নামাজের সময় সব ভেদাভেদ ভুলে সবাই একই কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে। সবাই আল্লাহর কর্তৃত্বের কাছে প্রকাশ্যে মাথা নত করে। এটিই নামাজের আসল সৌন্দর্যের প্রতিফলন।