আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইসলাম

বিলাল হোসেন মাহিনী
দুনিয়ার প্রথম মানুষ-ই প্রথম নবী। যিনি আল্লাহর বিধান ও বানী প্রচারের পাশাপশি নিজ হাতে কর্ম করেছেন। পরিবারের আহার যুগিয়েছেন। এভাবে যতো নবী-রাসুল পৃথিবীতে এসেছেন তাদের সবাই আত্মকর্মসংস্থান করেছেন এবং তাঁর সাথীদেরও কর্মের মাধ্যমে জীবনযাপনে উৎসাহ দিয়েছেন। বিশ্বনবী (সা.) নিজের কাজ নিজে করতেন। সাহাবাদেরও কর্মে উৎসাহিত করতেন। তাছাড়া ইসলামে শ্রমজীবী মানুষকে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাই, বর্তমানে ইমাম-খতিব এবং আলেম-উলামাদের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি তথা কর্মমূখী শিক্ষার কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
বর্তমানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও বিনোদন মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে ইসলামী জীবনদর্শনে অভ্যস্ত, সে ইসলাম এ মৌলিক চাহিদার বিষয়ে কী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, তা সবারই জানা উচিৎ বিশেষতঃ আলেম সমাজের। আর বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে যেখানে কর্মসংস্থানকে রাষ্ট্র অন্যতম অগ্রাধিকার খাত বলে ঘোষণা করেছে, সেখানে ইসলামী জীবনদর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি আরও প্রাসঙ্গিক বলেই মনে করা দরকার। কিন্তু, এ বিষয়ে আলেম সমাজ প্রায়ই উদাসীন। ইসলামি দর্শন সর্বদাই জীবনমুখী। মাসআলা ও ফতোয়া ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদিসের সঙ্গে ইজমাওল উম্মাহ ও কিয়াস সংযুক্ত করে সব যুগ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে ইসলামের ব্যাখ্যা যুগোত্তীর্ণ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। আমাদের জনবহুল এই দেশে কর্মসৃষ্টি ও অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর যখন সালাত শেষ হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পার।’ (সূরা জুমআ :১০) এখানে অনগ্রহ অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সম্মানিত মুফাসসির প্রয়োজন মেটানোর জন্য অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হওয়াকে নির্দেশ করেছেন।
হযরত উরওয়া (রা.) হতে বর্ণিত, আয়েশা (রা.) বলেন- ‘রাসুলের (সা.) সাহাবিরা নিজেদের কাজকর্ম নিজেরাই করতেন। ফলে তাদের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বের হতো। সে জন্য তাদের বলা হলো তোমরা গোসল করে নাও।’ (সহিহ বুখারী-২০৭১) কেবল অন্যের কর্মস্থানে চাকরি নয় বরং নিজেকে কাজ সৃষ্টির ব্যাপারে রাসুল (সা.) উৎসাহ জুগিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমাদের কারও পক্ষে এক বোঝা জ্বালানি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নিয়ে আসা কারও কাছে সওয়াল করার চেয়ে উত্তম। কেননা অনেক সময় সওয়াল করলে সে দিতেও পারে আবার নাও পারে।’ (সহিহ বুখারী-২০৭৪) আত্মকর্মসংস্থানের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেন- নিজ হাতের শ্রমে উপার্জিত জীবিকার চেয়ে উত্তম আহার কেউ কখনও করেনি। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। (সহিহ বুখারী-২০৭২)
অতএব, ইসলামে নিজে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা উত্তম। তবে এর চেয়ে অনেক বেশি উত্তম কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, নিজে কাজ করা এবং অপরের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা অর্থাৎ অন্যের কর্মের ব্যবস্থা করা। এসব সফল উদ্যোক্তা যেমন ইসলামের দৃষ্টিতে একজন ভালো মুমিন, অপরদিক থেকে রাষ্ট্রও তাদেরকে আদর্শ নাগরিক বলে স্বীকৃতি দেয়।
ইসলামে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে কোনো শৈথিল্যতার প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। অধিকিন্তু, কর্মকে কখনও নফল ইবাদতের ওপর স্থান দেওয়া হয়েছে। হযরত উমরের (রা.) সময় অনেক নফল রোজাদারকে নফল ইবাদতের চেয়ে নিজস্ব কর্মতৎপরতার ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কেননা হালাল রুজি ছাড়া ইবাদত কবুল হয় না। অন্যদিকে সন্ত্রাসকে ইসলাম অনুৎসাহিত করেছে। বলা হয়েছে, ‘লা রাহবানিয়াতা ফিল ইসলাম’, ইসলামে কোনো সন্ত্রসবাদ নেই। সন্ত্রাসবাদ মানুষকে মূলত কর্ম ও সমাজবিমুখ করে দেয়। ইসলাম তাকওয়ার ওপর গুরুত্ব দেয়। তবে সমাজ ও অর্থনৈতিক সাফল্যের বাইরে গিয়ে নয়। এটাই রাসুলের (সা.) সুন্নাহ। কেননা তিনি সংসার করেছেন, ব্যক্তি ও পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য কখনও কারও অধীন কাজ করেছেন আবার কখনও নিজেই আত্মকর্মসংস্থান করেছেন। সুতরাং সবচেয়ে আদর্শ সুন্নাহ হলো হালাল অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে ব্যক্তি ও পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটানোর মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করা।
দারিদ্রতা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে ইসলাম। হযরত উমর (রা.) বলেন, সুফফায় বসবাসকারী কিছু ব্যক্তি রাসুলের (সা.) কাছে এসে অভাব-অভিযোগের আরজি পেশ করলে নবী (সা.) বলেন, দরিদ্রতা প্রায় কুফরির পর্যায়ে নিয়ে যায় আর হিংসা তাকদিরকে অতিক্রম করে। সুতরাং তোমরা বলো, হে আল্লাহ, হে সাত আসমান ও আরশে আজিমের রব, আমাদের থেকে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করো এবং আমাদের দরিদ্রতা থেকে মুক্তি দাও। (আত-তাবরানী) এ হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট যে, দরিদ্রতার মধ্যে থেকে ইমানের পরিপূর্ণ দাবি পূরণ সম্ভব নয়। এ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের কর্মসংস্থানের পথে অগ্রসর হতেই হবে।
ইসলামে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে কোনো শৈথিল্যতার প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। অধিকিন্তু, কর্মকে কখনও নফল ইবাদতের ওপর স্থান দেওয়া হয়েছে। হযরত উমরের (রা.) সময় অনেক নফল রোজাদারকে নফল ইবাদতের চেয়ে নিজস্ব কর্মতৎপরতার ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কেননা হালাল রুজি ছাড়া ইবাদত কবুল হয় না। অন্যদিকে সন্ত্রাসকে ইসলাম অনুৎসাহিত করেছে। বলা হয়েছে, ‘লা রাহবানিয়াতা ফিল ইসলাম’, ইসলামে কোনো সন্ত্রসবাদ নেই। সন্ত্রাসবাদ মানুষকে মূলত কর্ম ও সমাজবিমুখ করে দেয়। ইসলাম তাকওয়ার ওপর গুরুত্ব দেয়। তবে সমাজ ও অর্থনৈতিক সাফল্যের বাইরে গিয়ে নয়। এটাই রাসুলের (সা.) সুন্নাহ। কেননা তিনি সংসার করেছেন, ব্যক্তি ও পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য কখনও কারও অধীন কাজ করেছেন আবার কখনও নিজেই আত্মকর্মসংস্থান করেছেন। সুতরাং সবচেয়ে আদর্শ সুন্নাহ হলো হালাল অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে ব্যক্তি ও পরিবারের মৌলিক চাহিদা মেটানোর মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করা।
দারিদ্রতা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে ইসলাম। হযরত উমর (রা.) বলেন, সুফফায় বসবাসকারী কিছু ব্যক্তি রাসুলের (সা.) কাছে এসে অভাব-অভিযোগের আরজি পেশ করলে নবী (সা.) বলেন, দরিদ্রতা প্রায় কুফরির পর্যায়ে নিয়ে যায় আর হিংসা তাকদিরকে অতিক্রম করে। সুতরাং তোমরা বলো, হে আল্লাহ, হে সাত আসমান ও আরশে আজিমের রব, আমাদের থেকে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করো এবং আমাদের দরিদ্রতা থেকে মুক্তি দাও। (আত-তাবরানী) এ হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট যে, দরিদ্রতার মধ্যে থেকে ইমানের পরিপূর্ণ দাবি পূরণ সম্ভব নয়। এ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের কর্মসংস্থানের পথে অগ্রসর হতেই হবে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি রাসুলকে (সা.) বলতে শুনেছি, ‘উপরের হাত নিচের হাত থেকে উত্তম। যাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব রয়েছে তাদের থেকে দান-খয়রাত শুরু কর। (সহিহ বুখারী-১৪৭০) বর্ণিত হাদিসগুলোতে হালাল রুজি অর্জনের জন্য কোনো কাজে সম্পৃক্ত হতে অর্থাৎ চাকরিতে সংযুক্ত হতে অথবা নিজে কর্মসৃষ্টি করতে অর্থাৎ ব্যবসা বা অন্য কোনো হালাল উপায়ে জব সৃষ্টি করতে যে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, ইসলামের নির্দেশনার আলোকে যদি কেউ তা করে, তাহলে সত্যিকার অর্থে তিনি একজন সফল মানুষ ও সফল মুমিন। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা ইমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে তাদের সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতগুলো, যার তলদেশ নিয়ে নহরগুলো প্রবাহিত।’ (সূরা-বাকারাহ-২৫) তবে নারীদের জন্য তাদের বান্ধব কর্মক্ষেত্র গড়ে তুলতে হবে। যে দাবি আমাদের দেশের অনেক নারী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা আমাদের সব কর্মকা-ে দুনিয়ার সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে আখেরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি চাইতে হবে। এ চাওয়ায় আমাদের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। রাষ্ট্রের বিধান মেনে যদি কেউ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে হালাল উপার্জন করে এবং অন্যের স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেয়, তারাই সত্যিকার মুসলিম আবার অন্যদিক দিয়ে রাষ্ট্রের যোগ্য নাগরিক।