Type to search

অভয়নগরে ভৈরব নদ দখল-দূষণের কবলে; নদী রক্ষা কমিটির তৎপরতা নেই

অন্যান্য

অভয়নগরে ভৈরব নদ দখল-দূষণের কবলে; নদী রক্ষা কমিটির তৎপরতা নেই

অপরাজেয় বাংলা ডেক্স-যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভাটপাড়া থেকে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত ভৈরব নদের জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে গুদাম, দোকান ও আবাসিক স্থাপনা। কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তাদের স্থাপনা সম্প্রসারণ করেছে। নদে অবস্থানরত বার্জ ও কার্গোতে পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য নদের মধ্যে বালু, ইট ও পাথর ফেলে পাকা ঘাট তৈরি করা হয়েছে। কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি পড়ছে ভৈরব নদে। এ ছাড়া, নদে চলাচলকারি নৌযানের পোড়া তেল, মানুষের পয়ঃবর্জ্য ও গৃহস্থালীর বর্জ্যও পড়ছে এ নদে। এতে নদের জমি দখল হচ্ছে ও দূষিত হচ্ছে পানি।জীববৈচিত্র পড়েছে হুমবকর মুখে।
সরজমিনে দেখা যায়,নদের মধ্যে খানিকটা জায়গা ঘিরে বাঁশের খুঁটি পোতা হয়েছে। খুঁটি ঘেঁষে টিন ও নাইলনের জাল দিয়ে দেওয়া হয়েছে বেড়া। ঘিরে রাখা জায়গা ভরাট করা হয়েছে মাটি দিয়ে। ভরাট করা জায়গার মাঝ বরাবর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি সাঁকো। ওপরে কাঠের ছাউনি। সাঁকোর সামনে নদে এসে ভিড়ছে বার্জ ও কার্গো। শ্রমিকেরা বার্জ ও কার্গো থেকে পণ্যভরতি বস্তা মাথায় নিয়ে সাঁকো বেয়ে উপরে উঠে আসছেন।
এর মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে নদের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। চারটি ঘরের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে। ঘরের ওপরের ছাউনি এখনও বাকি।
এভাবে প্রতিনিয়ত নদের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা। থেমে নেই দূষণ। বিভিন্ন কারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য নদের পানি দূষিত করছে। দখল-দূষণে বদলে যাচ্ছে ভৈরবের আসল রূপ।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ভৈরব নদ। উপজেলার রাজঘাট থেকে চেঙ্গুটিয়া নদের অংশে আগে থেকেই দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। নতুন করে আবার শুরু হয়েছে নদের জায়গা দখল। সাথে ভয়াবহ দূষণ।
নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় জলাধারের দখল ও দূষণ প্রতিরোধ রয়েছে উপজেলা নদী রক্ষা কমিটি। গত প্রায় আড়াই বছরে অভয়নগর উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ফলে ভৈরব নদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ভৈরব নদের দূষণ রোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার যশোরের জেলা প্রশাসককে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মহামান্য হাইকোর্ট গত ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ ও ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ নদ-নদীর দখল, দূষণ, ভরাট, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেছেন। উক্ত রায়ে নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় জলাধারের দখল ও দূষণ প্রতিরোধ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কয়েকটি সুনিদিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছেন। উক্ত রায়ে মহামান্য আদালত প্রতিটি জেলা, বিভাগ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের অধিক্ষেত্রনাধীন নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় জলাধারের অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রণয়নপূর্বক আগামী ৩০ দিনের মধ্যে জনসমক্ষে প্রকাশের নির্দেশ প্রদান করেছেন। একই সাথে মহামান্য আদালত নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় জলাধারের অবৈধ দখল ও দূষণকে অপরাধ হিসেবে গন্য করার আদেশ জারি করেছেন। রাস্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর ৮৬ ও ৮৭ ধারা এবং ১৪৯(৪) ধারা অনুসারে কালেক্টরেট হিসেবে আপনি সেই ক্ষমতা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত। ফলে উক্তরূপ অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের উচ্ছেদের আইনানুগ ক্ষমতা ও এখতিয়ার আপনারই।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। বিষয়টি আর এগোয়নি।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মুরটি গ্রামে পদ্মার শাখা জলঙ্গি থেকে বেরিয়ে ভৈরব মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা, ঝিনাইদহ জেলার কোর্টচাঁদপুর এবং যশোর জেলার তাহিরপুর ও আফ্রা হয়ে ভৈরব খুলনার পশুর নদীতে গিয়ে মিশেছে। তাহিরপুর থেকে খুলনার পশুর-ভৈরবের মিলনস্থল পর্যন্ত ভৈরবের মোট দৈর্ঘ্য ১৩৩ কিলোমিটার। এরমধ্যে পশুর-ভৈরবের সঙ্গমস্থল থেকে যশোরের আফ্রা পর্যন্ত ভৈরবের ৩৭ কিলোমিটার প্রবাহমান। এরমধ্যে অভয়নগর অংশে রয়েছে প্রায় ২৫ কিলোমিটার। আফ্রা থেকে বসুন্দিয়া বাজার পর্যন্ত চার কিলোমিটার ক্ষীণধারায় প্রবাহমান। বসুন্দিয়া থেকে চৌগাছা উপজেলার তাহিরপুরের কপোতাক্ষের উৎসমুখ পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার প্রবাহহীন। ভৈরবের যে অংশটুকু বেঁচে আছে দুষণের কবলে পড়ে তারও প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভৈরব নদের সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করা হয়েছে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভাটপাড়া থেকে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত। নদের জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে অনেক গুদাম, দোকান ও আবাসিক স্থাপনা। নদ-সংলগ্ন কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তাদের স্থাপনা সম্প্রসারণ করেছে। নদে অবস্থানরত বার্জ ও কার্গোতে পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য নদের মধ্যে বালু, ইট ও পাথর ফেলে পাকা ঘাট তৈরি করা হয়েছে। কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি পড়ছে ভৈরব নদে। এ ছাড়া, নদে চলাচলকারি নৌযানের পোড়া তেল, মানুষের পয়ঃবর্জ্য ও গৃহস্থালীর বর্জ্যও পড়ছে এ নদে। এতে নদের পানি দূষিত হচ্ছে। নদের সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে দুটি ট্যানারি- এসএএফ ইন্ডাষ্ট্রিজ ও সুপারেক্স লেদার লিমিটেড। এ ছাড়া, মজুমদার ব্রান অয়েল মিল, মজুমদার আটো রাইস মিল এবং মজুমদার অ্যাগ্রো ফুড লিমিটেড ভৈরবের দূষণ ঘটাচ্ছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের(বিআইডব্লিউটিএ) হিসাব অনুযায়ি যশোরের অভয়নগর উপজেলায় ভৈরব নদের তীরে অবৈধ স্থাপনা ছিল ৮৬টি। এর মধ্যে যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং বিআইডব্লিউটিএ’র সহযোগিতায় ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে দুই ধাপে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। অবশিষ্ট ২৭টি স্থাপনা পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর পর থেকে উচ্ছেদ অভিযান কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকায় নদের জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বাড়ছে।
উপজেলা নদী রক্ষা কমিটি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অভয়নগর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির বৈঠকে ভৈরব তীরের অবশিষ্ট স্থাপনা উচ্ছেদ করতে বিআইডব্লিউটিএ’কে অনুরোধ করা হয়। প্রতিমাসে উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু এরপর থেকে উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির আর কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। উচ্ছেদও করা হয়নি ভৈরব নদের তীরের অবৈধ স্থাপনা। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ভৈরব নদের দূষণ রোধে।
অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি মো. শাহীনুজ্জামান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন,‘নানা কারণে অনেকদিন উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির কোনো মিটিং হয়নি। আসন্ন ঈদের পর উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির কোনো মিটিং ডাকা হবে। মিটিংয়ে উপজেলা নদ-নদী থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং দূষণ বন্ধে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন,‘নওয়াপাড়া খেয়াঘাটে ভৈরব নদের জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। আমি গত শুক্রবার সেখানে যেয়ে অবৈধ স্থাপনার কিছু অংশ ভেঙ্গে দিয়েছি। বাকি স্থাপনা এক সপ্তাহের মধ্যে সরিয়ে নিতে অবৈধ দখলদারদের বলা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্থাপনা সরিয়ে না নিলে বুলডোজার দিয়ে তা ভেঙ্গে দেওয়া হবে। আর নদীর জায়গা ভরাট করে ঘাট নির্মাণের বিষয়টি আমার জানা নেই। বিষয়টি খোঁজ নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’