
বিলাল হোসেন মাহিনী
আজ একটি মহিমান্বিত দিন। এই দিনে পৃথিবীতে আগমন ঘটেছিল মানবতার শিক্ষক মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা. এর। আবার এই দিনেই তিনি এই ধরাধাম থেকে চির বিদায় নেন। জাতীয়ভাবে এই দিনটাকে ঈদে মিলাদুন্নবী হিসেবে পালন করা হয়।
৫৭০ ঈসায়ী সন। চলছে অজ্ঞতা ও মূর্খতার যুগ। যাকে আইয়্যামে জাহেলিয়াও বলা হয়। চারদিকে শিরক-কুফর, অজ্ঞতা-মূর্খতার সয়লাব। মদপান, উন্মাদনা, অসভ্যতা, পাগলামি, উৎকোচভোগ, ছিনতাই, রাহাজানি, সম্পদ ও নারীলিপ্সাসহ নানান কুপ্রবৃত্তির সবার শীর্ষে পৌঁছেছিল। নির্দয়তা ও আত্মকেন্দ্রিকতা এতটাই প্রবল ছিল যে, শিশু কন্যাকে জীবিত দাফন করা হতো। অন্যদিকে পুত্রকে হত্যা করা হতো এই আশঙ্কায়, সে সম্পদের ভাগীদার হবে।
সে সময়ে পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি ছিল না, যাদের সার্বিক বিচারে সভ্য বলা যেতে পারে। এমন কোনো সমাজব্যবস্থা ছিল না, যাকে নৈতিকতা-উন্নত চরিত্রের বাহন বলা যেতে পারে। এমন কোনো শাসনব্যবস্থা ছিল না, যা ন্যায়বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। এমন কোনো নেতৃত্ব ছিল না, যা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ধারক ছিল। মানবীয় আচার-আচরণের দিকে তাকালে পুরো পৃথিবীতেই বিশৃঙ্খল মনে হতো। মোটকথা, সর্বগ্রাসী তমসায় আচ্ছন্ন ছিল সারা পৃথিবী। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী নবী করিম সা.-এর আগমন-পূর্ব পৃথিবীর চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন অধঃপতিত যুগ। বিশ্বের সব ইতিহাসবেত্তা বিনাবাক্যে এ কথা স্বীকার করেছেন। মানবতা যুগ যুগ ধরে পতনের যে অতল গহ্বরের দিকে নেমে আসছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীতে এসে তা পাতালের শেষ বিন্দুতে নেমে যায়।
তখণ ভূপৃষ্ঠে এমন কোনো শক্তি ছিল না, যে মানবতার হাত ধরে এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করবে। ফলে অধঃপতনের গতি প্রতিদিনই দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছিল। প্রভুবিস্মৃতির শিকার মানুষগুলো সম্পূর্ণভাবে আত্মবিস্মৃতিরও স্বীকার হয়েছিল। সত্য-মিথ্যা আর ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ন্যূনতম যোগ্যতাও পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল। মুসলমানদের পতনে বিশ্বমানবতা কী হারালো? (পৃষ্ঠা : ৫৫)
ঘন আঁধারে ঘেরা এই পৃথিবী যখন সুবেহ সাদিকের তীব্র প্রতীক্ষায়, ঠিক তখনই তিনি এলেন এই পৃথিবীর আলোকোজ্জ্বল প্রদীপ হয়ে। এলেন চারদিকে আলো ছড়িয়ে। পৃথিবীতে জমে থাকা অন্ধকারকে বিদায় জানালেন। সমস্ত পৃথিবী ও মৃতপ্রায় মানবতাকে নতুন জীবন দান করেছে দুনিয়ায় তার আগমন। তিনি এসে আলো-অন্ধকার, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছেন। এই বিভাজনের চেয়ে বড় কোনো বিভাজন নেই। সেই বিভাজন এতটাই দ্রুতগতিতে তিনি টেনে দিয়েছেন, মানব ইতিহাসে তার কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
মহান রব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘আলিফ-লাম-রা। (হে নবী) এটি (কোরআন মজিদ) এমন এক কিতাব, যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি মানুষকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর ভেতর নিয়ে আসতে পারো। অর্থাৎ সে সত্তার পথে, যার ক্ষমতা সবার ওপর প্রবল এবং যিনি সমস্ত প্রশংসার উপযুক্ত।’ (সুরা ইবরাহিম : ১) নবী সা.-এর নবুয়তের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই উম্মিদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসুল পাঠিয়েছেন। যে তাদের সামনে তার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবে। তাদের পরিশুদ্ধ করবে এবং তাদের শিক্ষা দেবে কিতাব ও হিকমাত। যদিও এর আগে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহিতে নিপতিত ছিল।’ সুরা জুমুআ : ২
আল্লাহর রাসুল সা. মানবসমাজের একেকজন সদস্যকে একেকটি মহামূল্যবান সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। মানবতার যে কাঁচামালকে আবর্জনা ভেবে অবহেলা আর অনাদরে ফেলে রাখা হয়েছিল। সেগুলোকে পরিষ্কার করে কাজে লাগানো ও উপযুক্ত স্থানে ব্যয় করার কথা কারও মনে উঁকিও মারেনি। অজ্ঞতা ও মূর্খতা যাদের বরবাদ করে রেখেছিল। নবী করিম সা. তাদের মধ্যে জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে নবী) আমি আপনাকে বিশ্ব জগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭) দাওয়াতের শুরুতেই তিনি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও কল্পনাপ্রসূত উপাস্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার শিক্ষা দিলেন। মানুষের মধ্যে বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা দিলেন, হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা মুখে বলো ও অন্তরে বিশ্বাস করো, আল্লাহ ছাড়া ইবাদত ও আনুগত্যের উপযুক্ত আর দ্বিতীয় কেউ নেই। তবেই তোমরা সফলকাম হবে।
নবী করিম সা. -এর সংস্পর্শ ও শিক্ষার বদৌলতে ধ্বংসপ্রায় আরব জাতির মধ্যে এমন আমূল পরিবর্তন হয়েছে যে, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তাদের মধ্যে এমন এমন ব্যক্তিত্ব জন্ম নিয়েছেন। যারা বিশ্বের ইতিহাসে প্রাতঃস্মরণীয় বিরল ব্যক্তিত্ব ও চিরবরণীয় শ্রদ্ধাভাজনের আসন অলংকৃত করেছেন। নবীজি সা.-এর আবির্ভাব মানবসভ্যতাকে একটি নতুন জীবন, নতুন জ্যোতি, নতুন শক্তি, নতুন উষ্ণতা, নতুন ইমান-বিশ্বাস, নতুন সংস্কৃতি, নতুন চেতনা ও নতুন জীবনবোধ উপহার দিয়েছেন। ফলে ধ্বংসের প্রস্তুতি নিতে থাকা মানবতা ফিরে পেয়েছে তার হারিয়ে যাওয়া প্রাণ।