মণিরামপুরে এডিপির কাজে হরিলুটের অভিযোগ
মণিরামপুর (যশোর) প্রতিনিধি : মণিরামপুরে এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী) ও উপজেলা উন্নয়ন তহবিলের কাজে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে (উপজেলা পরিষদের খাত ভিত্তিক বিভাজন) বিশেষ বরাদ্দের ৫০ লাখ টাকাসহ বরাদ্দকৃত প্রায় ৪ কোটি টাকায় প্রকল্প গ্রহনের নামে অর্থ লোপাটের আয়োজন করা হয়েছে। গৃহীত প্রকল্পের মেয়াদ ৩১ আগস্টের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও সিংহভাগ গৃহীত (পিআইসি) প্রকল্প বাস্তবে তা আলোর মূখ দেখেনি।
সংশ্লিষ্ট অফিস সূত্র জানায়, চলতি অর্থ বছরে (২০১৯-২০) দরপত্রের মাধ্যমে বস্তুগত অবকাঠামো (যোগাযোগ ব্যবস্থা) উন্নয়নে সর্বমোট ২ কোটি ৪২ লাখ ২ হাজার ৯০০ টাকার কাজ দরপত্র আহবানের মাধ্যমে করা হয়েছে। সকল কাজের শেষ সময় ছিলো ৩১ আগস্ট। বাকী অর্থের কাজ পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) ও আরএফকিউ ( রেকুয়েস্ট ফর কোটেশন) স্কীমের মাধ্যমে করা হয়েছে। পিআইসির মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহনে করা হয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া সামগ্রি (ক্রিকেট সেট, ফুটবল ও ভলিবল) ক্রয় ও বিতরনে প্রায় ১০ লাখ ৬০ হাজার টাকার (পিআইসি স্কীমের ২,৪,৩৯ নং ও বিশেষ বরাদ্দের ১০টি তালিকা)
১৩টি প্রকল্প থাকলেও মাত্র ৫৫০টি ফুটবল কিনে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের মাঝে বিতরণের জন্য দেয়া হয়েছে। অথচ প্রতিটি ফুটবল মাত্র ৪৫০ টাকা দরে কেনা হলেও দাম নির্ধারন করা হয়েছে ১ হাজার টাকা। এ ফুটবল যশোর শহরের মেসার্স খেলা-ধূলা নামের একটি দোকান থেকে কেনা হয়। দোকান মালিক মামুন জানান, মণিরামপুরের ইউএনও স্যার ও ইঞ্জিনিয়ার স্যার এসে কিনেছেন।
প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, সব ক্রীড়া সামগ্রি কেনা ও বিতরণ করা হয়েছে। সাড়ে ৪০০ টাকায় ফুটবল কিনে ১ হাজার টাকা মূল্য নির্ধারনের বিষয়টি জানতে চাইলে রবিউল ইসলাম সুর পাল্টিয়ে বলেন, এখনো সব কেনা হয়নি, বাকি টাকা দিয়ে ফের কেনা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে ইউএনও সৈয়দ জাকির হাসান বলেন, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে ব্যয়ের জন্য রাখা হবে। অথচ উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকায় এ প্রকল্পের অর্থ এ ধরনের ব্যয়ের কোন সুযোগ নেই।
দু:স্থদের মাঝে ছাগল বিতরনের নামে ২ লাখ টাকা (পিআইসি স্কীমের ৮ নং তালিকা), সেলাই মেশিন বিতরণ ও প্রশিক্ষনের নামে ৪ লাখ (পিআইসি স্কীমের ৫ ও ৩৮ নং তালিকা), ভুট্টা মাড়াই ও ঝাড়ার জন্য নেট ক্রয় ও বিতরণ বাবদ ২ লাখ, (পিআইসি স্কীমের ২০ নং তালিকা) প্রকল্প নেয়া হলেও এখনো তা বিতরণের কথা ইউপি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কেউ জানেন না।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হীরক কুমার সরকার বলেন, অচিরেই নেট কিনে বিতরণ করা হবে বলে তিনি শুনেছেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা আবুজার সিদ্দিক জানান, বিষয়টি প্রকল্প সভাপতিই ভালো বলতে পারবেন। তবে, অচিরেই দেয়া হবে তিনি শুনেছেন। কিন্তু উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকার ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোন উপজেলা বাস্তবায়ন অগ্রগতি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রেরণে ব্যর্থ হলে সে উপজেলার অর্থ ছাড় করা হবে না।
এদিকে উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকার ৬ষ্ঠ অনুচ্ছেদে উপজেলা সমূহ ২য় অনুচ্ছেদের ১ উপ-অনুচ্ছেদ বর্নিত খাতভিত্তিক বিভাজন অনুযায়ী ‘আর্থ সামাজিক অবকাঠামো’-এর শিক্ষার উন্নয়নে বরাদ্দের ১০% দেয়ার কথা থাকলেও তা প্রায় ১৮% করা হয়েছে। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে চালুয়াহাটি ইউনিয়নের শয়লাহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংস্কারে এডিপি ১ লাখ টাকা ও বিশেষ বরাদ্দ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা থেকে দুই বার প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে। চলতি বছরের ১৭ মার্চ থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য উপকরণ বিতরণে ২ লাখ (পিআইসি স্কীমের ২৭ নং তালিকা) ও প্লাস্টিক আসবাবপত্র সরবরাহে ২ লাখ টাকার প্রকল্প (পিআইসি স্কীমের ৬ নং তালিকা) নেয়া হলেও তা বিতরণের হদিস মেলেনি।
উপজেলার একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সাথে কথা বলে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে, উপজেলার দেলুয়াবাড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিহার রঞ্জন রায় বলেন, তিনি প্রতিষ্ঠানের জেনারেল তহবিল থেকে ৬৫ হাজার টাকায় প্লাস্টিকের উচু নীচু বেঞ্চ কিনেছেন। পরে বরাদ্দকৃত অর্থ দেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানে পৃথকভাবে ১ লাখ টাকার এই প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে (পিআইসি স্কীমের ৪৫ নং তালিকা)
এছাড়া উপজেলার উন্নয়ন তহবিলের অর্থ দিয়ে মন্দির/ মসজিদ/ গীর্জা নির্মাণ/ পুনঃ নির্মাণ ভবন মেরামত/ সংস্কার ইত্যাদি না করার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানদের চাপে এগুলো করা হয়েছে।
অপর দিকে দরপত্রের মাধ্যমে রাস্তা সোলিং করণেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকার ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রকল্পস্থলে সর্ব সাধারনের অবগতির জন্য প্রকল্পের নাম, ব্যয়সহ প্রকল্প শুরু ও শেষ হওয়ার তারিখ সম্বলিত সাইনবোর্ড স্থাপন করার কথা থাকলেও সিংহভাগ প্রকল্পস্থলে তা করা হয়নি।
সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দেড় লাখ টাকা ব্যয়ে রোহিতা ইউনিয়নের আমজদের বাড়ির মোড় হতে বাগডোব পশ্চিম পাড়া জামে মসজিদ নাম প্রকল্পে রাস্তা সোলিং করণসহ ৫টি পুকুরে প্লাসাইডিং-এর কাজের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। শুধুমাত্র একটি পুুকুরের সামান্য অংশ ও ২০০ ফুট রাস্তা সোলিং করা হয়েছে। ৯০ হাজার টাকা ব্যয় ধরে খেদাপাড়া ইউনিয়নের মান্নানের বাড়ির মোড় হতে লাভলুর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সোলিং করণের কথা থাকলেও সেখানে ওই রাস্তায় কাজের নমুনা চোখে পোড়েনি।
সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পটি পরে পরিবর্তন করে পাল পাড়ায় নেয়া হয়েছে। অথচ সেখানে মাত্র ১৪০ ফুট রাস্তা সোলিং-এর কাজ করা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পে ১ লাখে ২৫০ ফুট রাস্তা সোলিং করনের বিধান রয়েছে। একই চিত্র পাওয়া যায় ওই ইউনিয়নের নুুরোর দোকানের মোড় হতে মোসলেমের বাড়ির অভিমূখ পর্যন্ত রাস্তা সোলিং করণের কাজে।
অপর দিকে কুলটিয়া ইউনিয়নে একই রাস্তা দুইবার দেখিয়ে ৯টি সোলিং রাস্তার বিপরীতে পিআইসি স্কীমে ১২ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে গেলে দেখা যায় অধিকাংশ রাস্তার কাজে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কম করা এবং ইট-বালির ক্ষেত্রে নয়-ছয় করার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি আ¤্রঝুটা কালিতলা হতে বাবু সাধন হালদারের বাড়ী পর্যন্ত রাস্তা সোলিং করণের কাজ অদেও হয়নি। পিআইসি স্কীমে সাতগাতী পশ্চিমপাড়া পালবাড়ী হতে সাতগাতী পূর্বপাড়া জামে মসজিদ পর্যন্ত একই রাস্তা সোলিং করণের জন্য দুইবার দেখানো হয়েছে এবং ব্যায় নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লক্ষ টাকা। কিন্তু রাস্তাটির সোলিং কাজ মসজিদ পর্যন্ত হয়নি।
ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সিলিং ফ্যান বাবদ ৭০ হাজার এবং ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণের জন্য ৩০ হাজার টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কিছুই পায়নি। অপর দিকে কুলটিয়া, নেহালপুর এবং ভোজগাতী ইউনিয়নে চারা বিতরণের জন্য ৩ লক্ষ টাকা বরাদ্ধ থাকলেও নামমাত্র কিছু চারা বিতরণ করা হয়েছে। তবে এরমধ্যে কুলটিয়া ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা পানিতে প্লাবিত থাকায় চারা বিতরণে প্রশ্নবিদ্ধ রয়েছে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শেখর চন্দ্র রায় বলেন, বরাদ্ধ অনুযায়ী কাজ করানো হয়েছে।
জানতে চাইলে উপজেলা প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, কাজ ঠিকমত না হলে বিল ছাড়করণ হবে না।