Type to search

ভবদহ অঞ্চল আবার ডুবে গেল

অন্যান্য

ভবদহ অঞ্চল আবার ডুবে গেল

চৈতন্য কুমার পাল:
বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে যশোরের ভবদহ অঞ্চলের প্রায় ৪০টি গ্রামের নিন্মঅংশ। চলতি আগস্ট মাসের কখনও হালকা কখনও মাঝারি বৃষ্টিপাতে এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। পানিতে প্লাবিত হয়েছে বাড়িঘর ,স্কুল, রাস্তাঘাট, ধর্মীয় উপসানলয়। বিলগুলোতে প্রতিদিন বাড়ছে পানি। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এলাকার মানুষ।
এলাকার ভ’ক্তভোগী মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মনিরামপুর উপজেলার কুচলিয়া, নেবুগাতী, পাঁচকাটিয়া, ভুলবাড়িয়া, কুমারসীমা, পাচাকড়ি হাটগাছা, সুজাতপুর, কুলটিয়া, লখাইডাঙ্গা, মহিষদিয়া, আলীপুর, পোড়াডাঙা, পদ্মনাথপুর, পাড়িয়ালী, দহাকুলা, অভয়নগর উপজেলার বলারাবাদ, বেদভিটা, ডুমুরতলা, আন্ধা, বারান্দী, দিঘলিয়া, কোটা, ডহর মশিয়াহাটী, রাজাপুর, সুন্দলী, ভাটবিলা, সড়াডাঙা, হরিশপুর, ফুলেরগাতী, দামুখালী, কপালিয়া, দত্তগাতীসহ প্রায় ৪০টি গ্রামের কোথাও আংশিক আবার কোথাও বেশিরভাগ বাড়িতে পানি উঠেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এ সব গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ ।

 

 

 

জানা গেছে, যশোরের সদর উপজেলার আংশিক, অভয়নগর, মণিরামপুর, কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার ৫৪টি বিলের পানি নিষ্কাশিত হয় শ্রী নদীর ওপর নির্মিত ভবদহ স্লুইসগেট দিয়ে। এই অঞ্চলটি ভবদহ অঞ্চল নামে সমধিক পরিচিত। ২০১৩ সালেরপর এলাকার কোনো বিলে টিআরএম{(টাইডাল রিভার ম্যানেমেন্ট বা জোয়ারাধার ) না থাকায় পলি পড়ে এলাকার পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীর বুক উচুঁ হয়ে গেছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এছাড়া এলাকার ৫/৬টি বিলের পানি নিষ্কাশনের বিকল্পপথ আমডাঙ্গা খালটি জলাবদ্ধ অবস্থায় বিগত ২০১৮ সালে সংস্কারেরপর পরই উহার পাড় ডেবে বিলের সাথে মিশে যাওয়ায় এবং খালের উপর নির্মিত ব্রিজটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় ওই পথে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না। এই অবস্থায় বৃষ্টির পানিতে এলাকার বিলগুলো প্লাবিত হয়েছে। বিল উপচে পানি বিলসংলগ্ন গ্রামগুলোতে প্রবেশ করছে।
পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন ভবদহ অঞ্চলের পানিবন্দী প্রায় লক্ষািধক মানুষ। গত মঙ্গলবার ও বুধবার অভয়নগর উপজেলার ডুমুরতলা, আন্ধা, ডহরমশিহাটি ও মণিরামপুর উপজেলার সুজাতপুর, হাটগাছা, কুচলিয়া, পাঁচকাটিয়া গ্রাম ঘুরে মানুষের চরম দুর্ভোগগের চিত্র দেখা গেছে। গ্রামগুলোর শতশত বাড়িতে পানি উঠেছে। বেশ কয়েকটি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও পানির নিচে চলে গেছে। রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় এলাকার কযেকটি জায়গায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার ঘরের মধ্যে মাচা করে সেখানে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পানিবন্দী মানুষদের কয়েকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন উচুঁ সড়কের ওপর। এলাকায় প্রতদিন পানি বাড়ছে।
মণিরামপুর উপজেলার সুজাতপুর গ্রামের সুকুমার দাস রাস্তা থেকে ঘরে যাতায়াতের জন্য বাঁশের সাঁকো তৈরি করছিলেন। তিনি বলেন,‘বাড়ির উঠোনে দেড় হাত আর ঘরের মধ্যি চার ইঞ্চি জল। ঘরে ইট দিয়ে খাট উঁচু করে স্যানেই(সেখানেই) থাকছি। কিন্তু জল যিভাবে বাড়তিছে তাতে কুব বেশিদিন ঘরে থাহা যাবে নানে।’
উপজেলার হাটগাছা গ্রামের রবীন্দ্রনাথ বৈরাগী বলেন, ‘উঠোনে এক বিঘাত(৬ ইঞ্চি) জল। বৃষ্টি থেমে গিলিও প্রত্যিকদিন এক থেহে-দুই ইঞ্চি জল বাড়তেছে। যেকোনো সময় ঘরের মধ্যি জল উঠে যাবেনে।’ অভয়নগর উপজেলার ডুমুরতলা গ্রামের গৃহবধূ সুপ্রিয়া বৈরাগী বলেন,‘উঠোনে জল। রান্নাগরে জল। তাই বড় গরের বারান্দায় রান্না করতিছি।’ ওই গ্রামের স্কুল শিক্ষক শিবপদ বিশ্বাস বলেন, ‘গ্রামের শতাধিক বাড়িতে জল ওঠেছে। সামান্য বৃষ্টি হলিই বাড়ি ছাড়তি অবে।’ মণিরামপুর উপজেলার হরিদাশকাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিপদ ভঞ্জন পাড়ে বলেন, ‘ আমার ইউনিয়নে ২২ টি গ্রাম। তারমধ্যে তিনটি গ্রামের অধিকাংশ এলাকায় এবং অপর ৭/৮টি গ্রামের কিছু কিছু বাড়িতে জল উঠেছে।’
অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিকাশ রায় বলেন, ‘সুন্দলী ইউনিয়নে ১৪টি গ্রামের মধ্যে ১২টি গ্রামে আংশিক বাড়িঘরে জল উঠেছে। এলাকার বিলগুলো গত চার বছর ধরে জলাবদ্ধ। এসব বিলের নি¤œাংশে কোনো ফসল হয় না। আমডাঙ্গা খালটি সংস্কার করলে আমার ইউনিয়নের কোথাও জল থাকত না। ’
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সুন্দলী এলাকার সদস্য সচিব কানু বিশ্বাস বলেন,‘ এলাকার বিলগুলোতে জল থৈ থৈ করছে। অনেক মাছেরঘের ও ফসল তলিয়ে গেছে। বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে বিল উপচে জল প্রতিদিন বাড়িঘরে ঢুকছে। ইতিমধ্যে সুন্দলী এলাকার কয়েকশ’ বাড়িতে জল ঢুকেছে। এবার আবার ২০০৫ ২০০৬ ২০১৬ সালের মত ব্যাপক এলাকায় জলাবদ্ধতার আশংকা রয়েছে।’
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিত বাওয়ালী বলেন,‘ কয়েকদিনের সামান্য বৃষ্টিতে ভবদহ এলাকা ডুবতে শুরু করেছে। ৪০টি গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। অনেকের ঘরের মধ্যে জল প্রবেশ করেছে।’ তিনি বলেন,‘ এলাকার বিলে টিআরএম (জোয়ারাধার) চালু না করলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি নেই। টিআরএম এর দাবিতে আমরা গত ৯ তারিখ ডিসি অফিসের সামনে মানববন্ধন করেছি। দ্রুত মিটিং করে বিল কপালিয়ায় টিআরএম বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন শুরু করবো।’
যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: তাওহীদুল ইসলাম বলেন,‘ভবদহের নদীগুলোতে পাইলট চ্যানেল খনন অব্যহত রয়েছে। কিন্তু খননের পর পলিতে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মুক্তেশ্বরী নদীর দুই দশমিক ১০ কিলোমিটার এবং ভবদহ স্লুইসগেটের(২১ ভেন্ট) উত্তর ও দক্ষিণে মোট ৪০০ মিটার খননের কাজ চলছে।’ তিনি বলেন,‘ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি বিলের পানি আমডাঙ্গা খাল দিয়ে অপসারিত হয়। কিন্তু কিছুদিন ভৈরব নদে জোয়ার অনেক উচ্চতায় থাকায় আমডাঙ্গা খালের ¯¬ুইসগেট বন্ধ ছিল। জোয়ারের চাপ কমে গেছে। আমি আজ আমডাঙ্গা গিয়েছিলাম। বেশ পানি বের হচ্ছে। ভবদহ দিয়েও অল্প অল্প পানি নেমে যাচ্ছে। আশা করছি দ্রুত জমে থাকা পানি সরে যাবে।’