চৌগাছায় সেই অভিযুক্ত প্রকৌশলী’ই তদন্ত কমিটির প্রধান
চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি
যশোরের চৌগাছায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিবি) বরাদ্দে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি পোর্টেবল এক্সরে মেশিন ক্রয়ে মারত্মক ঘাপলাবাজির আশ্রয় নিয়েছেন উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মতিন। যেখানে বর্তমান বাজারে একটি পোর্টেবল এক্সরে মেশিনের দাম ১৪ লক্ষ টাকা। সেখানে এডিবির স্বাস্থ খাত থেকে মাত্র ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করে হাসপাতালে একটি পুরাতন ও ত্রুটিযুক্ত মেশিন ঠিকাদারের যোগসাজসে সরবরাহ করা হয়।
গত ১১ জুলাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোছাঃ লৎফুন্নাহার লাকি এডিবির অর্থে হাসপাতালে সরবারাহকৃত পুরাতন ও ত্রুটিযুক্ত মেশিন ফেরৎ নিতে উপজেলা চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দিয়েছেন। যেটি ১২ জুলাই উপজেলা চেয়ারম্যানের দপ্তর রিসিভ করেছে। সেখানে তিনি লিখেছেন ‘‘উপজেলা পরিষদ থেকে গত ২৯.০৬.২০২০ তারিখে একটি পোর্টেবল এক্সরে মেশিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরবরাহ করা হয়। মেশিনটি গ্রহন করে স্টোর কিপার স্টোরে রাখেন এবং মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (রেডিওগ্রাফি) মেশিনটি ঠিক আছে বলে জানান। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ জনবল (রেডিওলজিষ্ট) না থাকায় মেশিনটি পুরাতন তাহা বুঝা যাই নাই। পরে ০২.০৭.২০২০ তারিখে স্থানীয় সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব) অধ্যাপক ডাক্তার নাসির উদ্দিন মেশিনটি উদ্বোধন করতে আসেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার। তিনি মেশিনটি দেখে বুঝতে পারেন যে মেশিনটি পুরাতন। নি¤œ স্বাক্ষরকারী মনে করেন পুরাতন, ত্রুটিযুক্ত মেশিনে এক্সরে করলে সঠিক রিপোর্ট নাও আসতে পারে।’’
সূত্রের দাবি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মতিন ও তার অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল বারীকে উৎকোচের মাধ্যমে ম্যানেজ করেন। এরপর খুবই পুরাতন একটি মেশিন রংচং করে প্যাকেজিং করে ২৯ জুন অর্থবছরের একেবারে শেষ মুহুর্তে হাসপাতালে সরবরাহ করেন। হাসপাতালের স্টোর কিপার ও এক্সরে মেশিন অপারেটর সেটি প্যাকেজিং অবস্থায় গ্রহন করেন। গত ২ জুলাই স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব) অধ্যাপক ডাক্তার নাসির উদ্দিন মেশিনটি উদ্বোধনের সময় বুঝতে পারেন মেশিনটি রংচং করা এবং পুরোনো। পরে নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদুল ইসলাম তড়িঘড়ি করে ৫ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন এবং ৫ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দেন। সেই তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে চৌগাছা উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মতিনকে। তার সাথে সদস্য করা হয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ এবং বিআরডিবির প্রকল্প কর্মকর্তা (পজিপ) আনিছুর রহমান তালুকদারকে। এই তদন্ত কমিটি গঠনের ৯ দিন পার হলেও কোন তদন্ত করেন নি। প্রশ্ন উঠেছে যে উপজেলা প্রকৌশলী নিজে পোর্টেবল এক্সরে মেশিন ক্রয়ের প্রাক্কলন তৈরি, তদারককারী কর্মকর্তা এবং তিনি নিজেই কাজটির বিল তৈরির সাথে সম্পৃক্ত। তিনিই কিভাবে এই কাজের দুর্নীতি তদন্ত কমিটির আহবায়ক হলেন?
এদিকে উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মতিন তার অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল বারীকে নিয়ে সোমবার দুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দপ্তরে যান বিষয়টির তদন্ত করতে। সেখানে সাংবাদিকরা উপস্থিত হলে তিনি তড়িঘড়ি করে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয় ত্যাগ করার চেষ্টা করেন। সে সময় তাকে প্রশ্ন করা হয় আপনি তো এই কাজের ডিডিএ আপনি কিভাবে তদন্ত কমিটির আহবায়ক হলেন? তখন তিনি বলেন আমি ডিডিএ নই। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা চেয়ারম্যান ডিডিএ। তখন বলা হয় আপনি তো প্রাক্কলন ও বিল তৈরির সাথে সম্পৃক্ত এবং তদারককারী কর্মকর্তা। দুর্নীতি হলে তো আপনিই করেছেন। আপনি কিভাবে এই তদন্ত কমিটির আহবায়ক হলেন? তখন তিনি বলেন এখানে এ বিষয়ে কোন কথা বলবো না। আমার অফিসে আসেন। সেখানে সব কথা বলবো। তাকে প্রশ্ন করা হয় আপনি এখানে কেন এসেছেন আর তদন্ত কমিটির অপর দুজন কোথায়? তখন তিনি বলেন আমি এসেছি স্বাস্থ কর্মকর্তার সাথে একটু কথা বলতে। একটু কথা বললাম। বলেই তিনি ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল বারী দ্রুত স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে চলে যান। এদিকে তদন্ত কমিটির অন্য দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন কমিটির আহবায়ক উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মতিন তদন্তের বিষয়ে তাদের কিছুই অবহিত করেন নি। আজকে যে তিনি হাসপাতালে গিয়েছেন সে বিষয়েও কিছু জানান নি।
উপজেলা প্রকৌশল অফিস ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে যশোরের চৌগাছায় ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিবি) অর্থের স্বাস্থ খাতের বরাদ্দ থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি পোর্টেবল এক্সরে মেশিন প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। ২৫ এপ্রিল-২০২০ তারিখে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদের মাসিক উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে মোতাবেক চৌগাছা উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মতিন ৪ জুন দরপত্র গ্রহণের শেষ তারিখ নির্ধারণ করে ১৬ ই মে দরপত্র আহবান করেন। তবে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি যাচাই করে দেখা গেছে ‘‘এডিপি/২০১৯-২০, চৌগাছা-১১’’ প্যাকেজ নির্ধারণ করে কাজের নাম লেখা হয়েছে ‘‘উপজেলা হাসপাতালে পোটেবল এক্সরে মেশিন ক্রয়’’। প্রাক্কলিত মূল্য লেখা হয়েছে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। সেখানে কোন মডেলের এক্সরে মেশিন অথবা নতুন বা রিকন্ডিশনড কিছুই লেখা হয় নি।
প্রকৌশল অফিস সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি মূলতঃ এখানেই দুর্নীতি করার জায়গা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। যেখানে বর্তমানে একটি পোর্টেবল এক্সরে মেশিনের বাজার দর ১৪ লক্ষ টাকার উপরে। সেখানে কিভাবে উপজেলা প্রকৌশল অফিসের প্রাক্কলন তৈরির সাথে সংশ্লিষ্টরা ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায় প্রাক্কলন করলেন। সূত্রের দাবি উপজেলা প্রকৌশলী এবং প্রাক্কলন তৈরির সাথে সংশ্লিষ্ট উপ-সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল বারী যোগসাজসে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে চালু অবস্থায় যে কোন একটি পোর্টেবল এক্সরে মেশিন সরবরাহ করার মৌখিক নির্দেশ দেন এবং এর বিনিময়ে মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহণ করেন।
জানা গেছে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিবি) আওতায় উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্পে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলীর নেতৃত্বে উপ-সহকারী প্রকৌশলীরা ঠিকাদারের সাথে যোগসাজোসে এসব প্রকল্পগুলি নামকাওয়াস্তে সম্পন্ন করে টাকা তুলে নিয়েছেন।
এ বিষয়ে উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য আসাদুজ্জামান বলেন এই এক্সরে মেশিনের পুরো ক্রয় প্রক্রিয়াটিই অস্বচ্ছ। এখানে ক্রয় প্রক্রিয়ার সর্বময় ক্ষমতা উপজেলা পরিষদের। উপজেলা প্রকৌশলী নিজে এডিবির প্রাক্কলন তৈরি, কাজ তদারককারী ও বিল প্রদানকারী কর্মকর্তা। তার দায়িত্ব মেশিনটি বুঝে নিয়ে হাসপাতালে হস্তান্তর করা। তিনি সেটা করেন নি। আবার তিনিই এই কাজের দুর্নীতির তদন্ত কমিটির আহবায়ক হন কি করে? তাছাড়া বর্তমানে একটি পোর্টবল এক্সরে মেশিনের বাজার মূল্য ১৪ লক্ষ টাকার উপরে। সেখানে মাত্র সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়ার সময়ে বা প্রাক্কলন তৈরির সময়ে উপজেলা প্রকৌশলী বিষয়টি কেন দেখেন নি বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন নি?
এ বিষয়ে নবাগত চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকৌশলী এনামুল হক বলেন তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটি রিপোর্ট দেয়ার পর বিষয়টি বলা যাবে। এখন তদন্তাধীন বিষয়ে কোন কথা বলা ঠিক হবে না। যার দিকে অভিযোগের তীর সেই উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল মতিন কিভাবে তদন্ত কমিটির আহবায়ক হলেন প্রশ্নে তিনি বলেন কমিটি আমার আগের ইউএনও স্যার করেছেন। এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তদন্ত কমিটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তদন্ত করবেন আশা রেখে তিনি বলেন কমিটি কি প্রতিবেদন দেয় দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। মেশিনটি ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনে টেকনিক্যাল উপ-কমিটি করা যেত মন্তব্য করে তিনি বলেন ক্রয় প্রক্রিয়ার নীতিমালায় যেভাবে ক্রয়ের কথা বলা হয়েছে সেগুলো অনুসরন করা হয়েছে কিনা সেগুলো সবই দেখা হবে।