Type to search

চৌগাছায় শতাব্দী প্রাচীন পীর বলুহ (রহ) মেলা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে দোলাচলে এলাকাবাসি

যশোর

চৌগাছায় শতাব্দী প্রাচীন পীর বলুহ (রহ) মেলা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে দোলাচলে এলাকাবাসি

চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি
যশোরের চৌগাছার শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) মেলা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে এলাকাবাসির মধ্যে। প্রতি বাংলা সনের ভাদ্রমাসের শেষ মঙ্গলবার থেকে এই মেলা অনুষ্ঠিত হলেও এ বছর করোনা ভাইরাসের কারনে মেলার অনুমোদন পাওয়া নিয়ে দোলাচলে রয়েছেন মেলা কমিটির নেতৃত্বস্থানীয়রা। মেলার সময় যতই ঘনিয়ে আসছে এলাকাবাসির সংশয় ততই বাড়ছে। এ বিষয়ে চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রকৌশলী এনামুল হক জানিয়েছেন মেলা কমিটি অনুমতি চেয়ে এখনো কোন আবেদন করেননি বলেই জানি। যেহেতু বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কারনে বিভিন্ন বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। সেহেতু তারা আবেদন করার পর বিষয়টি নিয়ে সব ধরনের পর্যালোচনা করে জেলা প্রশাসক মহোদয় সিদ্ধান্ত দেবেন।
নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের হাজরাখানা ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য, উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য ও বিগত বছরগুলোর মেলা কমিটির সদস্য সচিব মনিরুজ্জামান মিলন জানান অন্যান্য বছরগুলোতে প্রথমে স্থানীয় সংসদ সদস্য মেলা কমিটি করে দেন। এরপর মেলা কমিটি যশোরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) বরাবর মেলার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। একইভাবে ওরসের জন্য বলুহ দেওয়ান (রহ) মাজারের খাদেম অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করেন। জেলা প্রশাসক চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে মেলার অনুমতি দেন। বিগত বছরগুলিতে এ অনুমতি ৩ থেকে ১৫ দিনের হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি জানান চলতি বছর করোনা ভাইরাসের কারনে মেলা অনুষ্ঠান নিয়ে দোলাচলে রয়েছি। অন্যান্য বছরে প্রায় একমাস আগেই মেলা কমিটি গঠন করা হলেও এবছর আজ (বুধবার) পর্যন্ত কোন কমিটি গঠন হয়নি। ফলে মেলার অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়নি। তিনি বলেন মেলায় যারা দোকান দেন সেসব ব্যবসায়ীরা আমাদের সাথে যোগাযোগ করলেও তাদের কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছিনা।
সূত্রমতে মেলা পরিচালনা কমিটি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রতি বাংলা সনের শেষ মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও মেলায় আসবাবপত্রসহ অন্যান্য দ্রব্যাদির বেচাকেনা শুরু হয়ে যায় সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই। মেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবক কমিটি, আনছার-ভিডিপি সদস্যরা ছাড়াও থানা পুলিশের একটি দল থাকে। চলতি বছরে মেলার অনুমতি দেয়া হবে কিনা এসব বিষয় নিয়ে গ্রামবাসি রয়েছেন দোলাচলে। তাদের কেউ কেউ বলছেন দেশের অন্যান্য পর্যনট স্থানগুলি যেহেতু খুলে দেয়া হচ্ছে সেহেতু সীমিত আকারে মেলার অনুমতি হয়ত দেয়া হতেও পারে। আবার অন্যপক্ষ বলছেন করোনা ভাইরাস এখনো নিয়ন্ত্রনে যেহেতু আসেনি। মেলায় জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জটিলতার বিষয়। সে কারনে মেলার অনুমতি হয়ত দেয়া হবে না। এসব বিষয় নিয়ে দোলাচলে রয়েছেন বলে জানালেন গ্রামের বাসিন্দা ও চৌগাছা শহরের কনফেকশনারী ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন। একই কথা বলেন গ্রামের বাসিন্দা পত্রিকার হকার ইশানুর রহমান ও প্রেসক্লাব চৌগাছার অফিস সহায়ক হাসান আলীও। তাদের কথা প্রশাসন অনুমতি দিলে মেলা হবে না দিলে হবে না। তবে ব্যবসায়ীরা চান মেলা অনুষ্ঠিত হোক।
প্রতি বাংলাসনের ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) রওজা শরীফকে ঘিরে যশোরের চৌগাছা উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের তীরে বসে এই মেলা। হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের পাশে উঁচু ঢিবির ওপর এ অঞ্চলের পীরে কামেল বলুহ দেওয়ান (রহ) এর রওজা শরীফ অবস্থিত। মেলার সময় এলে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে পড়ে যায় ব্যস্ততার ধুম। এ অঞ্চলের কয়েকটি গ্রামে ঈদে-পূজায় না হলেও মেলা উপলক্ষে মেয়ে-জামাই দাওয়াত করার রেওয়াজ রয়েছে। যাকে ঘিরে এই মেলা তার সম্পর্কে রয়েছে নানা মিথ। লোক মুখে প্রকাশ পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ‘তিনি যা বলতেন তাই হতো।’ তার জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত ছিল রহস্যে ঘেরা। তিনি একই উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের ছুটি বিশ্বাসের ছেলে। তবে জন্মকাল সম্পর্কে আজও কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। জেষ্ঠ ভক্তদের মতে ‘তিনি ৩-৪ শ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন।’
তবে জেষ্ঠ সাংবাদিক নাসির হেলালের লেখা ‘যশোর জেলায় ইসলাম প্রচার ও প্রসার’ এবং সাংবাদিক মাসুদ পারভেজের লেখা ‘চৌগাছার পীর-দরবেশ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় আনুমানিক ষোড়’শ শতাব্দির প্রথমদিকে তিনি জন্মগ্রহন করেন। গ্রন্থদুটি থেকে জানা যায় বলুহ (রহ) এর নামে ভারতের কলকাতা ও নদীয়া, বাংলাদেশের চৌগাছার হাজরাখানাসহ বিভিন্ন স্থানে ৫২টি থান (ইবাদতগাহ) আছে। যেখানে তার ভক্তরা বসে ইবাদত-বন্দেগি করেন। বর্তমানে উপজেলার জিওলগাড়ি, পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বড়-ধোপাধী গ্রামে তার থানে ছোট পরিসরে মেলা বসে থাকে। তার নামে চৌগাছার হাজরাখানা পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) দাখিল মাদরাসার নামকরণ করা হয়েছে।
পীর বলুহ (রহ) সম্পর্কে মিথ প্রচলিত আছে, ‘যখন তাঁর বয়স ১০/১২ বছর তখন পিতার নির্দেশে গ্রামের পার্শ্ববর্তী মাঠে গরু চরাচ্ছিলেন। গরু দিয়ে ক্ষেত নষ্ট করার অভিযোগে ক্ষেতের মালিক গরুগুলি ধরতে গেলে তিনি সব গরু বক বানিয়ে বটগাছে বসিয়ে রাখেন।’ পিতার মৃত্যুর পর তিনি উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে মামার বাড়িতে থেকে অন্যের জমিতে দিনমজুর খাটতেন। একদিন সরিষা মাড়াই করতে মাঠে গিয়ে সরিষার গাঁদায় আগুন ধরিয়ে দেন। সংবাদ শুনে গৃহস্থ মাঠে গিয়ে দেখে সরিষার গাঁদায় আগুন জ্বলছে। তখন গৃহস্থ রাগান্বিত হলে তিনি হেঁসে ছাই উড়িয়ে দেখিয়ে দেন শরিষা পোড়েনি।’ ‘একদিন তার মামি খেঁজুর রসের চুলায় জ্বাল দিতে বললে তিনি জ্বালানির পরিবর্তে চুলায় পা ঢুকিয়ে আগুনে জ্বাল দিতে থাকেন। এতেও তাঁর পায়ের কোন ক্ষতি হয়নি।’ এমন অনেক অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিতে থাকলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মানুষ তাঁর নিকট এসে শিষ্যত্ব নেন। ‘অলৌকিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বলুহ দেওয়ান পীর আখ্যা পান।’
তার মৃত্যুর পর গ্রামাঞ্চলের মানুষ জটিল ও কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেতে তাঁর নামে মানত করতে থাকে। মানত পরিশোধে প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার হাজরাখানা গ্রামে অবস্থিত তাঁর রওজা শরীফে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, নারকেল ও টাকাসহ নানা দ্রব্যাদি দিয়ে মানত শোধ করতে থাকে। সেখান থেকেই একসময় ভক্তদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রয়োজনে গড়ে ওঠে পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) মেলা। দীর্ঘদিন থেকে স্বল্প পরিসরে মেলা হতে থাকলেও বিগত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে জমজমাট মেলা। প্রতি ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার মেলা শুরু হয়ে ৩ থেকে সাত দিন মেলার আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও মেলা শুরুর ১৫/২০ দিন পূর্ব থেকে শেষের ১০/১২ দিন পর্যন্ত চলমান থাকে মেলার বেচাকেনা।
একসময় মেলায় বিশৃঙ্খলা ছিল নিয়মিত ঘটনা। ২০০২ সালে মেলায় ব্যাপক বোমাবাজি করে সন্ত্রাসীরা। সেসময় মেলায় কয়েকজন দোকানী ও দর্শনার্থী হতাহত হয়। অন্যদিকে ২০০৯ সালে মেলাচলাকালীন চৌগাছা শহরে উপজেলা আওয়ামী লীগের অফিসে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলা ও গুলিতে খুন হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সেসময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক পাশাপোল ইউপি চেয়ারম্যান ইমামুল হাসান টুটুল। পরে প্রশাসনিকভাবে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ায় সে পরিবেশ পাল্টে গেছে।
মেলায় সারা দেশ থেকে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা আসেন ব্যবসা করতে। এ অঞ্চলের যশোর-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরা জেলার ২০/৩০ টি উপজেলার মানুষ আসেন মেলা দেখতে এবং মেলা থেকে আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয় করতে। কপোতাক্ষ নদের তীর থেকে হাজারাখানা পীর বলুহ দেওয়ান দাখিল মাদরাসা পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার বিস্তৃত এ মেলা আয়াতন ও পরিধিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আরেক বিখ্যাত সাতক্ষীরার গুড়পুকুরিয়ার মেলা থেকেও বৃহৎ।