Type to search

চৌগাছার এ্যাম্বুলেন্স চালক আলম একজন সাহসী করোনাবীর

যশোর

চৌগাছার এ্যাম্বুলেন্স চালক আলম একজন সাহসী করোনাবীর

চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি
চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ শুরু হয় ৩ এপ্রিল থেকে। প্রথমদিন থেকেই এই করোনা ভাইরাসের নমুনা নিচ্ছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এ্যাম্বুলেন্স চালক মোঃ আলম। হাসপাতালের ল্যাব টেকনিশিয়ান গোলাম কিবরিয়ার সাথে থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ১০০ জনের নমুনা নিতে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রেখেছেন তিনি। হাসপাতালের পাশেই নিজের বাড়ি হলেও পরিবারের সাথে না থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এ্যম্বুলেন্স রাখার দোতলার একটি রুমে থাকছেন তিনি। এমনকি ঘোষণা দিয়েছেন এই করোনাকালে যেকোন হাসপাতালে তাকে দায়িত্ব দিলে তিনি পালন করবেন।
বেশির ভাগ মানুষ যখন করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত, কেউ আক্রান্ত হলেই দূরে সরে যাচ্ছেন, তখন তিনি সেসব মানুষের একেবারে কাছে গিয়ে সেবা দিচ্ছেন আলম। নমুনা নিয়ে প্রথম দিনে ঢাকায় যাওয়া। আবার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারের জন্য ঢাকা থেকে কীট এনে দেয়া, হসপিটালের সন্দেহভাজনদের ও সনাক্ত রোগীদের বাড়িতে গিয়ে রোগীর পরিবারের নমুনা নিতে সাহায্য করা, হসপিটাল থেকে নমুনা নিয়ে সিভিল সার্জন অফিসে যাওয়া, সেখান থেকে বিভিন্ন রিপোট নিয়ে আসা সবই করছেন তিনি। এসবের মধ্যেও হাসপাতালের একজন চিকিৎসককে যশোর থেকে প্রতিদিন সকালে নিয়ে আসা ও বিকালে যশোর দিয়ে আসছেন।
প্রথম যেদিন শুনলেন নমুনা সংগ্রহের কাজ করতে হবে, কী মনে হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে আলম বললেন, ‘বললেন ছোট বেলা থেকেই আমি একটু সাহসী। তাছাড়া মার সাথে কথা বললাম, তিনি বললেন, যাও। দেখবে আল্লাহর ইচ্ছায় তোমার কোন সমস্যা হবে না। নিজের মনের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস আছে আমি যেহেতু কোন অন্যায় করিনি। মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। তখন আমার কিছু হবে না। পরিবারের বাধা আসছে কিনা প্রশ্নে ২ মেয়ে ও ১ ছেলের জনক মোঃ আলম বলেন, পরিবারের বাধা তো আছেই। আমার বড় মেয়ে কলেজে পড়ছে। ইচ্ছা আছে তাকে ডাক্তারি পড়াবো। ছোট মেয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে। ছেলেটি ছোট। ওদের আর স্ত্রীর পক্ষ থেকে বাধা তো আসছেই। কিন্তু ওদেরকে বুঝিয়েছি। তাছাড়া সবকথা তো আর পরিবারকে বলা যায় না।
তিনি বলেন আমার পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি মার্চের ৫ তারিখে ইন্তেকাল করেন। দেশের এই ক্রান্তিকালে আমি তো বসে থাকতে পারিনা। তাছাড়া পেশায় এ্যাম্বুলেন্স চালক হওয়ায় এটা তো আমার পেশাগত দায়িত্বও।
তিনি বলেন প্রথমদিন চৌগাছার এক নারীকে করোনা সন্দেহে নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় আইইডিসিআরে পাঠানো হয়। সেটি আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম। এরপর যশোর সিভিল সার্জন অফিস থেকে দায়িত্ব দেয়া হয় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে করোনা পরীক্ষার জন্য ঢাকা থেকে কীট এনে দেয়ার। ১৬ এপ্রিল বৃহস্পতিবার কীট এনে দেয়ার পর ১৭ এপ্রিল শুক্রবার থেকে যবিপ্রবিতে এ অঞ্চলের ৭ জেলার করোনা পরীক্ষা শুরু হয়।
এরপর থামার আর অবকাশ মেলেনি আলমের। প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। বললেন, রাতে ঘুম হতে চায় না। করোনার বিভীষিকা, রোগীদের আতঙ্ক, অস্থিরতা আর সব সময় মৃত্যু ভয়ে কাতর মানুষের মুখগুলো চোখের সামনে ভাসে। ভীষণ কষ্ট লাগে, মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে এসব মানুষের দেখে। এখানেই থেমে নেই আলম। নিজের অর্থায়নে বাড়ির আশেপাশের ১৬/১৭ ব্যক্তিকে দিয়েছেন খাদ্য সহায়তা। এসব পরিবারগুলোকে ২৫ কেজি করে চাল কিনে দিয়েছেন নিজের বেতনের টাকায়। এছাড়াও কয়েকজনকে করেছেন নগদ অর্থসহায়তা। বলছিলেন আমি ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত লিবিয়া ও ছিলাম। পরে দেশে এসে ওই বছরই চাকরি হয়ে যাওয়ায় আর বিদেশ যায়নি। আমার তো উপরওয়ালা যথেষ্ট দিয়েছেন। আমাদের হাসপাতালের সাইকেল স্ট্যান্ডের একজন স্বেচ্ছাসেবী আছেন, আরো কিছু স্বেচ্ছাসেবী কর্মী আছেন। আমার বাড়ির পাশে কয়েকজন আছে খুবই দরিদ্র। এখন তারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ওদের কষ্টে নিজের অর্থে কয়েকজনকে ২৫ কেজি করে চাল, কয়েকজনকে নগদ অর্থ সহায়তা করেছি।

বলছিলেন একটি নমুনা সংগ্রহ করতে অনেক সময় লাগে। এখন প্রায় প্রতিদিন গড়ে ১৫/১৭টা করে নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। ল্যাব টেকনিশিয়ান গোলাম কিবরিয়া ভাই নমুনা নিয়ে দেন। ওগুলোর অন্য কাজগুলি আমিই তাকে সহযোগী হিসেবে করে দিই। গত কয়েকদিনে সনাক্ত দুই রোগীর বাড়ি থেকে দু’দুবার করে নমুনা নেয়া হয়েছে। নমুনা নিতে গেলে এরা খুব খারাপ ব্যবহার পর্যন্ত করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন বলে বাড়িতে যাচ্ছেন না। পরিবারের কাছ থেকে আলাদা হয়ে আছেন। হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স রাখার রুমের দোতলায় থাকছেন। কবে বাড়িতে যেতে পারবেন, তারও ঠিক নেই। পরিবারের সদস্যদের জন্যও মনটা কাঁদে। তবে সবচেয়ে খারাপ লাগে দিনশেষে যখন চিকিৎসক ও নার্সদেরই ধন্যবাদ জানানো হয়। আমার মত বা অন্য পদগুলিতে যারা আছেন। এই যেমন প্রতিদিন সকালে কীটবক্সগুলি একজন সুইপার জীবানুমুক্ত করে দেন। এই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে তারও তো ভুমিকা রয়েছে। শুধুমাত্র চিকিৎসক-নার্সদের কথা না বলে যদি বলা হতো স্বাস্থ্যকর্মী তাহলেও আমরা শান্তি পেতাম।

চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. লুৎফুন্নাহার বলেন, আলম এ্যাম্বুলেন্স চালক হয়েও যেভাবে করোনা সংক্রমণের এই সময়ে সাহসিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। তাতে তাকে ধন্যবাদ দিলেও ছোট করা হবে। হাসপাতালের সবাই তাকে বাহবা দিচ্ছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *