Type to search

চালের বাজার দেখবে কে?

ব্যবসা বানিজ্য

চালের বাজার দেখবে কে?

অপরাজেয়বাংলা ডেক্স: সরকারের কোনও উদ্যোগই চালের বাজার সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনতে পারছে না। কারণে অকারণে বাড়ছে চালের দাম। উৎপাদন বাড়িয়ে, বিদেশ থেকে আমদানি করিয়েও বাজারে চালের দাম কমানো যায়নি। ক্রমেই সাধারণ মানুষের চাল কিনতে নাভিশ্বাস বাড়ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে গতবছরের ৩০ সেপ্টেম্বর চালের দর নির্ধারণ করে দিলেও সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে পাত্তা দেননি ব্যবসায়ীরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চালের বাজার দেখার দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্ব খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য- বাম্পার ফলনের পরেও চালের বাজারের ঊর্ধ্বগতি কাম্য নয়। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন- তাহলে চালের বাজার দেখার দায়িত্ব কার?

খাদ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকারি গুদামে ১৬ জুন তারিখে মজুতকৃত চালের পরিমাণ ৯ লাখ ৩৯ হাজার মেট্রিক টন। অপরদিকে সর্বশেষ ১৩ জুন পর্যন্ত বোরো ধান সংগ্রহ হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৭১ মেট্রিক টন। সেদ্ধ বোরো চাল সংগ্রহ হয়েছে ৪ লাখ ২১ হাজার ৮৩০ মেট্রিক টন ও ৩০ হাজার ৭৭১ মেট্রিক টন বোরো আতপ চাল সংগৃহীত হয়েছে।

এদিকে বাজার ঘুরে জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজারে বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম। এর জন্য কেউ কেউ চালের উৎপাদন কম হওয়া, সরবরাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন। আবার কেউ করোনার কারণে পরিবহন খরচকে দায়ী করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত একেবারেই কমে গেছে, যা অশুভ লক্ষণ। সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত না বাড়লে চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে না।

চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য মিলার ও আড়ৎদাররাও একে অপরকে দুষছেন। আবার উভয় পক্ষই বলছেন, নতুন ধান উঠতে শুরু করেছে। আগামী সাত থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সব ধরনের চালের দাম কমতে শুরু করবে। কিন্তু কমছে না চালের দাম।

সূত্র জানায়, অতিবৃষ্টি, করোনায় শ্রমিকের অভাব ও সর্বশেষ খড়ায় গতবছর আমনের উৎপাদন কম হয়েছে। এতে বাজারে চালের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বোরোর বাম্পার ফলন ও আমদানি করেও সেই সংকট মেটানো সম্ভব হয়নি। আমদানি করা চাল বাজারে উঠেছে। তার পরেও বাড়ছে চালের দাম। খুচরা ব্যবসায়ীরা একে কারসাজি বলছেন। মোকামের ব্যবসায়ী যারা মিলার তারা এই কারসাজির সঙ্গে জড়িত। অপরদিকে মিলাররা বলছেন, মোকামে কোনও কারসাজি নাই। যতো কারসাজি তা আড়তে। রাজধানীর বাবুবাজার, মোহম্মদপুর, গুলশান মার্কেটের চাল ব্যবসায়ীরা কারসাজির সঙ্গে জড়িত বলে তাদের অভিযোগ।

ক্রমাগতভাবে চালের দাম বাড়তে থাকায় নড়েচড়ে বসার উদ্যোগ নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এমন পরিস্থিতিতে ধান-চালের বাজার বিশেষ করে ধান ও চালের আড়তদার বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিষয়টি জানিয়ে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রককে চিঠি পাঠিয়েছে খাদ্য অধিদফতর। অতিরিক্ত দাম ঠেকাতে ধান ও চালের অবৈধ মজুত রোধ করতেই সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।

খাদ্য অধিদফতর থেকে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে ধানের পরিপূর্ণ মৌসুম চলছে। বর্তমান সময়ে খোলা বাজারে ধানের প্রচুর সরবরাহ থাকে। মাঠ পর্যায়ে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্তমান ভরা মৌসুমে ধানের বাজার দর কিছুটা বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

‘বাজারে সক্রিয় বিভিন্ন ধরনের মিলার ও ব্যবসায়ী কর্তৃক সরকারি বিধি-বিধান অমান্য করে অধিক পরিমাণ ধান-চাল ক্রয়ের প্রবণতা রয়েছে। বিশেষ করে পাইকারি ও আড়তদাররা কোনও কোনও ক্ষেত্রে খাদ্যশস্য লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করছেন বলে প্রতীয়মান হয়। লাইসেন্সবিহীন ব্যবসা পরিচালনা করার কারণে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিপুল পরিমাণ ধান-চাল ক্রয় ও মজুত করার সুযোগ পাচ্ছেন। এতে খোলা বাজারে ধান-চালের কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে এবং বাজারমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যা চলমান বোরো সংগ্রহ কার্যক্রমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, খোলা বাজারে ধানের কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি রোধে তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে- লাইসেন্সবিহীন খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীদের (বিশেষ করে আড়তদার ও পাইকারি) বাধ্যতামূলক খাদ্যশস্য লাইসেন্স প্রদান নিশ্চিত করবেন। খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীদের প্রতি ৭ দিনের ক্রয়-বিক্রয় প্রতিবেদন (চালান, রশিদ ইত্যাদিসহ) আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক দফতরে প্রেরণ নিশ্চিত করবেন এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকরা খাদ্য অধিদফতরের সরবরাহ, বণ্টন ও বিপণন বিভাগ ও সংগ্রহ বিভাগে সামারি প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন।

কেউ যাতে অনুমোদিত পরিমাণের বেশি পরিমাণ খাদ্যশস্য অবৈধভাবে মজুত করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে পর্যবেক্ষণ জোরদার করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের উপরোক্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও খাদ্য পরিদর্শকদের কার্যকরি নির্দেশ দিতে বলা হয়েছে বলে জানা গেছে।

এদিকে গত ১৫ এপ্রিল গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি প্রাক-বাজেট আলোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, করোনায় স্বাভাবিক কাজ যেমন ব্যাহত হয়েছে তেমনি কৃষিও ব্যাহত হয়েছে। এ কারণেই চালের সরবরাহ কমেছে, ফলে চালের দাম বেড়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়পুরহাটের মিলার লায়েক আলী জানিয়েছেন, অবিলম্বেই চালের দাম কমতে শুরু করবে। মাঠ থেকে নতুন বোরো ফসল কৃষকের ঘরে উঠতে শুরু করেছে। তখন আড়তদাররা কোনও প্রকার কারসাজি করে চালের বাজারকে অস্থির করতে পারবে না।

নওগাঁর মিলার তোফাজ্জল হোসেন বলেন, মোকামে কোনও সিন্ডিকেট নাই। এখানে হাজার হাজার কেজি চাল কেনাবেচা হয়। অল্প মুনাফায় আমরা চাল ছেড়ে দেই। কেজিতে ৩০ পয়সা ৫০ পয়সা ব্যবসাই যথেষ্ট। একদিন চাল ধরে রাখলেই আমাদের ব্যবসায় লস হয়। তাই মোকামে বা মিলারদের এখানে কোনও সিন্ডিকেট বা কারসাজির সুযোগ নাই।

এ বিষয়ে বাবুবাজার-বাদামতলী চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক লক্ষী ভান্ডারের মালিক নিজাম উদ্দিন জানিয়েছেন, কমিশনের ভিত্তিতে আড়তে চাল কেনা-বেচা হয়। মিলাররা যে দর ঠিক করে দেন সেই দরেই বিক্রি করে আসল টাকা তাদের পাঠিয়ে কমিশনটা আমরা রেখে দেই। এখানে কারসাজির কোনও অবকাশ নেই। সুযোগও নাই। মিলারদের নির্ধারিত দরেই আমরা রাজধানীসহ সারা দেশে চাল বিক্রি করি।

তিনি জানিয়েছেন, অবিলম্বে সরকারের নিজস্ব মজুত বাড়াতে হবে। সরকারি গুদামে খাদ্যশষ্যের মজুত সর্বকালের নিচে নেমে গেছে। এটি বাড়াতে হবে। এর একটি প্রভাব বাজারে আছে- তা নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে।

এদিকে সরকার নিজস্ব মজুত বাড়াতে চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে মোট ১৭ লাখ টন ধান ও চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে মিলারদের কাছ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল, ৩৯ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল এবং কৃষকদের কাছ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে সাড়ে ৬ লাখ টন ধান কেনা হবে। গত ২২ এপ্রিল সরকারের খাদ্য পরিকল্পনা কমিটির ভার্চুয়াল সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ২৮ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।

চালের মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, চালের বাজারের বিষয়টি মুলত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল। তারাই বিষযটি সম্পর্ক ভালো বলতে পারবেন। তিনি জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে চালের দাম বাড়ার কোনও কারণ নাই। আমাদের বোরোর উৎপাদন খুবই ভালো হয়েছে। গত বছরের সংকট এড়াতে আমদানিও করা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে চাল। তাই কোনওভাবেই চালের বাজারে অস্থিরতা গ্রহণযোগ্য নয়।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, সরকারের নিজস্ব মজুদ বাড়াতে বোরো সংগ্রহ চলছে। লক্ষ্য অনুযায়ী ১৭ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ কার্যক্রম চলছে। এগুলো সবই চলছে। কিন্তু বাজারে অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব তো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নয়।

তিনি জানান, কিছুদিনের মধ্যেই সরকারি নিজস্ব চালের মজুদ ১০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। আশা করছি এবার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বোরো সংগ্রহ করতে পারবো।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনওভাবেই চালের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না। কারণ এবার বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে।সূত্র,বাংলাট্রিবিউন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *