বাংলাদেশের সংবিধানের অগণতান্ত্রিকতার বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই সামনে আসে সংবিধানের বিতর্কিত অনুচ্ছেদ ৭০। অনেকের কাছেই রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বৈরাচারী করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে এই অনুচ্ছেদ।
সংবিধান প্রণয়নের সময় থেকেই চলছে এই বিতর্ক। তাই এই অনুচ্ছেদের সংস্কার অথবা বাদ দেওয়ার ব্যাপারে মোটামুটি একটি জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেছে বলা যায়।
কিন্তু ঐকমত্য হলেই কি সেটি সঠিক দিকে ধাবিত হচ্ছে? সে ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোচনাই এই লেখার উদ্দেশ্য। এ ছাড়া বাংলাদেশের মতো কনফ্রন্টেশনাল ডেমোক্রেসিতে ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করলে দেশে কী ধরনের নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, সেটিও কি বিবেচনা করা দরকার নয়?
গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সংবিধানকে ‘গণতান্ত্রিক করতে’ সংবিধান সংস্কার–সংক্রান্ত কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন করে শুরু হয়েছে এই অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা।
এই বিতর্ক আরেকবার উসকে দিয়েছেন বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেছেন, অনুচ্ছেদ ৭০ এর কারণে সংসদ সদস্যরা স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারেন না এবং রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গই আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ এক ব্যক্তির হাতে চলে গেছে।
অনুচ্ছেদ ৭০ এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিটও দাখিল করা হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ৭০ বলছে, ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’
পদত্যাগ করলে সদস্যপদ যাবে সেটি নিয়ে ব্যাখ্যা হয়তো নিষ্প্রয়োজন। কারণ, কোনো ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো পদে রাখতে অথবা কাজ করানো যায় না।
তবে অন্য বিষয়টি খুব সহজভাবে বলতে গেলে, নৌকা মার্কায় নির্বাচিত হয়ে কোনো সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে ভোট দিতে পারবেন না। ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না।
অধিকাংশ বিশিষ্টজনের মতে, জনগণের পক্ষে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্যরা দলের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন না। কথা বললেই সংসদ সদস্যের সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়।
হয়তো এই ধারণা থেকেই সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধান আলী রীয়াজ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অনুচ্ছেদ ৭০ ব্যাপকভাবে সংস্কার করার সুপারিশ করা হবে।
আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, অনুচ্ছেদ ৭০ পরিবর্তন করতেই হবে, যাতে সংসদ সদস্যরা প্রয়োজনে দলের বিরুদ্ধে গিয়ে ভোট দিতে পারেন। অর্থাৎ একজন সংসদ সদস্য ক্ষমতাসীন দলের প্রতীকে নির্বাচিত হয়েও প্রয়োজন মনে করলে দেশের স্বার্থে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। আবার বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরাও দলের হুইপিংয়ের বাইরে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ভোট দিতে পারবেন। যেমনটি দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে।
কিন্তু সত্যিই কি সংসদ সদস্যরা ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে দলের সমালোচনা করতে পারেন না? দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না? সদস্যপদ হারান?