
প্রস বিজ্ঞপ্তি
যশোর জেলায় গ্রাম আদালত কার্যক্রম সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে প্রচার প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনায় স্থানীয় অংশীজনদের সাথে এক সমন্বয় সভা হয়েছে। দাতা সংস্থা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউএনডিপি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্থানীয় সরকার বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়িত বাংলাদেশে গ্রাম সক্রিয়করণ তৃতীয় পর্যায় প্রকল্পের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতকে সক্রিয় করার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন আজ ১৯ জুন বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এই সভার আয়োজন করে।
এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক, স্থানীয় সরকার মোঃ রফিকুল হাসান। সভার শুরুতে তিনি বলেন, গ্রাম আদালত সর্বপ্রথম ১৯৭৬ সালে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে আইন হয় এবং ২০১৩ ও ২০২৪ সালে সংশোধন করে সর্বশেষ ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এখানে ফৌজদারি ২৭ টি ও দেওয়ানী ৭ টি মোট ৩৪ টি বিষয়ে নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে ইউপি প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ইউপি মেম্বারদের গ্রাম আদালত আইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গ্রাম আদালত সক্রিয় হলে স্থানীয় বিরোধ স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তি হবে এবং উচ্চ আদালতের মামলার জট কমে আসবে। গ্রাম আদালত সম্পর্কে এখনো অনেক মানুষ জানে না। মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণা বৃদ্ধির জন্যই আজকের এই সমন্বয় সভা। গ্রাম আদালত সম্পর্কে প্রচারণা বৃদ্ধিতে আপনারা আপনাদের মুল্যবান মতামত তুলে ধরবেন।
সভায় বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পের ডিস্ট্রিক্ট ম্যানেজার এ্যাড. মহিতোষ কুমার রায় প্রকল্প পরিচিতি, সভার উদ্দেশ্য, গ্রাম আদালত বিষয়ে প্রচার-প্রচারণায় অংশগ্রহণকারীদের করণীয়, গ্রাম আদালত আইন এবং প্রকল্পের অগ্রগতি বিষয়ে সেসন উপস্থাপনা করেন।
সভার উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে উপপরিচালক, বিআরডিবি, যশোর বলেন, গ্রাম আদালত স্থানীয় বিরোধ স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। আমরা আমাদের অফিসে আয়োজিত বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে গ্রাম আদালত সম্পর্কে আলোচনা করছি। এই ধারা অব্যাহত থাকবে। তবে প্রকল্প থেকে কিছু প্রচারণা উপকরণ যেমন; লিফলেট, পোস্টার সরবরাহ করা প্রয়োজন।
সভায় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান রাইটস যশোর, এর নির্বাহী পরিচালক, বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, আমাদের বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামুলক কর্মসূচি রয়েছে যা গ্রাম আদালতের কাজের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। যেমন; আইন সহায়তা কর্মসূচি, পাচার প্রতিরোধ, নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্য বিবাহ রোধ। এ সকল কর্মসূচিতে আমরা গ্রাম আদালত বিষয়ে প্রচার করব। তবে প্রকল্প থেকে সচেতনতামুলক উপকরণ সরবরাহ করতে হবে।
বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বাঁচতে শেখার প্রতিনিধি বলেন, গ্রাম আদালত সম্পর্কে আমরা অতীতে একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিলাম। এখানে স্থানীয় বিরোধ স্থানীয়ভাবে নিস্পত্তির ভালো সুযোগ রয়েছে। আমারা আমাদের বিভিন্ন সচেতনতামুলক কর্সসূচি বিশেষ করে উঠান বৈঠকে প্রচার করছি এবং এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
রুপাান্তর এর প্রতিনিধি বলেন, গ্রাম আদালতের ব্যাপক প্রচারণার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের ওয়েব পোর্টালে এর সুবিধাগুলো তুলে ধরা যেতে পারে।
ব্র্যাক এর জেলা প্রতিনিধি বলেন, কেবল টিভির মাধ্যমে গ্রাম আদালতের প্র্রচারণা করা যেতে পারে। আমরা আমাদের আইন সহায়তা কার্যক্রমসহ অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রাম আদালতের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি।
স্যালভেশন আর্মি ও শিশু নিলয় ফাউন্ডেশন এর প্রতিনিধি বলেন, গ্রাম আদালত অত্যন্ত ভালো একটি বিচার ব্যবস্থা। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের সমপর্কে একটি আস্থাহীনতা রয়েছে। তারা গ্রাম আদালতের পরিবর্তে সালিসের প্রতি বেশি মনোযোগী। এ জায়গাগুলোতে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। আমরা আমাদের সচেতনতামুলক কাজের মাধ্যমে গ্রাম আদালত সম্পর্কে প্রচারণা চালাচ্ছি।
এছাড়াও সভায় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান জয়তী ফাউন্ডেশন, আহসানিয়া মিশন, ইইপআরসি, দালিত, ওয়াইডবিøউসিএ, শ্বাশ্বতী মহিলা ও শিশু উন্নয়ন সমিতি, আরআরএফ এর জেলা প্রতিনিধিবৃন্দ গ্রাম আদালত সক্রিয়করণে তাদের বাস্তবায়িত সচেতনতামুলক কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রাম আদালত বিষয়ে প্রচার প্রচারণা উদ্যোগ গ্রহণ করবেন মর্মে প্রতিশ্রæতি প্রকাশ করেন।
বীরমুক্তিযোদ্ধা ও গণমাধ্যম প্রতিনিধি দৈনিক কল্যান এর সম্পাদক ও প্রকাশক একরাম-উদ-দৌলা বলেন, যশোরে গ্রাম্ আদালতে অনেক মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে এটা ভালো দিক। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গ্রাম আদালতের বিচার কাজ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। যে সকল ইউনিয়নে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সেখানে গ্রাম আদালতের বিচার কাজ নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রাম আদালতের সুবিধাগুলো এবং ৩ মাস পর পর মামলার অগ্রগতির তথ্য আমাদেরকে দিলে আমরা পত্রিকায় প্রকাশ করতে পারব।
সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এ্যান্ড অপস) মোঃ আবুল বাশার বলেন, গ্রাম আদালত একটি পরিপূর্ণ আইন এবং অত্যন্ত চমৎকার একটি বিচার ব্যবস্থা যেখানে বিরোধীয় পক্ষরাই তাদের বিচারক মনোনয়ন করে দেন। এখানে যাদের বিরোধ ও যারা বিচার করেন তারা সকলেই সবকিছু জানেন। ফলে হয়রানির সুযোগ কম থাকে। সেকারণে অনেকে গ্রাম্ আদালতকে এড়াতে চায়। থানায় গ্রাম আদালতের এষতিয়ারভুক্ত মামলা আসলে যদি গ্রহণ না করা হয়, তাহলে পক্ষরা পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাাতিত্বের অভিযোগ আনে। আবার গ্রাম আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও তারা জনপ্রতিনিধিদের প্রতি আস্থাহীনতার কথা বলে। এখন গ্রাম আদালত নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে এবং উচ্চ আদালত থেকে গ্রাম আদালতে মামলা পাঠাচ্ছে। আশা করা যায় থানায় মামলা দায়েরের হার কমে আসবে।
সমাপনী বক্তব্যে, সভার সভাপতি বলেন, গ্রাম আদালতের ব্যাপক প্রচারণার জন্য একটি হোয়াটস অ্যাপ গ্রæপ খোলা হয়েছে সেখানে আপনারা আপনাদের প্রচারণামূলক কর্মসূচির তথ্য দিবেন। গ্রæপে গ্রাম আদালত আইনের কপি শেয়ার করা হবে। পাশাপাশি অগ্রগতির তথ্য শেয়ার করা হবে। গ্রাম আদালতের ব্যাপক প্রচারণার জন্য আপনারা নিজেদের উদ্যোগে কিছু বিলবোর্ড ও ফেস্টুন তৈরি করে বিভিন্ন বাজার বা রাস্তার মোড়ে লাগিয়ে দিতে পারেন। গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা গ্রাম আদালতের কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেন। গ্রাম আদালত সম্পর্কে অধিকাংশ জনগণকে সচেতন করার জন্য অংশগ্রহণকারী সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যনের প্রতিনিধিদের গ্রাম আদালতের প্রচারণা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়ে এবং সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে সভা সমাপ্ত করেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের জেলা কর্মকতা, বেসরকারী প্রতিষ্টানের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও প্রকল্পের স্টাফবৃন্দ।
সভায় বলা হয়, প্রকল্প শুরুর পর ফেব্রæয়ারি ২০২৪ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত যশোর জেলায় গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের হয় ২৭৩৪ টি। এর মধ্যে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদে দায়ের হয় ২২৯৯ টি এবং জেলা আদালত থেকে পাঠানো হয় ৪৩৫টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৩২৬টি ও ফৌজদারি ১৪০৮টি। দায়েরকৃত মামলার মধ্যে আবেদনকারী পুরুষ ১৮৮৬(৬৮.৯৮%) এবং নারী ৬৪৮ (৩১.০২%) জন। নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ২৬৬২ টি (৯৭.৬২%)। মোট ক্ষতিপূরণ আদায় ৩,০৮,৩১,৪৭০/- (তিন কোটি আট লক্ষ একত্রিশ হাজার চারশত সত্তর) টাকা যা ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষকে দেওয়া হয়েছে। গ্রাম আদালতে গড়ে একটি মামলা নিস্পত্তি হতে ২৩ দিন সময় লাগে।